ভাষা আন্দোলন : রেনেসাঁর পথে মুসলমান বাঙালি by শহিদুল ইসলাম
এক. 'মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন'- তিনটি শব্দে গঠিত এই ছোট্ট বাক্যে আমার স্যার বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে মোক্ষম কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন কবে ঠিক বলতে পারব না, তবে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর ওই ছোট্ট লেখাটি 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা' গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল। গভীর তাৎপর্যপূর্ণ তাঁর ওই বাক্যটি।
সে তাৎপর্য বুঝতে হলে গত সাত শ বছরের ইতিহাসটা আমাদের সামনে রাখা দরকার। আমরা যারা পাকিস্তানি প্রজন্ম, তাদের ২১ ফেব্রুয়ারির পরের আমাদের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস সে তাৎপর্য বুঝতে অনেকটাই সাহায্য করে। তবুও ইতিহাসের সাহায্য ছাড়া সে তাৎপর্য পরিপূর্ণভাবে বোঝা কিংবা জানা সম্ভব নয়। আর বাংলাদেশি প্রজন্মের কাছে ওই বাক্যটি কতটা গুরুত্ব বা তাৎপর্য বহন করে, তা সঠিকভাবে বলা বেশ কষ্টকর বিষয়। কেননা জন্মেই বাংলাদেশের একটি শিশু জাতীয় সংগীত শুনছে রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।' দেখছে মুদ্রিত নোটে- রেল-বাসের টিকিটে, পোস্ট অফিসের বিভিন্ন কর্মে বাংলা ভাষায় লেখা। দেখছে এক হাজার সংগীতশিল্পীর কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত। রেডিও-টেলিভিশনে বাংলায় সংবাদ পাঠ শুনছে ২৪ ঘণ্টা। দেখছে ক্রিকেট-ফুটবলসহ সব খেলায় বাঙালি খেলোয়াড়দের বিজয়রথ। তাই বাংলাদেশি প্রজন্ম বুঝতেই পারবে বা কেন, উমর সাহেব প্রচণ্ড গণ-আন্দোলনের মধ্যে ওই প্রবন্ধটি লিখলেন। মানুষ কাল ও স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেদিন স্যারের ওই ছোট্ট প্রবন্ধটি বাংলাদেশের ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে আলোড়ন তুলেছিল, আজ আর তা সম্ভব নয়। তাই এখনকার প্রজন্মের ওই বাক্যটির তাৎপর্য বোঝা বেশ শক্ত। বুঝতে হলে কষ্ট করতে হবে- ইতিহাসের পাতায় গিয়ে ইতিহাস নির্মাণ করতে হবে। সবার পক্ষে তা সম্ভব নয়। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে ভাষা আন্দোলনসহ পাকিস্তানবিরোধী সব আন্দোলন নিয়ে গবেষণা এবং নতুন নতুন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। বরং আমাদের জাতীয় চেতনা ও দেশপ্রেমের উন্মেষের প্রয়োজনে সে ইতিহাস জানা একান্ত জরুরি। তাই আমি আজকের লেখার শুরুতেই চারটি চটি বইয়ের নাম করব, সেগুলো নবম শ্রেণী থেকে ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়া দরকার। স্লোগানধর্মী রাজনীতির পথ ছেড়ে গঠনমূলক মনোভাব তৈরির কাজ শুরু করা দরকার। বইগুলো হলো- আবদুল হকের 'ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব', 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ', বদরুদ্দীন উমরের 'সাম্প্রদায়িকতা' এবং 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা'।
দুই. ওই প্রবন্ধের তিনটি শব্দের প্রথমেই বলছেন 'মুসলমানদের'। সামনে বাঙালি বলেননি। অর্থাৎ তিনি বাঙালি মুসলমানসহ সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলমানের কথাই বলেছেন। দ্বিতীয় শব্দ 'স্বদেশ'। অর্থাৎ নিজ দেশ। তৃতীয় শব্দটি হলো 'প্রত্যাবর্তন'। অর্থাৎ ফিরে আসা। অর্থাৎ ভারতবর্ষের 'মুসলমানরা' ইতিপূর্বে 'স্বদেশের মাটিতে' বাস করেও 'স্বদেশে' ছিলেন না। বাংলার বা ভারতবর্ষের মাটিতে পা রেখে, এ দেশের বায়ুতে নিঃশ্বাস নিয়ে, এ দেশের পানি খেয়েও তাঁরা এ দেশে ছিলেন না। নিজের দেশে বাস করেও আত্মিকভাবে মুসলমান থাকলেন পরবাসী হয়ে। স্যার লিখেছেন, 'উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানেরা নিজেদের সুবিধামতো এক জাতিত্ব আবিষ্কার করে ক্রমাগত প্রচার করলেন যে সৎ বংশজাত মুসলমান মাত্রেরই পূর্বপুরুষ আরব, ইরান, তুর্কি থেকে আগত। ...এভাবেই মুসলমানরা আত্মিক দিক থেকে স্বদেশে থাকলেন পরবাসী হয়ে।' (১০)। স্যারের এই সিদ্ধান্ত যে কত বড় সত্যি, তা ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলেই ধরা পড়ে। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০) লিখেছিলেন, 'যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।' কবি হাকিমের সময়ও এ দেশের মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে যে সুচক্ষে দেখত না, কবিতার দুটি চরণই তা বলে দেয়। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে যাঁরা বাংলাদেশকে নিজের দেশ বলে মানতে চান না, হাকিমের চোখে তাঁরা 'বেজন্মা'। বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনতে মধ্যযুগ থেকেই এভাবে কিছু মানুষ আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত থেকেছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- ১৯০৯ সালে 'বাসনা' পত্রিকায় লেখা হলো- 'যে দেশে আমরা ৭০০ বছর কাল বাস করিতেছি, সে দেশকে যদি আমরা এখনো স্বদেশ জ্ঞান না করি, তাহা অপেক্ষা আশ্চর্য এবং পরিতাপের বিষয় আর কী আছে?' ১৯২৯ সালের 'সওগাত' পত্রিকায় নুরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী লেখেন, 'সর্বক্ষণ এই ভাবটা আমাদের অন্তরে পোষণ করতে হবে যে 'বাঙালি' শব্দের ওপর আমাদের প্রতিবাসী হিন্দুর যে পরিমাণ অধিকার, তার চেয়ে আমাদের দাবি অনেকাংশে বেশি।... আমরা এই বাঙ্গলা মায়েরই সন্তান।' ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে 'সওগাত' পত্রিকায় আবুল হোসেন লেখেন, 'পুরুষানুক্রমে যুগ-যুগান্তর ধরে বাঙ্গালা দেশের গণ্ডির মধ্যে বাস করে আর এই বাঙ্গালা ভাষাতেই সর্বক্ষণ মনের ভাব ব্যক্ত করেও যদি বাঙ্গালী না হয়ে আমরা অপর কোন একটা জাতি সেজে বেঁচে থাকতে চাই, তাহলে আমাদের ত আর কখনও উত্থান নাই-ই, অধিকন্তু চির তমসাচ্ছন্ন গহ্বর মধ্যে পতনই অবশ্যম্ভাবী।' তাঁদেরই উত্তরসূরি বদরুদ্দীন উমর ওই প্রবন্ধে লিখেছেন, 'নিজের দেশকে স্বদেশ মনে না করার জন্যে মানুষের জীবনে যে দুর্যোগ, স্বাভাবিক মুসলমানরা সে দুর্যোগকে রোধ করতে পারেননি।... দেশের মাটির সাথে এই সম্পর্কহীনতার ফলে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক চেতনার উপযুক্ত উন্মেষ সম্ভব হলো না, তাদের সাংস্কৃতিক সৃষ্টিশীলতাও বাধাগ্রস্ত হলো বহুতরভাবে।' (৮-৯)।
তিন. ১৯৪০ সালে লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর বাঙালিবিরোধী সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরা অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে উঠলেন। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বে ও তার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনায় সাম্প্রদায়িক শক্তির পালে হাওয়া লাগে। ১৯৪২ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ'। সভাপতি ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ও সম্পাদক সৈয়দ আলী আহসান। একই সঙ্গে কলকাতায় গড়ে ওঠে 'পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি'। এর পেছনে ছিলেন মুজীবুর রহমান খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ হাবীবুল্লাহ বাহার, আবুল মনসুর আহমেদ প্রমুখ। তাঁদের সম্পর্কে হায়াৎ মামুদ বলেন, 'তাঁদের চিন্তাভাবনা স্পষ্ট করে প্রমাণ করে যে আবহমানকালের অবিভাজ্য বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ইতিহাসদৃষ্টি যেমন তাঁদের ছিল না, তেমনি বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পৃথক বলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন।' সৈয়দ আলী আহসানের চোখে মোশাররফ হোসেন, মোজাম্মেল হক, রেয়াজ উদ্দীন, কায়কোবাদ প্রমুখ সাহিত্যিকের সাহিত্যে 'পূর্ণভাবে মুসলমান জাতির সংস্কৃতির ছবি ফুটে ওঠেনি।' সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন বলেন, 'ভারতের সার্বজনীন ভাষা হিসাবে উর্দুর দাবী অগ্রাহ্য করা নিষ্প্রয়োজন। সেই কারণে উর্দু-শিক্ষার প্রসারও আমরা বাঞ্ছনীয় মনে করি।' ১৯২৫ সালে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ কাজী নজরুল ইসলামকে 'মুসলিম সাহিত্য' রচনার অনুরোধ করেছিলেন। ১৩৫১ সালে কলকাতার রেনেসাঁ সোসাইটির উদ্যোগে রেনেসাঁ সম্মেলনের মূল সভাপতির ভাষণে প্রখ্যাত মুসলিম সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ স্পষ্টই বলেছিলেন, 'পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি, তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুব উন্নত সাহিত্য। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গিয়েছেন। তবুও এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্যে মুসলমানের কোন দান নেই। শুধু তাই নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ সাহিত্যের কোন দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ প্রাণ-প্রেরণ পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে, এ সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়, এর স্পিরিটও মুসলমানী নয়। এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়। (জিন্নাহর তত্ত্বানুযায়ী ভারতের ১০ কোটি মুসলমানের ভাষা একটিই- শই)। প্রথমত এ সাহিত্যের স্পিরিটের কথাই ধরা যাক। এ সাহিত্য হিন্দু মনীষার সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু সংস্কৃতিকে বুনিয়াদ করে তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ঠিকই তাঁরা করেছেন। নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না, কিন্তু সত্য কথা এই যে, ঐ সাহিত্যকে মুসলমানেরা জাতীয় সাহিত্য মনে করে না।' (কারণ, হিন্দুরা আলাদা জাতি ও মুসলমানরা আলাদা জাতি- শই)। ১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই হায়দরাবাদের মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং ওই মাসেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহর ঘোষণা দেওয়ার আগেই উর্দুর পক্ষে বক্তব্য দিতে শুরু করেন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতারা আর বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা বলে।
চার. কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষেও দাঁড়িয়ে যান অনেকেই। ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জিয়াউদ্দীন আহমেদের সুপারিশের অসারতা প্রমাণ করে লেখেন- 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা'। প্রচুর যুক্তি-তর্কে জিয়াউদ্দীন আহমেদের সব যুক্তি খণ্ডন করার শেষে বলেন, 'বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে।' জিয়াউদ্দীনের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে তিনি আরো বলেন, 'ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতিবিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতিবিবর্জিতও বটে।' দেখা যায়, জিন্নাহর ঘোষণার আগেই ভাষাবিষয়ক তর্ক-বিতর্ক শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র হয়ে উঠেছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে বিভিন্ন ছদ্ম নামে আবদুল হক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চারটি প্রবন্ধ লেখেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদে 'বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব' (২২ ও ২৯ জুন, ১৯৪৭), পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (দৈনিক আজাদ, ৩০ জুন ১৯৪৭); 'উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে' (ইত্তেহাদ, ২৭ জুলাই ১৯৪৭) এবং 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' (সাপ্তাহিক বেগম, ৩ আগস্ট ১৯৪৭), পাকিস্তানের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৯৪৯ সালে আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার পক্ষে জোর প্রচার চালান। প্রতিবাদে আবদুল হক লেখেন- 'আরবী হরফে বাংলা' (দৈনিক ইত্তেহাদ ও রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগ, ২০ মার্চ ১৯৪৯)। দেখা যায়, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরুর আগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই তা শুরু হয়েছিল। বাঙালি মুসলমান একসময় নিজেকে বাঙাল ভাবতে রাজি ছিল না। ১৯৪০ সালের পর যেমন দ্বিজাতিতত্ত্বের বাড়-বাড়ন্ত দেখা যায়, তেমনি দুর্বল হলেও বাঙালি মুসলমানের সম্বিত ফিরে আসতে শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহর ঘোষণার পর তা এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি চক্রান্ত বাঙালি মুসলমানকে ক্রমে 'বাঙালি' হয়ে উঠতে অনুপ্রেরণা জোগায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তা ফেটে পড়ে প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলনে।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর সঙ্গে ধর্মের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি দিয়েই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু উনিশ শতাব্দীর বাংলার তথাকথিত রেনেসাঁ শুরুই হয়েছিল ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। প্রথম যুগে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তার তেমন কোনো যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি। এমনকি ১৮৩৫ সালে মেকলে যখন ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করেন, তখন রামমোহন রায় ও তাঁর সহকর্মীরা বাংলা ভাষার কথা একবারও উল্লেখ করেননি। বরং মেকলে যে বাঙালি জাতির এত বড় ক্ষতিসাধন করলেন, নবজাগরণের নেতারা খুশি মনে তা সমর্থন করেন। ইউরোপীয় রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান দিক হলো জাতীয় ভাষার উত্থান, সেই সঙ্গে আধুনিক জাতীয় ভাবনা, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি। এখানেই স্পষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৪২ সাল থেকে নতুন করে ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির সংগ্রাম শুরু হয়, আসলে তা মুসলমান বাঙালির ঘরে ফেরার সংগ্রাম। উমরের ভাষায়- 'বাঙালী পরিবার সে আর লজ্জিত হলো না। যে চিত্ত ছিল পরবাসী, সে চিত্ত সচেষ্ট হলো স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে। প্রতিকূল শক্তি এবং সংস্কার এ পরিবর্তনকে প্রতিহত করা সত্ত্বেও ঘরে ফেরার এ-সংগ্রাম রইলো অব্যাহত এবং তারা জয় করে চললো একের পর এক ভূমি- স্বীকৃত হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলা, বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য; স্বীকৃত হলো, রবীন্দ্রনাথ এবং পহেলা বৈশাখ।'
ছয়. তাই শেষ বিচারে আমার মনে হয়, ভাষা আন্দোলন মুসলমান বাঙালির রেনেসাঁ। ইউরোপীয় রেনেসাঁর সঙ্গে উনিশ শতকীয় হিন্দু বাঙালির পুনর্জাগরণের চেয়ে পূর্ববাংলার মুসলমান বাঙালির ভাষা আন্দোলনের মিল অনেক বেশি। তাই দীর্ঘ ছয়-সাত শ বছর এ দেশের আশরাফ শ্রেণী নিজ স্বার্থে মুসলমান বাঙালকে 'বাঙালি' হতে দেয়নি, বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির সব দরজা তাদের জন্য বন্ধ করে রেখেছিল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভাষা আন্দোলন সেসব রুদ্ধ দরজা ভেঙে বাঙালি মুসলমানকে 'মুসলমান বাঙালিতে' পরিণত করেছে। আজ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেবা করার বিরুদ্ধে কেউ ডাণ্ডা নিয়ে দণ্ডায়মান নেই। একুশের সিঁড়ি বেয়ে আসে একাত্তর। বাঙালির বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে মুসলমান বাঙালি পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে কবর দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দেয়। সব কিছু আজ মুসলমান বাঙালির দখলে। গত ৪০ বছরের ব্যর্থতাটাই আমাদের সবার চোখে পড়ে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি- সবখানেই আমাদের ব্যর্থতা আকাশচুম্বী, এটা অস্বীকার করা যায় না। সব কিছু আজ দুর্বৃত্ত সম্পদের দখলে। সেই দুর্বৃত্ত সম্পদ আজ আমাদের সব অর্জন মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, রেনেসাঁকে করেছে কর্দমাক্ত। তবুও আশার বিরুদ্ধে আশা না করে মানুষ বাঁচে না। আমি আশাবাদী। পরবর্তী দুই-তিন প্রজন্মের মধ্যে একুশ আমাদের রেনেসাঁর পথে পরিচালিত করবে বলেই আমার বিশ্বাস। উমরের কথার সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, প্রতিকূল শক্তি ও সংস্কারের সব বাধা অতিক্রম করে একুশ প্রতিপক্ষের সব দুর্গ ধ্বংস করবেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
দুই. ওই প্রবন্ধের তিনটি শব্দের প্রথমেই বলছেন 'মুসলমানদের'। সামনে বাঙালি বলেননি। অর্থাৎ তিনি বাঙালি মুসলমানসহ সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলমানের কথাই বলেছেন। দ্বিতীয় শব্দ 'স্বদেশ'। অর্থাৎ নিজ দেশ। তৃতীয় শব্দটি হলো 'প্রত্যাবর্তন'। অর্থাৎ ফিরে আসা। অর্থাৎ ভারতবর্ষের 'মুসলমানরা' ইতিপূর্বে 'স্বদেশের মাটিতে' বাস করেও 'স্বদেশে' ছিলেন না। বাংলার বা ভারতবর্ষের মাটিতে পা রেখে, এ দেশের বায়ুতে নিঃশ্বাস নিয়ে, এ দেশের পানি খেয়েও তাঁরা এ দেশে ছিলেন না। নিজের দেশে বাস করেও আত্মিকভাবে মুসলমান থাকলেন পরবাসী হয়ে। স্যার লিখেছেন, 'উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানেরা নিজেদের সুবিধামতো এক জাতিত্ব আবিষ্কার করে ক্রমাগত প্রচার করলেন যে সৎ বংশজাত মুসলমান মাত্রেরই পূর্বপুরুষ আরব, ইরান, তুর্কি থেকে আগত। ...এভাবেই মুসলমানরা আত্মিক দিক থেকে স্বদেশে থাকলেন পরবাসী হয়ে।' (১০)। স্যারের এই সিদ্ধান্ত যে কত বড় সত্যি, তা ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলেই ধরা পড়ে। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০) লিখেছিলেন, 'যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।' কবি হাকিমের সময়ও এ দেশের মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে যে সুচক্ষে দেখত না, কবিতার দুটি চরণই তা বলে দেয়। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে যাঁরা বাংলাদেশকে নিজের দেশ বলে মানতে চান না, হাকিমের চোখে তাঁরা 'বেজন্মা'। বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনতে মধ্যযুগ থেকেই এভাবে কিছু মানুষ আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত থেকেছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- ১৯০৯ সালে 'বাসনা' পত্রিকায় লেখা হলো- 'যে দেশে আমরা ৭০০ বছর কাল বাস করিতেছি, সে দেশকে যদি আমরা এখনো স্বদেশ জ্ঞান না করি, তাহা অপেক্ষা আশ্চর্য এবং পরিতাপের বিষয় আর কী আছে?' ১৯২৯ সালের 'সওগাত' পত্রিকায় নুরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী লেখেন, 'সর্বক্ষণ এই ভাবটা আমাদের অন্তরে পোষণ করতে হবে যে 'বাঙালি' শব্দের ওপর আমাদের প্রতিবাসী হিন্দুর যে পরিমাণ অধিকার, তার চেয়ে আমাদের দাবি অনেকাংশে বেশি।... আমরা এই বাঙ্গলা মায়েরই সন্তান।' ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে 'সওগাত' পত্রিকায় আবুল হোসেন লেখেন, 'পুরুষানুক্রমে যুগ-যুগান্তর ধরে বাঙ্গালা দেশের গণ্ডির মধ্যে বাস করে আর এই বাঙ্গালা ভাষাতেই সর্বক্ষণ মনের ভাব ব্যক্ত করেও যদি বাঙ্গালী না হয়ে আমরা অপর কোন একটা জাতি সেজে বেঁচে থাকতে চাই, তাহলে আমাদের ত আর কখনও উত্থান নাই-ই, অধিকন্তু চির তমসাচ্ছন্ন গহ্বর মধ্যে পতনই অবশ্যম্ভাবী।' তাঁদেরই উত্তরসূরি বদরুদ্দীন উমর ওই প্রবন্ধে লিখেছেন, 'নিজের দেশকে স্বদেশ মনে না করার জন্যে মানুষের জীবনে যে দুর্যোগ, স্বাভাবিক মুসলমানরা সে দুর্যোগকে রোধ করতে পারেননি।... দেশের মাটির সাথে এই সম্পর্কহীনতার ফলে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক চেতনার উপযুক্ত উন্মেষ সম্ভব হলো না, তাদের সাংস্কৃতিক সৃষ্টিশীলতাও বাধাগ্রস্ত হলো বহুতরভাবে।' (৮-৯)।
তিন. ১৯৪০ সালে লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর বাঙালিবিরোধী সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরা অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে উঠলেন। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বে ও তার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনায় সাম্প্রদায়িক শক্তির পালে হাওয়া লাগে। ১৯৪২ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ'। সভাপতি ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ও সম্পাদক সৈয়দ আলী আহসান। একই সঙ্গে কলকাতায় গড়ে ওঠে 'পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি'। এর পেছনে ছিলেন মুজীবুর রহমান খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ হাবীবুল্লাহ বাহার, আবুল মনসুর আহমেদ প্রমুখ। তাঁদের সম্পর্কে হায়াৎ মামুদ বলেন, 'তাঁদের চিন্তাভাবনা স্পষ্ট করে প্রমাণ করে যে আবহমানকালের অবিভাজ্য বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ইতিহাসদৃষ্টি যেমন তাঁদের ছিল না, তেমনি বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পৃথক বলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন।' সৈয়দ আলী আহসানের চোখে মোশাররফ হোসেন, মোজাম্মেল হক, রেয়াজ উদ্দীন, কায়কোবাদ প্রমুখ সাহিত্যিকের সাহিত্যে 'পূর্ণভাবে মুসলমান জাতির সংস্কৃতির ছবি ফুটে ওঠেনি।' সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন বলেন, 'ভারতের সার্বজনীন ভাষা হিসাবে উর্দুর দাবী অগ্রাহ্য করা নিষ্প্রয়োজন। সেই কারণে উর্দু-শিক্ষার প্রসারও আমরা বাঞ্ছনীয় মনে করি।' ১৯২৫ সালে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ কাজী নজরুল ইসলামকে 'মুসলিম সাহিত্য' রচনার অনুরোধ করেছিলেন। ১৩৫১ সালে কলকাতার রেনেসাঁ সোসাইটির উদ্যোগে রেনেসাঁ সম্মেলনের মূল সভাপতির ভাষণে প্রখ্যাত মুসলিম সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ স্পষ্টই বলেছিলেন, 'পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি, তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুব উন্নত সাহিত্য। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গিয়েছেন। তবুও এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্যে মুসলমানের কোন দান নেই। শুধু তাই নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ সাহিত্যের কোন দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ প্রাণ-প্রেরণ পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে, এ সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়, এর স্পিরিটও মুসলমানী নয়। এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়। (জিন্নাহর তত্ত্বানুযায়ী ভারতের ১০ কোটি মুসলমানের ভাষা একটিই- শই)। প্রথমত এ সাহিত্যের স্পিরিটের কথাই ধরা যাক। এ সাহিত্য হিন্দু মনীষার সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু সংস্কৃতিকে বুনিয়াদ করে তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ঠিকই তাঁরা করেছেন। নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না, কিন্তু সত্য কথা এই যে, ঐ সাহিত্যকে মুসলমানেরা জাতীয় সাহিত্য মনে করে না।' (কারণ, হিন্দুরা আলাদা জাতি ও মুসলমানরা আলাদা জাতি- শই)। ১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই হায়দরাবাদের মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং ওই মাসেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহর ঘোষণা দেওয়ার আগেই উর্দুর পক্ষে বক্তব্য দিতে শুরু করেন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতারা আর বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা বলে।
চার. কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষেও দাঁড়িয়ে যান অনেকেই। ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জিয়াউদ্দীন আহমেদের সুপারিশের অসারতা প্রমাণ করে লেখেন- 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা'। প্রচুর যুক্তি-তর্কে জিয়াউদ্দীন আহমেদের সব যুক্তি খণ্ডন করার শেষে বলেন, 'বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে।' জিয়াউদ্দীনের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে তিনি আরো বলেন, 'ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতিবিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতিবিবর্জিতও বটে।' দেখা যায়, জিন্নাহর ঘোষণার আগেই ভাষাবিষয়ক তর্ক-বিতর্ক শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র হয়ে উঠেছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে বিভিন্ন ছদ্ম নামে আবদুল হক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চারটি প্রবন্ধ লেখেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদে 'বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব' (২২ ও ২৯ জুন, ১৯৪৭), পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (দৈনিক আজাদ, ৩০ জুন ১৯৪৭); 'উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে' (ইত্তেহাদ, ২৭ জুলাই ১৯৪৭) এবং 'পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' (সাপ্তাহিক বেগম, ৩ আগস্ট ১৯৪৭), পাকিস্তানের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৯৪৯ সালে আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার পক্ষে জোর প্রচার চালান। প্রতিবাদে আবদুল হক লেখেন- 'আরবী হরফে বাংলা' (দৈনিক ইত্তেহাদ ও রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগ, ২০ মার্চ ১৯৪৯)। দেখা যায়, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরুর আগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই তা শুরু হয়েছিল। বাঙালি মুসলমান একসময় নিজেকে বাঙাল ভাবতে রাজি ছিল না। ১৯৪০ সালের পর যেমন দ্বিজাতিতত্ত্বের বাড়-বাড়ন্ত দেখা যায়, তেমনি দুর্বল হলেও বাঙালি মুসলমানের সম্বিত ফিরে আসতে শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহর ঘোষণার পর তা এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি চক্রান্ত বাঙালি মুসলমানকে ক্রমে 'বাঙালি' হয়ে উঠতে অনুপ্রেরণা জোগায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তা ফেটে পড়ে প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলনে।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর সঙ্গে ধর্মের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি দিয়েই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু উনিশ শতাব্দীর বাংলার তথাকথিত রেনেসাঁ শুরুই হয়েছিল ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। প্রথম যুগে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তার তেমন কোনো যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি। এমনকি ১৮৩৫ সালে মেকলে যখন ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করেন, তখন রামমোহন রায় ও তাঁর সহকর্মীরা বাংলা ভাষার কথা একবারও উল্লেখ করেননি। বরং মেকলে যে বাঙালি জাতির এত বড় ক্ষতিসাধন করলেন, নবজাগরণের নেতারা খুশি মনে তা সমর্থন করেন। ইউরোপীয় রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান দিক হলো জাতীয় ভাষার উত্থান, সেই সঙ্গে আধুনিক জাতীয় ভাবনা, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি। এখানেই স্পষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৪২ সাল থেকে নতুন করে ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির সংগ্রাম শুরু হয়, আসলে তা মুসলমান বাঙালির ঘরে ফেরার সংগ্রাম। উমরের ভাষায়- 'বাঙালী পরিবার সে আর লজ্জিত হলো না। যে চিত্ত ছিল পরবাসী, সে চিত্ত সচেষ্ট হলো স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে। প্রতিকূল শক্তি এবং সংস্কার এ পরিবর্তনকে প্রতিহত করা সত্ত্বেও ঘরে ফেরার এ-সংগ্রাম রইলো অব্যাহত এবং তারা জয় করে চললো একের পর এক ভূমি- স্বীকৃত হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলা, বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য; স্বীকৃত হলো, রবীন্দ্রনাথ এবং পহেলা বৈশাখ।'
ছয়. তাই শেষ বিচারে আমার মনে হয়, ভাষা আন্দোলন মুসলমান বাঙালির রেনেসাঁ। ইউরোপীয় রেনেসাঁর সঙ্গে উনিশ শতকীয় হিন্দু বাঙালির পুনর্জাগরণের চেয়ে পূর্ববাংলার মুসলমান বাঙালির ভাষা আন্দোলনের মিল অনেক বেশি। তাই দীর্ঘ ছয়-সাত শ বছর এ দেশের আশরাফ শ্রেণী নিজ স্বার্থে মুসলমান বাঙালকে 'বাঙালি' হতে দেয়নি, বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির সব দরজা তাদের জন্য বন্ধ করে রেখেছিল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভাষা আন্দোলন সেসব রুদ্ধ দরজা ভেঙে বাঙালি মুসলমানকে 'মুসলমান বাঙালিতে' পরিণত করেছে। আজ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেবা করার বিরুদ্ধে কেউ ডাণ্ডা নিয়ে দণ্ডায়মান নেই। একুশের সিঁড়ি বেয়ে আসে একাত্তর। বাঙালির বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে মুসলমান বাঙালি পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে কবর দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দেয়। সব কিছু আজ মুসলমান বাঙালির দখলে। গত ৪০ বছরের ব্যর্থতাটাই আমাদের সবার চোখে পড়ে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি- সবখানেই আমাদের ব্যর্থতা আকাশচুম্বী, এটা অস্বীকার করা যায় না। সব কিছু আজ দুর্বৃত্ত সম্পদের দখলে। সেই দুর্বৃত্ত সম্পদ আজ আমাদের সব অর্জন মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, রেনেসাঁকে করেছে কর্দমাক্ত। তবুও আশার বিরুদ্ধে আশা না করে মানুষ বাঁচে না। আমি আশাবাদী। পরবর্তী দুই-তিন প্রজন্মের মধ্যে একুশ আমাদের রেনেসাঁর পথে পরিচালিত করবে বলেই আমার বিশ্বাস। উমরের কথার সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, প্রতিকূল শক্তি ও সংস্কারের সব বাধা অতিক্রম করে একুশ প্রতিপক্ষের সব দুর্গ ধ্বংস করবেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments