আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের লড়াই by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের বিজয় নিশান; প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রবৃত্তির ওপর মানুষের জয়ের চিহ্ন। কিন্তু কেবল চিহ্ন বললে কিছুই বলা হয় না, কেননা সংস্কৃতি সব সময়ই অত্যন্ত জীবন্ত ও পরিব্যাপ্ত। অনেকটা পানির মতো, সহজ কিন্তু শক্তিশালী, থাকলে বোঝা যায় না, না থাকলে প্রাণ সংশয় দেখা দেয়।
তাই বলা যাবে যে সংস্কৃতি শিক্ষার চেয়েও ব্যাপ্ত ও জরুরি। সংস্কৃতির স্তর দেখে মনুষ্যত্বের স্তর জানা যায়। এও জানা আমাদের যে মানুষেরই সংস্কৃতি আছে, পশুর নেই।
বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন ছিল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। এ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের অভ্যুত্থান। মানুষ তার অধিকার চেয়েছে, ভাষার অধিকারই আপাতত, কিন্তু ডালিমের ভেতর যেমন অনেক অংশ থাকে, ওই দাবির অভ্যন্তরে তেমনি অনেক দাবি ছিল। মূল বিষয়টি ছিল সংস্কৃতি; সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের জন্যই রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে। শুধুই যদি রাজনৈতিক আন্দোলন হতো, তবে সরকার পরিবর্তন কিংবা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে তার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত। ঘটেনি। অন্যতম নয়, একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হওয়ার পরও একুশের আন্দোলন থামেনি। থামেনি, কেননা সংস্কৃতি এখনো মুক্ত ও উন্নত হয়নি। মনুষ্যত্ব আজও নিরাপদ নয়।
সংস্কৃতির মুখ্য শত্রু কে ছিল সেদিন? ছিল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র একগুচ্ছ শক্তির সমষ্টি, সে ছিল ভয়াবহ, ভয়ংকর, সম্পূর্ণ বৈরী। জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন, উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তাঁর বাঙালি ভক্তদের কেউ কেউ এখন বলেন, শুনছি পরে নাকি তিনি দুঃখ করেছিলেন ও-কথা বলার জন্য। তা তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাও ভুল হয়েছে বলে অন্তিম শয্যায় মন্তব্য করেছিলেন বলে শোনা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অবশ্য অন্য ব্যাপার, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে উর্দু এবং কেবল উর্দুই হবে, এই বক্তব্যে ভ্রান্তি কোথায়? পাকিস্তান ছিল একটি শোষণভিত্তিক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সেখানে ক্ষমতাসীন অবাঙালিরা বাঙালিদের নিগৃহীত করবে- এটাই ছিল স্বাভাবিক। মোড়কটা ছিল ধর্মীয়, অভিপ্রায়টি নিষ্ঠুররূপে বৈষয়িক। শোষণের প্রয়োজনেই উর্দুকে চাপাতে চেয়েছে, নিষ্পিষ্ট করতে চেয়েছে বাঙালির সংস্কৃতিকে। সংস্কৃতিকে কাবু করতে পারলে মানুষকে বশে রাখা সহজ।
এ দেশের মানুষের জন্য রাষ্ট্র কখনোই মিত্রপক্ষ ছিল না, সব সময়ই ছিল শত্রুপক্ষ। রাষ্ট্রের সেই বৈরী চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে ভাষার মধ্য দিয়েই। জনগণের ভাষা সব সময়ই বাংলা, শাসকদের ভাষা কখনো সংস্কৃত, কখনো ফারসি। দীর্ঘকাল ছিল ইংরেজি, পাকিস্তানিরা চাইল চাপাতে উর্দু। উর্দুর পক্ষে কেবল জিন্নাহ বলেননি, ঢাকার নাজিমুদ্দিন বলেছেন, এমনকি সোহরাওয়ার্দীও বলেছিলেন একটি বিবৃতিতে, কোনো কোনো বাঙালিও বলেছে, বলতে হয়েছে, কেননা এরা সবাই ছিলেন পাকিস্তানি রাষ্ট্রের আদর্শে বিশ্বাসী। জনগণ মানেনি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টায় রাষ্ট্রের চেহারাটি প্রকাশ হয়ে গেল। ধর্মের পোশাক আর কাজ দিল না। বাঙালি বিদ্রোহ ঘোষণা করল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। বায়ান্নতে শুরু, তারপর ধাপে ধাপে এগিয়েছে, এসেছে ঊনসত্তর, এলো একাত্তর। একাত্তরের যুদ্ধ অনেক বেশি প্রচণ্ড ও রক্তাক্ত, কিন্তু সূচনা বায়ান্নতেই, একাত্তর বায়ান্নরই স্বাভাবিক পরিণতি।
ভাষা আন্দোলনের শক্তি এলো কোথা থেকে? এলো তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা থেকে। ভাষা শ্রেণী মানে না, সম্প্রদায়ের বেষ্টনীতে আবদ্ধ থাকে না। অঞ্চল পার হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর পেশাগত আন্দোলন হয়েছে। আটচলি্লশে পুলিশ ধর্মঘট হয়েছিল। যাদের ওপর নৃশংসরূপে আক্রমণ করেছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু সে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করেনি। এখানে ধর্মঘটও হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় কৃষকদের ছোট ছোট অভ্যুত্থান ঘটেছে, কিন্তু কোনোটিই ভাষা আন্দোলনের মতো সাড়া জাগায়নি। কারণ অন্য কোনো আন্দোলন দেশের সব মানুষের অভ্যুত্থান ছিল না, যেমনটি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। এত যে প্রাণ ছিল এর, সে-ই বা এলো কোথা থেকে? এলো এর আপসহীনতা থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের মতোই, এই আন্দোলনে পরাজয়ের কোনো স্থান ছিল না। পরাজয় মানেই মৃত্যু- মনুষ্যত্বের জন্য, মানবিক সংস্কৃতির জন্য। সংস্কৃতির শক্তি প্রমাণিত হয়েছে, পুরাতন রাষ্ট্র পরাজিত হয়েছে সংস্কৃতির কাছে। ভাষার মতো ইহজাগতিক সত্য কম আছে। ভাষা মানুষই সৃষ্টি করে, মানুষের প্রয়োজনে ভাষা ঐক্যবদ্ধ করে মানুষকে, সেও মানুষের প্রয়োজনেই।
রাষ্ট্র ভেঙেছে। কিন্তু বাংলা প্রচলিত হয়েছে কি জীবনের সর্বক্ষেত্রে? হয়নি। লেখাপড়া যারা শিখছে, তারা যে সমাজের দরিদ্র অংশের অন্তর্গত নয়, তাও বাস্তব সত্য। ওদিকে ইংরেজি শেখার জন্য এখন যে উৎসাহ জাজ্বল্যমান তেমনটি অন্য কোনো স্বাধীন দেশে আজ দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইংরেজি শেখার আগ্রহ যে কেবল ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নয়, কম বিত্তবানরাও শিখতে চায় এবং শিখতে না পেরে নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। এ দেশে একটি বুর্জোয়া বিকাশ অবশ্যই ঘটেছে, বেশ কিছু লোক ধনী হয়েছে, দরিদ্র দেশ আরো দরিদ্র হচ্ছে এদের পুষতে গিয়ে, কিন্তু এরা বাংলা ভাষার জন্য মিত্রের কাজ করছে না।
সংস্কৃতির দুই ধারা তখনো ছিল, এখনো আছে। বড় ধারাটাই প্রতিক্রিয়াশীল। ওই প্রবাহ পুষ্ট হচ্ছে পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের যৌথ তৎপরতায়। মানুষ নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবছে না, পারছে না ভাবতে। ব্যক্তিগত মুনাফা ছাড়া অন্য কিছুকে বিবেচনায় আনা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিপরীত ধারাটি হলো ভাষা আন্দোলনের। এই ধারা আত্মসমর্পণের নয়, বিদ্রোহের। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সংস্কৃতির অপর ধারার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান। এই ধারা জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতা তো অবশ্যই, যথার্থ অর্থেই গণতান্ত্রিক এবং অভীপ্সায় সমাজতান্ত্রিক। এ চায় মানুষের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত করতে মৈত্রীর বন্ধনে এবং একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশে। এই প্রবাহ যেমন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়বে, তেমনি ছিন্ন করবে সামন্তবাদের নির্মম দুঃশাসন। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কোনো তুলনা নেই। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ শ্রেণীবৈষম্য। ওই বৈষম্য শতকরা ৯৫ জন লোককে মনুষ্যত্বহীনতার নানা স্তরে রেখে দিয়েছে, যার ফলে এই মানুষেরা উৎপাদন বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য অপনোদনের কাজে অংশ নিতে পারছে না। মানুষের সৃষ্টিশীলতা পঙ্গু হয়ে পড়ে রয়েছে। সৃষ্টির সেই ক্ষমতাকে মুক্ত না করে আমরা কিছুতেই এগোতে পারব না। এবং সেই ক্ষমতা কিছুতেই মুক্ত হবে না, যদি না বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে একটা শ্রেণী-শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলা যায়। ভাষা আন্দোলন এ কথাটাই বলছে।
সংস্কৃতির গুরুত্বের কথাটা আবারও স্মরণ করা যাক। একজন লোক রাস্তায় মাতলামি করবে নাকি ঘরে বসে ভালো গান শুনবে, এটি কোনো নৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্ত বটে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা সত্য, সমষ্টির ক্ষেত্রেও তাই সত্য। সিদ্ধান্ত ব্যক্তি নিজে নেয় এমনও বলা যাবে না, ব্যবস্থাই নিয়ে নেয়, ব্যক্তির জন্য। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আজ যদি কোনো সংকট দেখা দিয়ে থাকে, তবে সেও ওই সংস্কৃতির কারণেই। আমার নিজের পায়ে কোনো ভালো জুতো নেই দেখে কাতর হব, নাকি অন্য সবার পায়ের অবস্থা কি তার বিচার করব- এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন, ওই সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির। সমাজতন্ত্র কয়েকজনের উৎকৃষ্ট পাদুকা উৎপাদন করার পরিবর্তে সবার জন্য প্রয়োজনে নিম্নমানের হলেও পাদুকার ব্যবসা করতে চায়। পুঁজিবাদের সঙ্গে এখানেই তার মৌলিক ব্যবধান, কেবল উৎপাদন নয়, সমবণ্টনেও সে সমানভাবে বিশ্বাসী। সমাজতান্ত্রিক সমাজ যদি তার এই সাংস্কৃতিক উৎকর্ষকে অবহেলা করে, পণ্য তৈরির মাপকাঠিতে নিজেকে বিচারের জন্য হাজির করে, তাহলে তাকে পশ্চাদপদ বলা খুবই সহজ হবে, হচ্ছেও। তখন আওয়াজ উঠবে তথাকথিত আধুনিকীকরণের, উঠছেও। যে ব্যর্থতার কথা আজ খুব বড় করে প্রচার করা হচ্ছে, সে ব্যর্থতা সমাজতন্ত্রের নয়। সমাজতন্ত্রীদের বটে, এবং তা মূলত সাংস্কৃতিক, অন্য সবকিছুর আগে। আমরা জানি যে কত রকম নিপীড়ন আছে তার মধ্যে ভাষার নিপীড়নই সবচেয়ে গভীর। বৈষয়িক সম্পদ কেড়ে নিলে তা ফেরত পাওয়ার আশা থাকে, ভাষা কেড়ে নিলে ফেরত পাওয়া বড় কঠিন, আর যে ভাষা চেপে বসে অবনত মানুষের চেতনায়, সে এমন এক ধরনের হীনমন্যতা সৃষ্টি করে যাতে মুক্তির কথা ভাবাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। বিপরীত ও মানবিক স্রোতটিকে সে শক্তিশালী করেছে। তার অর্জন সামান্য নয়। সে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। সাংস্কৃতিক জীবনের নানা ক্ষেত্রে নতুন নতুন সৃষ্টিকর্মকে সম্ভব করে তুলেছে। রাজনীতিতে এসেছে জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিকতার নতুন চাঞ্চল্য। সব মিলিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনারই নাম। তবু যা করেছে, তার চেয়ে যা করতে চায়, তার পরিমাণ বিপুলতর। কেননা সে চায় একটি স্বাধীন, উন্নত ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে। সেই সংস্কৃতিতে বাংলাভাষা সবার ভাষা হবে, অশিক্ষা থাকবে না, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থমকে যাবে দরজার সামনে, সামন্তবাদী পিছুটান বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, মানুষ মানুষের মিত্র হবে, শত্রু না হয়ে।
ভাষা আন্দোলন ও সংস্কৃতির মুক্তি আন্দোলন এক ও অভিন্ন। সাংস্কৃতিকভাবে আমরা যত এগোবো, আমাদের সংস্কৃতি যত বেশি মানবিক হবে, ভাষা আন্দোলনও ততটাই চরিতার্থতা পাবে। হানাদাররা একাত্তরে শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছিল। শহীদ মিনার কেবল জয়ের স্তম্ভ নয়, সম্ভাবনারও প্রতীক। সে বলছে যে মানুষ আপস করবে না এবং নব নব বিজয় অর্জন করবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন ছিল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। এ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের অভ্যুত্থান। মানুষ তার অধিকার চেয়েছে, ভাষার অধিকারই আপাতত, কিন্তু ডালিমের ভেতর যেমন অনেক অংশ থাকে, ওই দাবির অভ্যন্তরে তেমনি অনেক দাবি ছিল। মূল বিষয়টি ছিল সংস্কৃতি; সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের জন্যই রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে। শুধুই যদি রাজনৈতিক আন্দোলন হতো, তবে সরকার পরিবর্তন কিংবা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে তার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত। ঘটেনি। অন্যতম নয়, একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হওয়ার পরও একুশের আন্দোলন থামেনি। থামেনি, কেননা সংস্কৃতি এখনো মুক্ত ও উন্নত হয়নি। মনুষ্যত্ব আজও নিরাপদ নয়।
সংস্কৃতির মুখ্য শত্রু কে ছিল সেদিন? ছিল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র একগুচ্ছ শক্তির সমষ্টি, সে ছিল ভয়াবহ, ভয়ংকর, সম্পূর্ণ বৈরী। জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন, উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তাঁর বাঙালি ভক্তদের কেউ কেউ এখন বলেন, শুনছি পরে নাকি তিনি দুঃখ করেছিলেন ও-কথা বলার জন্য। তা তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাও ভুল হয়েছে বলে অন্তিম শয্যায় মন্তব্য করেছিলেন বলে শোনা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অবশ্য অন্য ব্যাপার, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে উর্দু এবং কেবল উর্দুই হবে, এই বক্তব্যে ভ্রান্তি কোথায়? পাকিস্তান ছিল একটি শোষণভিত্তিক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সেখানে ক্ষমতাসীন অবাঙালিরা বাঙালিদের নিগৃহীত করবে- এটাই ছিল স্বাভাবিক। মোড়কটা ছিল ধর্মীয়, অভিপ্রায়টি নিষ্ঠুররূপে বৈষয়িক। শোষণের প্রয়োজনেই উর্দুকে চাপাতে চেয়েছে, নিষ্পিষ্ট করতে চেয়েছে বাঙালির সংস্কৃতিকে। সংস্কৃতিকে কাবু করতে পারলে মানুষকে বশে রাখা সহজ।
এ দেশের মানুষের জন্য রাষ্ট্র কখনোই মিত্রপক্ষ ছিল না, সব সময়ই ছিল শত্রুপক্ষ। রাষ্ট্রের সেই বৈরী চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে ভাষার মধ্য দিয়েই। জনগণের ভাষা সব সময়ই বাংলা, শাসকদের ভাষা কখনো সংস্কৃত, কখনো ফারসি। দীর্ঘকাল ছিল ইংরেজি, পাকিস্তানিরা চাইল চাপাতে উর্দু। উর্দুর পক্ষে কেবল জিন্নাহ বলেননি, ঢাকার নাজিমুদ্দিন বলেছেন, এমনকি সোহরাওয়ার্দীও বলেছিলেন একটি বিবৃতিতে, কোনো কোনো বাঙালিও বলেছে, বলতে হয়েছে, কেননা এরা সবাই ছিলেন পাকিস্তানি রাষ্ট্রের আদর্শে বিশ্বাসী। জনগণ মানেনি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টায় রাষ্ট্রের চেহারাটি প্রকাশ হয়ে গেল। ধর্মের পোশাক আর কাজ দিল না। বাঙালি বিদ্রোহ ঘোষণা করল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। বায়ান্নতে শুরু, তারপর ধাপে ধাপে এগিয়েছে, এসেছে ঊনসত্তর, এলো একাত্তর। একাত্তরের যুদ্ধ অনেক বেশি প্রচণ্ড ও রক্তাক্ত, কিন্তু সূচনা বায়ান্নতেই, একাত্তর বায়ান্নরই স্বাভাবিক পরিণতি।
ভাষা আন্দোলনের শক্তি এলো কোথা থেকে? এলো তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা থেকে। ভাষা শ্রেণী মানে না, সম্প্রদায়ের বেষ্টনীতে আবদ্ধ থাকে না। অঞ্চল পার হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর পেশাগত আন্দোলন হয়েছে। আটচলি্লশে পুলিশ ধর্মঘট হয়েছিল। যাদের ওপর নৃশংসরূপে আক্রমণ করেছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু সে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করেনি। এখানে ধর্মঘটও হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় কৃষকদের ছোট ছোট অভ্যুত্থান ঘটেছে, কিন্তু কোনোটিই ভাষা আন্দোলনের মতো সাড়া জাগায়নি। কারণ অন্য কোনো আন্দোলন দেশের সব মানুষের অভ্যুত্থান ছিল না, যেমনটি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। এত যে প্রাণ ছিল এর, সে-ই বা এলো কোথা থেকে? এলো এর আপসহীনতা থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের মতোই, এই আন্দোলনে পরাজয়ের কোনো স্থান ছিল না। পরাজয় মানেই মৃত্যু- মনুষ্যত্বের জন্য, মানবিক সংস্কৃতির জন্য। সংস্কৃতির শক্তি প্রমাণিত হয়েছে, পুরাতন রাষ্ট্র পরাজিত হয়েছে সংস্কৃতির কাছে। ভাষার মতো ইহজাগতিক সত্য কম আছে। ভাষা মানুষই সৃষ্টি করে, মানুষের প্রয়োজনে ভাষা ঐক্যবদ্ধ করে মানুষকে, সেও মানুষের প্রয়োজনেই।
রাষ্ট্র ভেঙেছে। কিন্তু বাংলা প্রচলিত হয়েছে কি জীবনের সর্বক্ষেত্রে? হয়নি। লেখাপড়া যারা শিখছে, তারা যে সমাজের দরিদ্র অংশের অন্তর্গত নয়, তাও বাস্তব সত্য। ওদিকে ইংরেজি শেখার জন্য এখন যে উৎসাহ জাজ্বল্যমান তেমনটি অন্য কোনো স্বাধীন দেশে আজ দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইংরেজি শেখার আগ্রহ যে কেবল ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নয়, কম বিত্তবানরাও শিখতে চায় এবং শিখতে না পেরে নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। এ দেশে একটি বুর্জোয়া বিকাশ অবশ্যই ঘটেছে, বেশ কিছু লোক ধনী হয়েছে, দরিদ্র দেশ আরো দরিদ্র হচ্ছে এদের পুষতে গিয়ে, কিন্তু এরা বাংলা ভাষার জন্য মিত্রের কাজ করছে না।
সংস্কৃতির দুই ধারা তখনো ছিল, এখনো আছে। বড় ধারাটাই প্রতিক্রিয়াশীল। ওই প্রবাহ পুষ্ট হচ্ছে পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের যৌথ তৎপরতায়। মানুষ নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবছে না, পারছে না ভাবতে। ব্যক্তিগত মুনাফা ছাড়া অন্য কিছুকে বিবেচনায় আনা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিপরীত ধারাটি হলো ভাষা আন্দোলনের। এই ধারা আত্মসমর্পণের নয়, বিদ্রোহের। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সংস্কৃতির অপর ধারার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান। এই ধারা জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতা তো অবশ্যই, যথার্থ অর্থেই গণতান্ত্রিক এবং অভীপ্সায় সমাজতান্ত্রিক। এ চায় মানুষের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত করতে মৈত্রীর বন্ধনে এবং একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশে। এই প্রবাহ যেমন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়বে, তেমনি ছিন্ন করবে সামন্তবাদের নির্মম দুঃশাসন। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কোনো তুলনা নেই। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ শ্রেণীবৈষম্য। ওই বৈষম্য শতকরা ৯৫ জন লোককে মনুষ্যত্বহীনতার নানা স্তরে রেখে দিয়েছে, যার ফলে এই মানুষেরা উৎপাদন বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য অপনোদনের কাজে অংশ নিতে পারছে না। মানুষের সৃষ্টিশীলতা পঙ্গু হয়ে পড়ে রয়েছে। সৃষ্টির সেই ক্ষমতাকে মুক্ত না করে আমরা কিছুতেই এগোতে পারব না। এবং সেই ক্ষমতা কিছুতেই মুক্ত হবে না, যদি না বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে একটা শ্রেণী-শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলা যায়। ভাষা আন্দোলন এ কথাটাই বলছে।
সংস্কৃতির গুরুত্বের কথাটা আবারও স্মরণ করা যাক। একজন লোক রাস্তায় মাতলামি করবে নাকি ঘরে বসে ভালো গান শুনবে, এটি কোনো নৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্ত বটে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা সত্য, সমষ্টির ক্ষেত্রেও তাই সত্য। সিদ্ধান্ত ব্যক্তি নিজে নেয় এমনও বলা যাবে না, ব্যবস্থাই নিয়ে নেয়, ব্যক্তির জন্য। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আজ যদি কোনো সংকট দেখা দিয়ে থাকে, তবে সেও ওই সংস্কৃতির কারণেই। আমার নিজের পায়ে কোনো ভালো জুতো নেই দেখে কাতর হব, নাকি অন্য সবার পায়ের অবস্থা কি তার বিচার করব- এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন, ওই সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির। সমাজতন্ত্র কয়েকজনের উৎকৃষ্ট পাদুকা উৎপাদন করার পরিবর্তে সবার জন্য প্রয়োজনে নিম্নমানের হলেও পাদুকার ব্যবসা করতে চায়। পুঁজিবাদের সঙ্গে এখানেই তার মৌলিক ব্যবধান, কেবল উৎপাদন নয়, সমবণ্টনেও সে সমানভাবে বিশ্বাসী। সমাজতান্ত্রিক সমাজ যদি তার এই সাংস্কৃতিক উৎকর্ষকে অবহেলা করে, পণ্য তৈরির মাপকাঠিতে নিজেকে বিচারের জন্য হাজির করে, তাহলে তাকে পশ্চাদপদ বলা খুবই সহজ হবে, হচ্ছেও। তখন আওয়াজ উঠবে তথাকথিত আধুনিকীকরণের, উঠছেও। যে ব্যর্থতার কথা আজ খুব বড় করে প্রচার করা হচ্ছে, সে ব্যর্থতা সমাজতন্ত্রের নয়। সমাজতন্ত্রীদের বটে, এবং তা মূলত সাংস্কৃতিক, অন্য সবকিছুর আগে। আমরা জানি যে কত রকম নিপীড়ন আছে তার মধ্যে ভাষার নিপীড়নই সবচেয়ে গভীর। বৈষয়িক সম্পদ কেড়ে নিলে তা ফেরত পাওয়ার আশা থাকে, ভাষা কেড়ে নিলে ফেরত পাওয়া বড় কঠিন, আর যে ভাষা চেপে বসে অবনত মানুষের চেতনায়, সে এমন এক ধরনের হীনমন্যতা সৃষ্টি করে যাতে মুক্তির কথা ভাবাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। বিপরীত ও মানবিক স্রোতটিকে সে শক্তিশালী করেছে। তার অর্জন সামান্য নয়। সে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। সাংস্কৃতিক জীবনের নানা ক্ষেত্রে নতুন নতুন সৃষ্টিকর্মকে সম্ভব করে তুলেছে। রাজনীতিতে এসেছে জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিকতার নতুন চাঞ্চল্য। সব মিলিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনারই নাম। তবু যা করেছে, তার চেয়ে যা করতে চায়, তার পরিমাণ বিপুলতর। কেননা সে চায় একটি স্বাধীন, উন্নত ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে। সেই সংস্কৃতিতে বাংলাভাষা সবার ভাষা হবে, অশিক্ষা থাকবে না, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থমকে যাবে দরজার সামনে, সামন্তবাদী পিছুটান বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, মানুষ মানুষের মিত্র হবে, শত্রু না হয়ে।
ভাষা আন্দোলন ও সংস্কৃতির মুক্তি আন্দোলন এক ও অভিন্ন। সাংস্কৃতিকভাবে আমরা যত এগোবো, আমাদের সংস্কৃতি যত বেশি মানবিক হবে, ভাষা আন্দোলনও ততটাই চরিতার্থতা পাবে। হানাদাররা একাত্তরে শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছিল। শহীদ মিনার কেবল জয়ের স্তম্ভ নয়, সম্ভাবনারও প্রতীক। সে বলছে যে মানুষ আপস করবে না এবং নব নব বিজয় অর্জন করবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments