সৃজনের কাছে শেখা by এম এ কাসেম


আমার সাড়ে চার বছর বয়সী ছেলে সৃজনের কাছে আমি যা শিখেছি, তা আমার কাছে বেশ মূল্যবান মনে হয়। সত্যি বলতে কী তার কাছ থেকে শেখা একটি উপলব্ধি আমার জীবনদৃষ্টি অনেকখানি বদলে দিয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, আমি বাসায় কোনো কারণে রেগে গেলে, উত্তেজিত হয়ে ওকে কিছু বললে ও আমাকে হাল্কা মার দিয়ে শাসন করে।
সে চুপচাপ আমার চুল টেনে ধরে, ছোট ছোট হাত দিয়ে আমাকে মারতে শুরু করে। না, কৃত্রিম নয়, সত্যি সত্যি ও আমাকে মারে। আমার মা বেঁচে নেই। যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন তিনি কখনও আমাকে এভাবে মেরেছেন বলে মনে পড়ে না। তবে খুব ছোট বেলায়, কোনো অন্যায় বা বেশি রকম দুষ্টুমি করার জন্য বড় ভাই কিংবা বাবা আমাকে যেভাবে শাসন করতেন আমার ছেলে সৃজনের শাসন অনেকটা সে রকম। তবে এর তাত্পর্যের দিকটা যে কত ভিন্ন সেটাই বলছি।

