যে প্রেরণা চিরঞ্জীব by এমাজউদ্দীন আহমদ
আজকের বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতধারায় শুধু জাতি-রাষ্ট্র, জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও জাতীয়তাবোধ যে নীরবে-নিঃশব্দে ক্ষয়ে যাচ্ছে তা-ই নয়, জাতীয় ভাবধারার মাধ্যমে যে ভাষা তাও ক্রমে ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়নের এ-কালে বহুজাতিক করপোরেশনের স্বার্থে বিশ্বব্যাপী এককেন্দ্রিক সংস্কৃতির বিজয় নিশ্চিত করতে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
যেহেতু সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা, তাই ভাষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। বেশ কিছু ভাষার অপমৃত্যু ঘটেছে এরই মধ্যে। প্রায় একযুগ আগের এক হিসাবে দেখা যায়, প্রায় ৪০ কোটি জনসমষ্টি ইংরেজিকে ব্যবহার করছে তাদের প্রথম ভাষা হিসেবে। এখন এ সংখ্যা আরো বেশি হবে। আরো ২৫ কোটি মানুষের কাছে ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ এ মুহূর্তে ইংরেজি শিক্ষায় গভীরভাবে মনোযোগী। অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী- ২০৫০ সালে বিশ্বের প্রায় অধিক লোকের ভাষা হবে ইংরেজি। বিশ্বায়নের এ যুদ্ধে বিশ্বময় যোগাযোগের মাধ্যম হয়েছে ইংরেজি। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে ইংরেজিতে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইংরেজি। তাই আজ ইংরেজি শুধু একটি ভাষা নয়, এটি এখন এক নব্য সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এভাবে আজকের এককেন্দ্রিক বিশ্বে একদিকে যেমন বিশ্বের একক ভাষা হিসেবে ইংরেজির অবস্থান ক্রমে ক্রমে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বের প্রায় সাত হাজার ভাষার মধ্যে প্রতি সপ্তাহে দুটি এবং প্রতিবছর শতাধিক ভাষা অপমৃত্যুর কবলে পড়ছে। অনেক বিজ্ঞজনের ধারণা, এই শতাব্দীর শেষ প্রান্তে বিশ্বের ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ ভাষার ভাগ্যবিড়ম্বনা ঘটতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিসংক্রান্ত সংস্থা ইউনেসকোর অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯০টি রাষ্ট্রে মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত পূর্ববাংলার দামাল ছেলেদের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেসব তরুণের আত্মদানের কথা। পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে, গর্বের সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে রফিকউদ্দিন, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিকুর রহমান, ওয়ালিউল্লাহসহ নাম না জানা আরো অনেক শহীদকে। ঢাকার শহীদ মিনার এখন শুধু ঢাকার নয়, এই শহীদ মিনার এখন সারা বিশ্বের। হয়ে উঠেছে নতুন নতুন সংগ্রামের পবিত্র স্মারক, বিজয়ের প্রতীক, অনুপ্রেরণার উৎস। এই শহীদ মিনার এখন কম্পিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের লাখ লাখজনের পদচারণে। আজও যাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত, বিশ্বায়নের অশুভ প্রক্রিয়ায় নিজেদের ভাষাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর সংগ্রামে রত রয়েছেন, তাঁরা বারবার স্মরণ করবেন পূর্ববাংলার ছাত্র-জনতার সংগ্রামী চেতনাকে। উদ্বুদ্ধ হবেন রক্তদানের মধ্য দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। তাই এখন রফিক, বরকত, সালাম, জব্বাররা শুধু বাংলাদেশের কৃতী সন্তান নন, তাঁরা আজ সমগ্র বিশ্বের, যেমন- ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো নগরীর হে মার্কেটে আট ঘণ্টা শ্রমকালের দাবিতে আত্মদানকারী শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত শুধু শিকাগো নগরীর থাকেননি। তাঁরাও বিশ্বময় শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিতে রূপান্তরিত হন। এদিক থেকে বলতে কোনো দ্বিধা নেই, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য এখন বিশ্বময় বিস্তৃত। তা শুধু বিশ্বের ২৫ কোটি বাংলাভাষীর অমূল্য সম্পদ নয়, এখন একুশে ফেব্রুয়ারি নিজেদের ভাষার মর্যাদা সংরক্ষণের দাবিতে উচ্চকণ্ঠ প্রায় ২০০ কোটি মানুষের আস্থার প্রতীক, সংগ্রামী চেতনার স্মারক। ভাষা হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহন। শিল্পকর্ম ও অগ্রগতির ধারক। ভাষার ওপর তাই কোনো আঘাত এলে সমগ্র জাতি শঙ্কিত হয়ে ওঠে। হয় আতঙ্কিত। উদ্যোগ গ্রহণ করে সেই আঘাত প্রতিহত করতে। যুক্তিবুদ্ধির সহায়তায় তা সম্ভব হলে ভালো।
বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতে যখন একটি একটি করে ভাষার অপমৃত্যু ঘটছে, তখন ওই সব ভাষাভাষাী বিচ্ছিন্ন হচ্ছে তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে। বিচ্ছিন্ন হচ্ছে তাদের শিল্প-সংস্কৃতির মূল গ্রন্থি থেকে। সাম্প্রতিককালে মাতৃভাষার সারিতে এলো ম্যাসাচুসেটসের ক্যাটওয়া। আলাস্কার এয়াক, লাটভিয়ার লিভোনিয়ান প্রভৃতি। এসব ভাষা ব্যবহারকারীরা দেশজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তারা এক ধরনের যাযাবর গোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে, কেননা তারা না পারবে বিদেশি আচার-অনুষ্ঠান পুরোপুরি আত্মীকরণ করতে। তাই নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণের দাবি অনেকটা সহজাত, মৌলিক ও আদিম। এ দাবি যত দিন শক্তিশালী থাকবে, একুশের প্রেরণা তত দিন থাকবে চিরঞ্জীব এবং তাও সমগ্র বিশ্বে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে অবশ্য নেই তেমন কোনো হতাশা। কেননা বিশ্বায়নের এ-কালে বাংলাভাষীদের বাংলা ছাড়াও শিখতে হবে অন্য ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি। ইংরেজি শিখেই তীব্র প্রতিযোগিতার এ সময়ে শুধু টিকে থাকতে হবে তা-ই নয়, বিজয়ী হতে হবে। সমানতালে পা মিলিয়ে দ্রুতগতিতে চলতে হবে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। তাই বাংলাদেশেও ইংরেজি শেখার গতি ত্বরান্বিত হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আকর্ষণ ইংরেজির প্রতি বৃদ্ধি পাবে ভীষণভাবে। কিন্তু সেই ঝড়ে অথবা টর্নেডোতে বাংলা ভাষা উড়ে যাবে না।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক মাস পর ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং অধ্যাপক আবুল কাশেমের তিন নিবন্ধের সমন্বয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা : বাংলা না উর্দু' শীর্ষক এই পুস্তিকায় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা' শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন : উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানীদের মরণ- রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র।' ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল কালাম সামসুদ্দিন প্রমুখ পণ্ডিত পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যথার্থতা সম্পর্কে লিখেছেন জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তাঁদের সবার লেখায় জাতীয় মানস তৈরি হয় নতুন সৃষ্টির জন্য। প্রস্তুত হয় ভাষা সংগ্রামের উর্বর ক্ষেত্র। বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিবিচার মাথায় নিয়ে তারুণ্য উদ্দীপ্ত হয়। তারুণ্য প্রস্তুত হয় ঐক্যবদ্ধ, সংহত, অজেয় প্রাণ প্রাচুর্যের ভাণ্ডার নিয়ে সংগ্রামের জন্য। চলি্লশের দশকের মাঝামাঝি থেকে চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের কলমের সরু খোঁচায় যে স্বপ্নের সূচনা, পঞ্চম দশকের প্রথমভাগেই সংগ্রামী তরুণদের তাজা রক্তের স্পর্শে তা প্রাণবন্ত হয়ে উঠল।
একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব-বাংলায় যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখনো যেসব জনপদে মাতৃভাষার দাবিতে সংখ্যাহীন তরুণ-তরুণী সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে, বিশেষ করে বিশ্বায়নের এই কালে, একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাভাষীদের অহংকার হয়ে না থেকে প্রতিবাদী একুশ শুধু কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানোর প্রত্যয়রূপে জাগ্রত থাকতে পারবে কি? একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস কিন্তু সাধারণ ছাত্র-জনতার ইতিহাস। এই ইতিহাসের নায়ক অথবা মহানায়ক তারাই। কোনো দল অথবা দলীয় নেতার নেতৃত্বে এর জন্ম হয়নি। দেশের চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের যুক্তিবাদী সৃজনশীল লেখনীর দ্বারা সমাজ-জীবনে এর ক্ষেত্র রচনা করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ওইস ব শহীদ এবং বীরযোদ্ধাকে- যাঁদের রক্ত, অশ্রু ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির মতো এই স্মরণীয় দিবসটি লাভ করেছি।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯০টি রাষ্ট্রে মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত পূর্ববাংলার দামাল ছেলেদের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেসব তরুণের আত্মদানের কথা। পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে, গর্বের সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে রফিকউদ্দিন, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিকুর রহমান, ওয়ালিউল্লাহসহ নাম না জানা আরো অনেক শহীদকে। ঢাকার শহীদ মিনার এখন শুধু ঢাকার নয়, এই শহীদ মিনার এখন সারা বিশ্বের। হয়ে উঠেছে নতুন নতুন সংগ্রামের পবিত্র স্মারক, বিজয়ের প্রতীক, অনুপ্রেরণার উৎস। এই শহীদ মিনার এখন কম্পিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের লাখ লাখজনের পদচারণে। আজও যাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত, বিশ্বায়নের অশুভ প্রক্রিয়ায় নিজেদের ভাষাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর সংগ্রামে রত রয়েছেন, তাঁরা বারবার স্মরণ করবেন পূর্ববাংলার ছাত্র-জনতার সংগ্রামী চেতনাকে। উদ্বুদ্ধ হবেন রক্তদানের মধ্য দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। তাই এখন রফিক, বরকত, সালাম, জব্বাররা শুধু বাংলাদেশের কৃতী সন্তান নন, তাঁরা আজ সমগ্র বিশ্বের, যেমন- ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো নগরীর হে মার্কেটে আট ঘণ্টা শ্রমকালের দাবিতে আত্মদানকারী শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত শুধু শিকাগো নগরীর থাকেননি। তাঁরাও বিশ্বময় শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিতে রূপান্তরিত হন। এদিক থেকে বলতে কোনো দ্বিধা নেই, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য এখন বিশ্বময় বিস্তৃত। তা শুধু বিশ্বের ২৫ কোটি বাংলাভাষীর অমূল্য সম্পদ নয়, এখন একুশে ফেব্রুয়ারি নিজেদের ভাষার মর্যাদা সংরক্ষণের দাবিতে উচ্চকণ্ঠ প্রায় ২০০ কোটি মানুষের আস্থার প্রতীক, সংগ্রামী চেতনার স্মারক। ভাষা হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহন। শিল্পকর্ম ও অগ্রগতির ধারক। ভাষার ওপর তাই কোনো আঘাত এলে সমগ্র জাতি শঙ্কিত হয়ে ওঠে। হয় আতঙ্কিত। উদ্যোগ গ্রহণ করে সেই আঘাত প্রতিহত করতে। যুক্তিবুদ্ধির সহায়তায় তা সম্ভব হলে ভালো।
বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতে যখন একটি একটি করে ভাষার অপমৃত্যু ঘটছে, তখন ওই সব ভাষাভাষাী বিচ্ছিন্ন হচ্ছে তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে। বিচ্ছিন্ন হচ্ছে তাদের শিল্প-সংস্কৃতির মূল গ্রন্থি থেকে। সাম্প্রতিককালে মাতৃভাষার সারিতে এলো ম্যাসাচুসেটসের ক্যাটওয়া। আলাস্কার এয়াক, লাটভিয়ার লিভোনিয়ান প্রভৃতি। এসব ভাষা ব্যবহারকারীরা দেশজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তারা এক ধরনের যাযাবর গোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে, কেননা তারা না পারবে বিদেশি আচার-অনুষ্ঠান পুরোপুরি আত্মীকরণ করতে। তাই নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণের দাবি অনেকটা সহজাত, মৌলিক ও আদিম। এ দাবি যত দিন শক্তিশালী থাকবে, একুশের প্রেরণা তত দিন থাকবে চিরঞ্জীব এবং তাও সমগ্র বিশ্বে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে অবশ্য নেই তেমন কোনো হতাশা। কেননা বিশ্বায়নের এ-কালে বাংলাভাষীদের বাংলা ছাড়াও শিখতে হবে অন্য ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি। ইংরেজি শিখেই তীব্র প্রতিযোগিতার এ সময়ে শুধু টিকে থাকতে হবে তা-ই নয়, বিজয়ী হতে হবে। সমানতালে পা মিলিয়ে দ্রুতগতিতে চলতে হবে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। তাই বাংলাদেশেও ইংরেজি শেখার গতি ত্বরান্বিত হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আকর্ষণ ইংরেজির প্রতি বৃদ্ধি পাবে ভীষণভাবে। কিন্তু সেই ঝড়ে অথবা টর্নেডোতে বাংলা ভাষা উড়ে যাবে না।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক মাস পর ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং অধ্যাপক আবুল কাশেমের তিন নিবন্ধের সমন্বয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা : বাংলা না উর্দু' শীর্ষক এই পুস্তিকায় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা' শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন : উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানীদের মরণ- রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র।' ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল কালাম সামসুদ্দিন প্রমুখ পণ্ডিত পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যথার্থতা সম্পর্কে লিখেছেন জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তাঁদের সবার লেখায় জাতীয় মানস তৈরি হয় নতুন সৃষ্টির জন্য। প্রস্তুত হয় ভাষা সংগ্রামের উর্বর ক্ষেত্র। বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিবিচার মাথায় নিয়ে তারুণ্য উদ্দীপ্ত হয়। তারুণ্য প্রস্তুত হয় ঐক্যবদ্ধ, সংহত, অজেয় প্রাণ প্রাচুর্যের ভাণ্ডার নিয়ে সংগ্রামের জন্য। চলি্লশের দশকের মাঝামাঝি থেকে চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের কলমের সরু খোঁচায় যে স্বপ্নের সূচনা, পঞ্চম দশকের প্রথমভাগেই সংগ্রামী তরুণদের তাজা রক্তের স্পর্শে তা প্রাণবন্ত হয়ে উঠল।
একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব-বাংলায় যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখনো যেসব জনপদে মাতৃভাষার দাবিতে সংখ্যাহীন তরুণ-তরুণী সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে, বিশেষ করে বিশ্বায়নের এই কালে, একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাভাষীদের অহংকার হয়ে না থেকে প্রতিবাদী একুশ শুধু কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানোর প্রত্যয়রূপে জাগ্রত থাকতে পারবে কি? একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস কিন্তু সাধারণ ছাত্র-জনতার ইতিহাস। এই ইতিহাসের নায়ক অথবা মহানায়ক তারাই। কোনো দল অথবা দলীয় নেতার নেতৃত্বে এর জন্ম হয়নি। দেশের চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের যুক্তিবাদী সৃজনশীল লেখনীর দ্বারা সমাজ-জীবনে এর ক্ষেত্র রচনা করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ওইস ব শহীদ এবং বীরযোদ্ধাকে- যাঁদের রক্ত, অশ্রু ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির মতো এই স্মরণীয় দিবসটি লাভ করেছি।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments