আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-প্রতিরোধে অগ্নিগর্ভ সেই সময় by মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
এই মতো করে কথামুখের অবতারণা করা যাক- সৎ সচেতন দেশবাসী মাত্রেরই বিশ্বাস : 'একুশ' আমার অহংকার, 'একুশ' আমার ইতিহাস এবং সবটা মিলিয়ে আমার আপন আইডেনটিটি/আত্মপরিচিতি বাঙালিত্ব প্রতিফলিত এই প্রতীকী 'একুশে'তে। এমনতর উচ্চারণে অবশ্য আবেগ এসে মেশে। তবু কথাগুলোর জের টেনে বলব, এই আবেগ নিশ্চয় পূর্বোক্ত ওই গভীরের বিশ্বাস থেকে জাত এবং জাতির স্বার্থে অর্জিত সত্যের ঠিকানা এইখানে।
মনে করি, আজকের বিশেষ এই দিনে লগ্ন এসেছে, বারংবার আমরা আপন অর্জনের ওই মহৎ সত্যে দীক্ষা নেব। হেতু? জানান দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না যে এ কেমন সময়ে আমাদের বসবাস। সমাজকে অস্থির করে তোলার কিংবা রাখার এক অপক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। যারা একসময় এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, গণহত্যা করেছিল, তাদের বাঁচানোর অপপ্রয়াস আমাদের উদ্বিগ্ন করে। সবারই তো নিত্যকার অভিজ্ঞতা-অবক্ষয়ে গ্রাস করে নিচ্ছে মানুষের শুভ কল্যাণবোধ, তাবৎ ভালোত্ব; চারদিকজুড়ে কেবলই অস্থিরতা, অসহায়ত্ব আর কোনো কোনো মহলের প্রচণ্ড স্ববিরোধিতা। স্বভাবতই কথা আসবে, বাংলাদেশ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের চার দশকান্তেও এই কী নিয়তি তবে? জবাবের প্রয়োজনে সন্ধান করব- একদা তখন পাকিস্তানিত্বের গজবে আচ্ছন্ন পূর্বাঞ্চলের এই জনপদ; গ্রহণের সেই কালে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির 'একুশ' আমাদের জন্য আলোকের স্তম্ভ/ধ্রুবতারা হয়ে এসেছিল, 'একুশ' আমাদের আশার আর জীবনের মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিল, আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
কেমন দ্রুত আমরা বুঝে গিয়েছিলাম পাকিস্তানিত্বের আরেক নাম মধ্যযুগীয়তার অন্ধকারে প্রত্যাবর্তন, আবার যুগপৎ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ। হাজার-বার শ মাইলের ফারাকে করাচি-লাহোরে ওরা সিংহাসন প্রভু, সঙ্গে শেঠ বণিকী স্বার্থ এবং আমলা জোট, পাঞ্জাবি সমর সেনা, আর মৌলবাদ সবাই এক জোটে কাতার বেঁধেছিল। মতলব- ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের নামাঙ্করণে 'মাশরেকি পাকিস্তানের' সম্পদ লুণ্ঠন, বাসিন্দা সাত কোটি আদম সন্তানকে বন্দিদাসে অবনত রাখা। আর ঔপনিবেশিক সেই তাগিদে জরুরি হয়ে এসেছিল ভাষা আগ্রাসনের আধিপত্য। বাংলাভাষী আমাদের অদৃষ্টে সেটি এসেছিল 'কওমের' 'দ্বীনের' পবিত্রতার আর 'কওমি ইত্তেহাদের' নামে উর্দু জবানের আলখেল্লা চাপিয়ে। আসলে অবশ্য নিরীহ অন্য এক ভাষা মাত্র নয়; সেটি ছিল ভাষা আধিপত্যের অন্তরালে (পূর্বে যেমনটি বলা গেছে) ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন এবং সেখানে সর্বব্যাপী দখলকে মজবুত করা ইত্যাদির যত সব অপকর্ম সাধনের ফন্দি-ফিকির। পাকিস্তানি একচ্ছত্রাধিপতি 'কায়েদে আযম', 'কায়েদে মিল্লাত', সিপাহিশালার থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নবাব-খাজা গোষ্ঠী, নূরুল আমিন, ফজলুর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ কারা নয় তখন বাঙালি জনমানুষের মাতৃভাষার দুশমন শিবিরে!