সৃজন যখন আমার সঙ্গে মারমুখী আচরণ করে তখন আমি সাধারণত চুপ থাকি। ওর চেহারায় আমার মায়ের চেহারার প্রতিফলন দেখি। কেন জানি মনে হয়, মা-ই আমাকে সৃজনের রূপ ধরে এভাবে শাসন করেন। সে আমাকে বেশিক্ষণ নির্মম থাকতে দেয় না। তবে যখন সত্যি সত্যি গায়ে ব্যথা পাই তখন ওকে দুই হাতে বাধা দিয়ে ফেরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ফেরাতে গেলে ও আরও বেশি করে আমাকে আঘাত করতে থাকে। তখন এ দৃশ্য অনেকটা বাবা-ছেলের তুমুল ঝগড়ায় রূপ নেয়।
এতক্ষণ যা বললাম তা এই কাহিনীর ভূমিকা। মূল নাটক শুরু হয় আরও পরে। শিগগির ওর দিক থেকে শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব আসে... অভিমান আপ্লুত কড়া আদেশের সুরে ও বলে, ‘আদর কর’। আমি ইতস্তত করলে ও কখনও কখনও কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, আদর কর। কখনও কখনও, সংলাপ কিছুটা দীর্ঘায়িত হয়। সে বলে, বল; বাবা আমি আর কখনও এমন করব না...।
আমি আর রাগ পুষে রাখতে পারি না। আমি বদলে যাই। খুব দ্রুত অন্য মানুষ হয়ে যাই। এরপর অনেকটা বাধ্য হয়েই আমি দু’হাতে ওর চোখে-মুখে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করি। ও শান্ত হয়। মার বন্ধ করে দেয়। আমার সঙ্গে আবার আগের মতো ওর মিলমিশ হয়ে যায়। বই পড়া আমার নেশা। বাংলা, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় লেখা যত ভালো বই আমি পাই পড়ার চেষ্টা করি। আমি সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ কলায় এমএ। গত পনের বছর ধরে আমি রিপোর্টিং, সম্পাদনা ও জনসংযোগের কাজ করছি। পেশাগত কারণেই নিয়মিত বহু মানুষের সঙ্গে আমার কথা বলতে হয়। মিশতে হয়। প্রতিদিন তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের বই পড়ে, লেখা খুঁটিয়ে দেখে আমি অনেক কিছু শিখি।
কিন্তু এভাবে, সৃজনের মতো করে, চেয়ে আদর নিয়ে শান্তি স্থাপনের কৌশল আমাকে এর আগে কেউ শেখায়নি। সৃজনের মা হাবিবা মাঝে মাঝে আমাদের বাবা-ছেলের কাজ দেখে মুখ টিপে হাসে। পরিবারের অন্য সদস্য, আত্মীয়-স্বজন যারা ব্যাপারটা দেখেছে তারাও এটা উপভোগ করে। তবে আমি এর থেকে যা শিখেছি তা তারা শিখেছে কিনা জানি না।
সৃজনের এ কৌশল দেখে আমি ধরে নিয়েছি যে, এটা আমার জন্য খুব ভালো একটা শিক্ষা। আমি যাকে ভালোবাসি, যে আমার অতি আপনজন তার কাছে থেকে প্রয়োজনে আদর-সোহাগ, প্রীতিময়, ভালো আচরণ আমি আশা করতেই পারি। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে ব্যাপারটা সৃজনের মতো মুখ ফুটে বলেও ফেলা যায়। এমনকি যেখানে প্রযোজ্য সেখানে প্রাপ্য জিনিস আদায় করে নেয়ার জন্য কিছুটা জোরও করা যায়। এটা চেয়ে নেয়ার বিষয়।
আমার প্রিয় মানুষটি আমাকে যদি ভুল বোঝে, আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অপ্রত্যাশিত কোনো আচরণ করে, তার জন্য তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ করে দিতে হবে—এমন নয়। বিশেষ মুহূর্তে আমি তাকে বলতেই পারি যে, আমাকে আদর কর। অথবা আমার সঙ্গে ভালো আচরণ কর। মমত্বশীল হও। ভালো হও। আমার প্রতিও তার যদি ভেতরে মমতা থেকে থাকে, অধিকারবোধ থাকে, সে আমার এ কথায় সচেতন হবে তার ভুল ভাঙবে। সে ভালো আচরণ করবে। আমাদের সম্পর্ক টিকে থাকবে।
এই উপলব্ধি আমার আগে ছিল না বলেই আমি অনেক বন্ধু হারিয়েছি। অতীতের কোনো কোনো প্রিয়জনের সঙ্গে বর্তমানে আমার সম্পর্ক শীতল। কারও কারও সঙ্গে কথাই হয় না। ফোন, ইমেইল করা, চিঠিপত্র লেখা, বিপদে-আপদে কাছে ছুটে যাওয়া, সহযোগিতার হাত বাড়ানো—এসব তো আরও পরের কথা।
না, এটা কোনো তত্ত্বকথা নয়। সৃজনের কাছ থেকে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার কৌশলটি শেখার পর এর বাস্তব প্রয়োগও আমি এরই মধ্যে করেছি। আমার কয়েকজন পুরনো বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী এবং আত্মীয়ের সঙ্গে আমি ভেঙে যাওয়া সুসম্পর্ক নতুন করে গড়ে তুলতে পেরেছি।
আর সেটা করতে পেরেছি কৃত্রিম অহমিকা ঝেড়ে ফেলে, নিজের দিক থেকে ছাড় দিয়ে, ইতিবাচক মানসিকতা প্রকাশ করে, শিশুসুলভ সরলতায় সহানুভূতিশীল কথা ও আচরণের মাধ্যমে। অনেক ক্ষেত্রে হাই-হ্যালো, কেমন আছ, কি করছ, তোমার ছেলেমেয়ে কেমন—এ ধরনের কথায় কাজ হয়েছে।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফোন, ইমেইল, উপহার আদান-প্রদান, অসুখ-বিসুখে দেখতে যাওয়া—এসবে কাজ হয়েছে। মোট কথা, সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগুনোর ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আর এই শিক্ষাটা সৃজনের মতো ছোট্ট শিশুদের কাছ থেকে ভালো পাওয়া যায়।
সম্প্রতি প্রয়াত আমার প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী মাইকেল জ্যাকসনের একটা কথা প্রসঙ্গত আমার মনে পড়ছে। সমাজের সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জ্যাকসন বলতেন, মানুষের ভেতর থেকে তার শৈশব কেড়ে নিলে সে সহিংস হয়ে ওঠে। সৃজনকে দেখে দেখে আমার মনে হয়, বয়স যতই বাড়ুক অন্তরে আমাদের শৈশবকে লালন করা দরকার পরম যত্নে, মমতায়। শিশুদের কাছ থেকে আসলেই আমাদের বড়দের অনেক কিছু শেখার আছে। এর আগে এই উপলব্ধি আমার মধ্যে এতটা পরিষ্কার কখনোই ছিল না।
সৃজন আমার অন্তর্জগতকে এভাবে বদলে দেয়াতেই এখন আমার মনে হয়, ভুল রাজনীতি আর স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানুষ পরস্পর থেকে যতই বিচ্ছিন্ন হোক, তাদের হানাহানি অন্তত একটা সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনা সম্ভব; যদি আমরা শিশুদের কাছ থেকে কিছু শিখি।
লেখক : সম্পাদক, প্রকাশনা ও জনসংযোগ বিভাগ, ব্রি, গাজীপুর

No comments

Powered by Blogger.