মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-‘সাঈদী চিনিয়ে দিলে পাকিস্তানি সেনারা মিজানুরকে হত্যা করে’

একাত্তরের ৫ মে পিরোজপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমানকে পাকিস্তানি সেনাদের চিনিয়ে দেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। পরে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকেসহ তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও ব্রাশফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে।


জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ২৭তম সাক্ষী সাঈফ হাফিজুর রহমান (৬৫) গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দিতে এ কথা বলেন। তিনি সাঈফ মিজানুর রহমানের ভাই এবং নড়াইল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ।
সকালে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সাঈফ হাফিজুরের জবানবন্দি নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী। সাঈদীকে কারাগার থেকে এ সময় ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
সাঈফ হাফিজুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, ’৭০-৭১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তাঁর ভাই সাঈফ মিজানুর রহমান তৎকালীন পিরোজপুর সাব-ডিভিশনের ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। ওই সময় পিরোজপুরের ভারপ্রাপ্ত এসডিও (সাব-ডিভিশনাল অফিসার) ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং এসডিপিও (সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার) ছিলেন ফয়জুর রহমান আহমেদ (কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাবা)। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক ছিলেন এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছিলেন। তাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেজারি থেকে অস্ত্র বের করে দিয়েছিলেন। এই খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর ভাইসহ ওই তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। সেনাদের সঙ্গে ছিলেন সাঈদী ও রাজাকার আবদুল মন্নাফ। সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের মিজানুর রহমানকে চিনিয়ে দেন, তবে তিনি গাড়িতে বসে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের তিনজনকে গাড়িতে উঠিয়ে বলেশ্বর নদের পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে প্রথমে তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও পরে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। হত্যার আগে মিজানুরকে পাকিস্তানি সেনারা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলার নির্দেশ দিলেও তিনি বলেন ‘জয় বাংলা’।
হাফিজুর আরও বলেন, ভাইকে হত্যার খবর পেয়ে তিনি, তাঁর বাবা ও ছোট বোন নড়াইল থেকে খুলনায় গিয়ে ভাবির কাছে হত্যার বিবরণ শোনেন এবং পরে পিরোজপুরে যান। সেখানে গিয়ে তিনি সৈয়দ মো. খান বাহাদুর আফজাল ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে ভাইকে হত্যার ঘটনার বিস্তারিত জানেন। তিনি জানতে পারেন, তাঁর ভাইয়ের হত্যাসহ পিরোজপুরে হত্যা, লুট, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দেলোয়ার হোসেন জড়িত। পরে তিনি জেনেছেন ওই দেলোয়ার হোসেন বর্তমানের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
জবানবন্দি শেষে হাফিজুরকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। মিজানুল প্রশ্ন করেন, খান বাহাদুর আফজালের নেতৃত্বে ৭ মে পিরোজপুরে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল কি না? জবাবে হাফিজুর বলেন, এর আগেই শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শান্তি কমিটি গঠনসংক্রান্ত পত্রিকার কোনো সংবাদ তিনি দেখেননি, লোকমুখে শুনেছেন। একাত্তরের এপ্রিলের শেষ দিকে পিরোজপুরে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল।
ফয়জুর রহমানের স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ স্বাধীনতার পর স্বামীসহ তিনজনকে হত্যার ঘটনায় পিরোজপুর থানায় মামলা করেছিলেন, তা তিনি জানেন কি না—মিজানুলের এই প্রশ্নের জবাবে হাফিজুর বলেন, এটি তাঁর জানা নেই। মিজানুল বলেন, নড়াইল আইনজীবী সমিতির সভাপতি থাকা অবস্থায় হাফিজুর এলাকার আদিবাসীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করিয়েছিলেন। জবাবে হাফিজুর বলেন, এটা সত্য নয়। এই পর্যায়ে মিজানুল বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই প্রথম আলোয় এ নিয়ে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। ওই সংবাদের কোনো প্রতিবাদ তিনি করেননি। জবাবে হাফিজুর বলেন, প্রতিবাদ পাঠানো হলেও ছাপা হয়নি। পরের প্রশ্নের জবাবে হাফিজুর বলেন, প্রতিবাদ ছাপা না হলেও তিনি কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেননি।
শেষ দিকে হাফিজুরকে জেরা করেন আইনজীবী মনজুর আহমেদ আনসারী। ২২ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.