কল্পকথার গল্প-'এ রোগেরও ওষুধ আছে' by আলী হাবিব

বাঙালি মধ্যবিত্তের অনেক সমস্যা। সমস্যা না থাকলে সমস্যা তৈরি করে নিতে বাঙালি মধ্যবিত্তের জুড়ি নেই। সমস্যা থাকলে সেটা কচলাতে ভালো লাগে। এটা মধ্যবিত্তের গুণ। অন্যের ত্রুটি খুঁজে বেড়ানো যাদের অভ্যাস, তাদের মতে এটাই নাকি মধ্যবিত্তের দোষ। অনেক কিছু নিয়েই মধ্যবিত্তের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ত্রুটি একটা পেলেই হলো।


মধ্যবিত্ত সেটা ছাড়বে না। কচলে ছেড়ে দেবে। আন্দাজে ঢিল ছুড়বে। এই মধ্যবিত্তের অভিযোজন ক্ষমতা আবার অসাধারণ। পরিবর্তিত যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে মধ্যবিত্ত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তার পরও বাঙালি মধ্যবিত্তকে হতাশায় পেয়ে বসে। হতাশার ভেতর থেকেও আশার আলো দেখে। 'ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন' দেখার ব্যাপারে বাঙালি মধ্যবিত্তের জুড়ি নেই। আজ যে দিনটি গেল, কালকের দিনটি এর চেয়ে অনেক ভালো কাটবে- এমন আশা করে বলেই আজও টিকে আছে মধ্যবিত্ত। এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা। তাই বলে কি ক্ষোভের প্রকাশ ঘটবে না? ক্ষোভের প্রকাশও ঘটে। এই ক্ষোভ ও হতাশা থেকে ফেডআপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন আমাদের অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে একদম ফেডআপ হয়েছেন। দুষ্টু শেয়ারবাজার তাঁকে ফেডআপ করেছে।
বাঙালি যখন যে জিনিসটাকে দেখে একেবারে দেখেই ছাড়ে। কোনো কিছু অর্ধেক দেখবে না। একবার ছুড়ে ফেললে আর টেনে তুলবে না। একবার টেনে তুললে সহজে ছাড়তে চাইবে না। সিনেমা খুব ভালো লাগার ব্যাপার ছিল বাঙালির। এখন একসঙ্গে খরচ করার মতো অত সময় নেই। তাই রেশনিংয়ের ব্যবস্থা। এখন চলছে সিরিয়ালের যুগ। ঘরে ঢুকে রিমোট নিয়ে বসে যাওয়া। এটা ভালো না লাগলে ওটাতে চলে যাওয়া। অনেকটা আধাখেঁচড়া ব্যাপার। আগের পর্বে কী হয়েছে দেখে দিনের পর্ব দেখা। আগামী পর্বে কী থাকছে, সেটা দেখে পরের দিনের রুটিন ঠিক করে নেওয়া। এসব দেখতে দেখতে আবার একসময় হতাশায় যে পেয়ে বসবে না, তা কে জানে। হতাশা জিনিসটা খুব বাজে একটা ব্যাপার। একবার পেয়ে বসলে সহজে ছাড়তে চায় না। তখন বাঙালি ফেডআপ হয়ে যায়। অবশ্য ব্যাপারটা খুব সাময়িক। অভিযোজনে দক্ষ বাঙালি চট করেই খাপ খাইয়ে নেয়। আমাদের অর্থমন্ত্রী যেমন দুষ্টু শেয়ারবাজার নিয়ে ফেডআপ হলেও বলে দিয়েছেন এর ওষুধ আছে। না থাকার কথা নয়। সময়মতো সেটা তিনি নিশ্চয়ই বের করবেন। অর্থমন্ত্রী কি ধন্বন্তরি? তাঁর কাছে কি মকরধ্বজ আছে?
ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলা যাক। ধন্বন্তরি শব্দটি আমরা হামেশাই ব্যবহার করে থাকি। এটি পুরাণের একটি চরিত্র। ইনি দেবতাদের চিকিৎসক বা দৈকবৈদ্য। তাঁর একটি ইতিহাস আছে। বলা হয়ে থাকে, প্রথমে ব্রহ্মা সহস্র অধ্যায় ও লক্ষ শ্লোকযুক্ত আযুর্বেদ প্রকাশ করেন। তাঁর কাছ থেকে এই বিদ্যা শিখে নেন প্রজাপতি। প্রজাপতির কাছ থেকে এই জ্ঞান অর্জন করেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়। তাঁদের কাছ থেকে ইন্দ্র এবং ইন্দ্রের কাছ থেকে ধন্বন্তরি এই শিক্ষা লাভ করেন। ব্রহ্মার নির্দেশে তিনি আয়ুর্বেদকে আট ভাগে ভাগ করেছিলেন। অব্যর্থ ওষুধ কোনো চিকিৎসক দিলে আমরা সেটাকে বলি ধন্বন্তরি। দুষ্টু পুঁজিবাজারের রোগ নিরাময়ে আমাদের অর্থমন্ত্রী ধন্বন্তরির ভূমিকা নিলে আখেরে তার ফল ভালো ছাড়া কি মন্দ হবে? কিন্তু ওষুধটা কী? মকরধ্বজ? বাংলায় প্রবাদ আছে, 'মরার আগে মকরধ্বজ'। এ বিষয়টি বিস্তারিত বলার চেষ্টা করা যাক। মকর হচ্ছে এক ধরনের কবিরাজি ওষুধ। পারদ ও গন্ধক নাকি এর প্রধান উপকরণ। বলা হয়ে থাকে, এই ওষুধ সর্বরোগহর। মানুষের মঙ্গলের জন্য এই ওষুধ নাকি মহাদেব স্বয়ং আবিষ্কার করেছিলেন। শাস্ত্রভেদে মকরধ্বজ তৈরির ভিন্ন ভিন্ন ফর্মুলা আছে। আমাদের অর্থমন্ত্রীর কাছেও নিশ্চয়ই পুঁজিবাজারের দুষ্টুমি রোগ সারাতে নিজস্ব ফর্মুলা আছে। সেই ফর্মুলা মেনে ওষুধ দিয়ে পুঁজিবাজারের দুষ্টুমি না হয় দূর করা গেল, কিন্তু ফেডআপের কী হবে?
মানুষ কখন ফেডআপ হয়? যখন তার স্বপ্ন ভেঙে যেতে থাকে তখন মানুষ ফেডআপ হতে শুরু করে। ফেড থেকে ফেডআপ, ফেড ইন ফেড আউট। কোনো কিছু যাতে ফেড না হয় তার জন্য কত চেষ্টা। বাড়ি যাতে ফেড হয়ে না যায়, তার জন্য নতুন নতুন রং বাজারে আসছে। বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, একবার রং লাগালে বুড়ো বয়স পর্যন্ত টিকে থাকে সেই রং। মানুষের স্বপ্নও তো অনেকটা সে রকমই। একবার দেখতে পারলে হয়, তার ফিকে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু তার পরও তো স্বপ্ন ফিকে হয়। কেমন করে তা হয়, তার উদাহরণ দেওয়া হয়। যে পুঁজিবাজারকে আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন দুষ্টু, সেই পুঁজিবাজার নিয়েই কথা বলা যাক। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, পুঁজিবাজারে মানুষের ভিড়। পুঁজিবাজার যেন মানুষের টাকা বানানোর মেশিন। যেকোনো বিনিয়োগেরই একটা স্বাভাবিক নিয়ম আছে। বিষয়টি জানতে হয়, বুঝতে হয়। আমাদের পুঁজিবাজার তখন বেশ ঝা-চকচকে। সেখানে মেশিনে টাকা ঢাললেই টাকা বেরিয়ে আসছে। মানুষ টাকা ঢালতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনি। টাকা ঢেলেছে, তুলেছে। দিনের পর দিন এভাবে চলেছে; কিন্তু সেটা যে স্বাভাবিক ছিল না, তা কেউ বুঝতে পারেনি। অনেকেরই ধারণা ছিল এখানে টাকা ঢাললেই লাভ পাওয়া যায়। দিনের লাভ দিনে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা দাঁড়াল। ঝাঁকে ঝাঁকে সবাইকে সেদিকে ছুটতে দেখা গেল। কিছুদিন পরই দুষ্টু রোগে পেয়ে বসল পুঁজিবাজারকে। ক্ষয়রোগে যেমন মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে, তেমনি পুঁজিবাজারের দুষ্টু রোগে বিনিয়োগকারীদের অর্থহানি ঘটতে শুরু করলে, অনেকের স্বপ্নভঙ্গ হয়। শুরু হয় ফেডআপ।
আজকাল বিজ্ঞাপনে আমরা দেখি সব কিছু দেখবেন ঝকঝকে তকতকে করে তোলার অনেক উপায় বের হয়েছে; কিন্তু কোনো কিছু দিয়েই পুঁজিবাজারকে আগের মতো ঝকঝকে-তকতকে করে তোলা যাচ্ছে না। দুষ্টু রোগ সেটা হতে দিচ্ছে না। অতঃপর অর্থমন্ত্রী মকরধ্বজ ব্যবহারের ইঙ্গিতই দিলেন যেন। কোনো ওষুধে যখন কাজ না হয়, তখন ধন্বন্তরি চিকিৎসকও বিরক্তি প্রকাশ করে থাকেন। বিরক্তি অর্থমন্ত্রীও সে কারণেই তাঁর মুখ থেকে ওভাবে কিছু কথা বেরিয়েছে। তাঁর এই ওষুধের কথায় আশান্বিত হতে হয়। মনে পড়ে যায় সুকুমার রায়ের সেই ছড়া, যে ছড়াটি এক বেয়াড়া ধরনের গাধাকে নিয়ে লেখা। বিশাল লম্বা নাকের এক সাহেবের ছিল একটি গাধা। যেমনি 'পেটুক, তেমনি ঠ্যাঁটা' গাধাটি চলতে চলতে থেকে থেকে খানায়-খন্দে পড়ে যেত। 'ব্যাপার দেখে এমনিমরো/সাহেব বললে সবুর করো।/মামদোবাজি আমার কাছে/এ রোগেরও ওষুধ আছে'। আমাদের 'দুষ্টু' রোগে আক্রান্ত পুঁজিবাজারের অবস্থা দেখে অর্থমন্ত্রী ওষুধ আছে বলে জানিয়েছেন।
কিন্তু তিনি ফেডআপ। ভয়টা সেখানেই। সিনেমায় ফেড ইন, ফেডআপ ইত্যাদি হয়। যেখানে অর্থমন্ত্রী নিজেই ফেডআপ, সেখানে ফেড আউট করে ডিজলভ করার চেষ্টায় কেউ নেই তো? আশঙ্কা তো থাকেই। ঘর পোড়া গরুর ভয় সিঁদুরে মেঘে। অর্থমন্ত্রী কি তাঁর সেই ওষুধ অচিরেই দুষ্টু পুঁজিবাজারে প্রয়োগ করবেন?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.