আজকের অবকাশে স্মরণ করছি- আপন মাতৃভাষার অধিকার লড়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৪৮-৫২-তে আমাদের দিনগুলো। প্রতিরোধের অগ্নিগর্ভ সেই সময়। প্রসঙ্গত বলার যে এ স্মৃতিচারণা নয়, মোটেও স্পষ্টত উদ্দেশ্য বর্তমানের এবং বহমানতার তাগিদে 'সেই সময়ের' সঙ্গে সেতুবন্ধের প্রয়াস। অতএব প্রস্তাব যে এই দিনে আমরা আপন ইতিহাসের মুখোমুখি হব। নিজেদের সদা চেতন রাখার জন্য এবং একই সঙ্গে আরো যে বংশধর প্রজন্মের বর্তমান ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনে।
'জননী মাতা, স্বদেশ মাতৃভূমি এবং আপন উত্তরাধিকারে মাতৃভাষা'-এর অধিক আর নেই। পবিত্রতম এই সহজে সত্যকে কি ঘোষণা করে জানাতে হয়? নাড়ির বন্ধনে এ সত্যের অবস্থান। সৎ সন্তানের তা ইমানের অঙ্গ। এর পরও কিন্তু কথা রয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য, সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বার্থে, ঔপনিবেশিক স্বার্থে এবং আর্থ-রাজনৈতিক প্রয়োজনেই অক্টোপাস আগ্রাসনের বিস্তার ঘটানো হয়েছে কালে-কালান্তরে, দেশে-দেশান্তরে। আবার ইতিহাসই বলে দেয়, তেমনই অক্টোপাসের এক বিশেষ চেহারায় ভাষা-আগ্রাসন। যেমন কি না এর আগে উলি্লখিত হয়েছে ১৯৪৭ উত্তরকাল পর্বে আমাদের এতদঞ্চলে। ওই প্রচারের জুলুমের আছর- বাঙালির মাতৃভাষার ওপরে হামলা। এই সঙ্গে খেয়ালে আনব যে তাই থেকেই তো প্রতিরোধের সর্বাত্মক লড়াই দানা বেঁধে ওঠে এবং অবশ্যই আমাদের ক্ষেত্রে ১৯৪৮-৫২-এর ভাষা আন্দোলন।
খানিক তলিয়ে বুঝতে চাই। ভাষা-মাতৃভাষা বলতে শুধুই আক্ষরিক অর্থবাহী শব্দ বিশেষ নয়। গভীরে রয়েছে সেই ব্যঞ্জনা যে আসলে ভাষা মানুষের জন্য শক্তির ধারক। বিশেষ করে মাতৃভাষা একই এথনিক প্রজাতির মানুষকে এক বাঁধনে মেলায়, সত্যের বিশ্বাসে দায়বদ্ধ করে এবং শেষাবধি শৃঙ্খলমুক্তির সংগ্রামে অকুতোভয় উৎসর্গীপ্রাণ করে তোলে। প্রসঙ্গত এইখানে স্মরণ করছি- আমাদের আপন অভিজ্ঞতায় মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রতীক '৫২-র একুশের দীক্ষা। মোটামুটি এক ধরনের অর্জনের কিছু উদাহরণ এখানে উপস্থাপিত করতে চাই। তার দরুন খানিক হলেও আমরা মিলিয়ে নিতে সমর্থ হব। কেন অন্ধকার মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে ইউরোপেও কি তেমনটি ঘটেনি? দীর্ঘকাল ধরে ওই ভূখণ্ডজুড়ে মহামান্য পোপ-পৃষ্ঠপোষকতায় যে রোমান লাতিন ভাষা সাম্রাজ্যের আধিপত্য, বিরোধিতায় মাথা তুলেছিল মার্টিন লুথারের জার্মানি আর দেশাঞ্চল। মাতৃভাষার অবলম্বনে আপন আপন স্বাতন্ত্র্যের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ অভ্যুদয় সাধিত হয়েছিল।
এদিকে এশিয়ায় আরেক নজির- তারও আগে দশম শতাব্দী নাগাদ মুসলিম ইরাকের কথা। সে দেশে আরবি ভাষা আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে দেশজ মাতৃভাষা ফরাসি আপন মহিমায় স্বাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। ফেরদৌসীর এপিক কাব্য 'শাহনামা'য় রয়েছে তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। আর বিশেষ শতকের প্রথম পর্বে কামাল আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্ক। ভাষার প্রশ্নে কামালের নেতৃত্বে কী অর্জন করেছিল ইয়ং টার্কস?- আর নয় অটোম্যান এম্পায়ার আমলের বিদেশি ভাষার আরবি। পরিবর্তে অবলম্বনের আশ্রয় স্বাদেশিকতার ঐতিহ্যবাহী মাতৃভাষা তুর্কি এবং হরফ সেমেটিককে সরিয়ে দিয়ে অবলম্বন আন্তর্জাতিক রোমান। অতঃপর এখন প্রসঙ্গতই বলার যে আগ্রাসী পাকিস্তানত্বকে হটানোর নিশানায় বাঙালিত্বের লড়াইয়ে প্রতীকী 'একুশে' আমাদের জন্য হাতিয়ার হয়ে এসেছিল। আমরা জয়ী হয়েছিলাম। আজকের এই অবকাশে পূতপবিত্র কণ্ঠে আমাদের উচ্চারণ- সেই বায়ান্নতে এসেছিল ফেব্রুয়ারি 'একুশ' এবং অবশ্য তা থেমে থাকেনি। তারই অনিবার্য বহমানতায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, দেশের মুক্ত মানুষ, কোটি বাঙালি। অতঃপর যোগ করব, আরো কেমনতর ব্যতিক্রমী অনন্য মহৎ অর্জন আমাদের- বাংলাদেশ বাঙালির 'একুশ' ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা-মহিমায় উত্তরিত।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments