জীবন যেমন-কালো হরফে বন্দি একটি কাল, একটি সত্য by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
তাহলে সত্যজিৎ রায় কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? এই জন্য যে, 'পথের পাঁচালী' অর্থাৎ পথের গানেই আছে জীবনের কথা, যার অপর নাম দীন। ওই যে রেলগাড়িটি মাঠের মধ্যে 'ঝিক' 'ঝিক' শব্দ করে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, চিরায়ত বাংলার পটভূমিতে অপুর জীবনের ট্রিলজি, মুহূর্তে যা চিনিয়ে দিল না বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতাকে, এর সঙ্গে চিরায়ত মানুষকে।
জানতে হবে মানুষই দীন, দীনই মানুষ
কলকাতায় অক্সফোর্ড বুক স্টোরে মাঝে মধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাই। অনেক দিন আগের কথা। একটি বই খুব ভালো লাগছিল পড়তে। সামনেই শালপ্রাংশু সত্যজিৎ। খানিকক্ষণ তাকিয়েই থাকতে হলো। বললাম :আপনিই...? বললেন, হ্যাঁ, আমিই। অটোগ্রাফ আমার জন্য নয়, মেয়ে শারমিনীর। সই হয়ে গেলে পরিচয় দিলাম। বললেন, আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি কখন বাংলাদেশ টিভির প্রোগ্রাম হবে! বিশেষ করে নাটক ও লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। বললেন, শিগগিরই আসছি। এলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। এসেছিলেন কয়েকবার, যোগাযোগ হয়নি।
ওই বইয়ের দোকানেই অনেক দিন পরে, বিজয়া রায়ের লেখা 'আমাদের কথা' বইটি সংগ্রহ করে উপহার দিই আসমাকে। আবিষ্কৃৃত সত্যজিৎ-বিজয়া। বইটি না পড়লে সত্যজিৎ রায়কে পুরোপুরি চিনতে পারতাম না। এ কারণেই বলে থাকি যে, কালো হরফের লেখায় বন্দি কথাগুলোই চেনাতে পারে একটি মানুষ, একটি কাল, একটি সত্য। এমন বর্ণময়, আলোকময়, চিত্রময় জীবনযাপনের কথা আর পড়িনি। পারস্পরিক সম্মান, ভালোবাসা নিয়ে গড়ে উঠেছিল যে সংসার, তা আজ কিংবদন্তি। সংসার অবশ্যই সুখের হয় রমণীর গুণে; সে রমণী যদি হন বিজয়া।
রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে ভালোবেসেছিলেন কিনা মুখ ফুটে বলেননি; 'বিজয়িনী' কবিতায় সে ভালোবাসা এসে দেখা দিয়েছে। প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র স্র্রষ্টার জীবনসঙ্গিনী বিজয়ার কাছে পেয়েছি জানা-অজানা কাহিনী, স্মৃতি-বিস্মৃতির জগৎ থেকে তুলে আনা মানিকের প্রেরণার ইতিবৃত্ত। বাংলার মানিক কী করে হলেন পৃথিবীর সত্যজিৎ_ সেই অকপট স্বনিষ্ঠ বিস্তারিত ৫৭৪ পৃষ্ঠার গল্প যে পড়েনি, বড়ই দুর্ভাগা সে। ৮৪ বছর বয়সে কেউ কলম হাতে নিয়েছেন_ এমন ঘটনা জানা নেই। বিজয়া রায় যখন একবার শুরু করেছেন, শেষ অবধি টেনেছেন তার নিজের ও মানিকের গল্প। তার নিজের গল্প আমার কাছে মনে হয়েছে অবিশ্বাস্য। প্রায়শ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মানিক। ঘটনাবহুল জীবনের আশাবাদী দিকটি চিরকাল ছিল অক্ষুণ্ন। তাই বাল্য-কৈশোর-যৌবন-প্রৌঢ়ত্ব-বার্ধক্য ও লেখিকা জীবনের অমরত্ব_ সব মিশে আছে এই গ্রন্থে। একেকটি পাতা পড়ছি আর বন্ধ করে অনেকক্ষণ ভেবেছি। এত সুন্দরও জীবন হয়! কাকা-ছোট পিসি-সানিদা-বাবা-কাকামণি-মেজদি-মানুদা-বড়দি-সরস্বতীদি-মেজপিসি-বড়পিসি-মানিক ঠাকুমা (কোলে মন্টু)-খুড়ি মা (কোলে বাচ্চু)-মা-সেজদি-আমি। যেন ছবিতেই নয়, সামনেই দেখতে পাচ্ছি। এমন অনুভব তারই হবে, যে বিজয়া-সত্যজিতের সঙ্গে মিশে যাবে।
'...পাটনার বাড়িটি ছিল ভারি সুন্দর লাল ইটের বাংলোবাড়ি, নাম ছিল লিলি ভিলা, কুয়োর পাশে আমাদের বড় আদরের দুটো গাছ কুল ও পেয়ারা। ওই পেয়ারা গাছে চড়ে কত যে পেয়ারা চিবিয়েছি তার শেষ নেই। কুল গাছটায় হতো মিষ্টি নারকোলি কুল। বারান্দার দু'পাশে দুটো বড় গাছ, একটা আম অন্যটা নিম। নিমগাছে মালি একটা দোলনা টাঙিয়ে দিয়েছিল, কত দোল খেয়েছি ওই দোলনায়, আর আম গাছের কচি আম পেড়ে তেল নুন লঙ্কা দিয়ে মেখে ছুটির দিনে বই পড়তে পড়তে খেয়েছি, সে কথা ভাবলে এখনো জিভে জল এসে যায় ...'।
মানিকের সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠতা শুরু, সে এক মজার কাহিনী। সেই গাল-ফোলা মানিকের গাল ভেঙে এখন মুখটা লম্বা হয়ে গেছে, আর ওর দিকে তাকাতে গেলে মুখটা অনেকখানি তুলতে হয়। বাইশ বছরের মানিকের ছবি সংগ্রহ করেছি, পাঠকদের উপহার দিলাম। রাসবিহারী এভিনিউর বাড়িতে বিজয়াকে আমি যেন কোথায় দেখেছি।
শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্নের শেষে আসমাকেও আমি দেখেছিলাম একই দৃষ্টিতে। মন্টু ভাইকে (মুস্তাফা মনোয়ার) গিয়ে বললাম, এই মেয়েটিকে আমার পছন্দ। মন্টু আমার দিকে তাকালো। বলল, ভারি মিষ্টি। কোথায় পেলে? সে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কাউকে পায়নি। বললাম, এর একটি পেন্সিল স্কেচ এঁকে দাও। পরদিন একসঙ্গে পেন্সিল স্কেচে অনিন্দ্যসুন্দরী আবির্ভূতা। বিজয়ার কাহিনী পড়ছি আর মনে মনে অবাক হয়ে যাচ্ছি। বার্লিন যাওয়ার সময় দমদম এয়ারপোর্টে হাজির সুপ্রিয়া, উত্তম কুমার, মানিক ও বিজয়া। এরা বাঙালির কাছে মহার্ঘ্য শুধু ছবিতেই নয়, কল্পনাতেও।
কোন পাতা ছেড়ে কোন পাতার কথা বলব। সব পাতা লজেন্সের মতো। অল্প করে যেমন লজেন্স ছোটবেলায় খেতাম! খানিকটা লুকিয়ে রাখতাম, পরে ওদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেতাম; এ বইও তেমনি।
একজন মুসলমান হিসেবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাকে দীনের কাছাকাছি আনবে। যা আনবে না, তার জন্য সময় ব্যয় করব না। তাহলে সত্যজিৎ রায় কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? এই জন্য যে, 'পথের পাঁচালী' অর্থাৎ পথের গানেই আছে জীবনের কথা, যার অপর নাম দীন। ওই যে রেলগাড়িটি মাঠের মধ্যে 'ঝিক' 'ঝিক' শব্দ করে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, চিরায়ত বাংলার পটভূমিতে অপুর জীবনের ট্রিলজি, মুহূর্তে যা চিনিয়ে দিল না বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতাকে, এর সঙ্গে চিরায়ত মানুষকে। জানতে হবে মানুষই দীন, দীনই মানুষ।
'পথের পাঁচালী' (১৯৫৫), 'অপরাজিত' (১৯৫৬) এবং 'অপুর সংসার' (১৯৫৯) শুধু ক্যান ফেস্টিভ্যালে মনুষ্যজীবনের শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি হিসেবে ও ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে বিভূষিত হয়নি; জানিয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে এক ঐক্যের কথা। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র, সুকুমার রায়ের সুপুত্র তার ব্রাহ্মজীবনের পাঁচালি প্রকাশ করেননি এই ট্রিলজিতে, বরং সারা পৃথিবীকে জানিয়েছেন বাঙালি মানসের পরম সত্য_ 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'।
সারা পৃথিবী সত্যজিৎকে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদা দিয়েছে; সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পরেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাকে আনন্দিত করেছিল, কিন্তু তা নিয়ে যায়নি তাকে একটি শিল্পকর্মের দিকে। রিফিউজিদের দুঃখ-কষ্ট তার মনে প্রভাব ফেলেছিল, সোশিয়ালিজমের দিকে তার গন্তব্য ছিল না, বরং রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি ছিলেন একজন এলিটিস্ট। 'পথের পাঁচালী' ট্রিলজিতে যে দারিদ্র্যের ছবি তিনি এঁকেছেন তা তার নিজের দেখা। চিত্রতারকা নার্গিস তার সমালোচনা করে বলেছেন যে, রায় ভারতের দারিদ্র্য রফতানি করেছেন, আধুনিক ভারত নয়। 'সতরাঞ্জ কি খিলাড়ি'তে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ তার ওপর ভর করেছেন। এগিয়ে এসেছেন সায়িদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, রিচার্ড অ্যাটেনব্যুরো। রবীন্দ্রনাথকে, তার বাবা সুকুমার রায়কে নিয়ে তার ডকুমেন্টারি, সুনীলের লেখা 'অরণ্যের দিনরাত্রি'_ চার যুবকের অ্যাডভেঞ্চার; এর পরে 'প্রতিদ্বন্দ্বী', 'সীমাবদ্ধ' ও 'জনারণ্য' সেলুলয়েডে এনেছেন নতুন নতুন নিরীক্ষা।
বিজয়ার জীবনে হঠাৎ এলো কালো মেঘের বিষণ্নতা নিয়ে মাধবী। সত্যজিৎ তাকে ভালোবেসেছিলেন কিনা, বইতে লেখেননি বিজয়া। কষ্ট পেয়েছেন; মুখ বুজে সয়ে নিয়েছেন সে কষ্ট। রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী একজনই। তার নাম কাদম্বরী। একজনই ব্যতিক্রম, যিনি সমর্পিত শুধু প্রমীলায়, তার নাম নজরুল। নার্গিস-কানন-ফজিলাতুন্নেছার কাছে ক্ষণিকের অতিথি।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
কলকাতায় অক্সফোর্ড বুক স্টোরে মাঝে মধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাই। অনেক দিন আগের কথা। একটি বই খুব ভালো লাগছিল পড়তে। সামনেই শালপ্রাংশু সত্যজিৎ। খানিকক্ষণ তাকিয়েই থাকতে হলো। বললাম :আপনিই...? বললেন, হ্যাঁ, আমিই। অটোগ্রাফ আমার জন্য নয়, মেয়ে শারমিনীর। সই হয়ে গেলে পরিচয় দিলাম। বললেন, আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি কখন বাংলাদেশ টিভির প্রোগ্রাম হবে! বিশেষ করে নাটক ও লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। বললেন, শিগগিরই আসছি। এলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। এসেছিলেন কয়েকবার, যোগাযোগ হয়নি।
ওই বইয়ের দোকানেই অনেক দিন পরে, বিজয়া রায়ের লেখা 'আমাদের কথা' বইটি সংগ্রহ করে উপহার দিই আসমাকে। আবিষ্কৃৃত সত্যজিৎ-বিজয়া। বইটি না পড়লে সত্যজিৎ রায়কে পুরোপুরি চিনতে পারতাম না। এ কারণেই বলে থাকি যে, কালো হরফের লেখায় বন্দি কথাগুলোই চেনাতে পারে একটি মানুষ, একটি কাল, একটি সত্য। এমন বর্ণময়, আলোকময়, চিত্রময় জীবনযাপনের কথা আর পড়িনি। পারস্পরিক সম্মান, ভালোবাসা নিয়ে গড়ে উঠেছিল যে সংসার, তা আজ কিংবদন্তি। সংসার অবশ্যই সুখের হয় রমণীর গুণে; সে রমণী যদি হন বিজয়া।
রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে ভালোবেসেছিলেন কিনা মুখ ফুটে বলেননি; 'বিজয়িনী' কবিতায় সে ভালোবাসা এসে দেখা দিয়েছে। প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র স্র্রষ্টার জীবনসঙ্গিনী বিজয়ার কাছে পেয়েছি জানা-অজানা কাহিনী, স্মৃতি-বিস্মৃতির জগৎ থেকে তুলে আনা মানিকের প্রেরণার ইতিবৃত্ত। বাংলার মানিক কী করে হলেন পৃথিবীর সত্যজিৎ_ সেই অকপট স্বনিষ্ঠ বিস্তারিত ৫৭৪ পৃষ্ঠার গল্প যে পড়েনি, বড়ই দুর্ভাগা সে। ৮৪ বছর বয়সে কেউ কলম হাতে নিয়েছেন_ এমন ঘটনা জানা নেই। বিজয়া রায় যখন একবার শুরু করেছেন, শেষ অবধি টেনেছেন তার নিজের ও মানিকের গল্প। তার নিজের গল্প আমার কাছে মনে হয়েছে অবিশ্বাস্য। প্রায়শ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মানিক। ঘটনাবহুল জীবনের আশাবাদী দিকটি চিরকাল ছিল অক্ষুণ্ন। তাই বাল্য-কৈশোর-যৌবন-প্রৌঢ়ত্ব-বার্ধক্য ও লেখিকা জীবনের অমরত্ব_ সব মিশে আছে এই গ্রন্থে। একেকটি পাতা পড়ছি আর বন্ধ করে অনেকক্ষণ ভেবেছি। এত সুন্দরও জীবন হয়! কাকা-ছোট পিসি-সানিদা-বাবা-কাকামণি-মেজদি-মানুদা-বড়দি-সরস্বতীদি-মেজপিসি-বড়পিসি-মানিক ঠাকুমা (কোলে মন্টু)-খুড়ি মা (কোলে বাচ্চু)-মা-সেজদি-আমি। যেন ছবিতেই নয়, সামনেই দেখতে পাচ্ছি। এমন অনুভব তারই হবে, যে বিজয়া-সত্যজিতের সঙ্গে মিশে যাবে।
'...পাটনার বাড়িটি ছিল ভারি সুন্দর লাল ইটের বাংলোবাড়ি, নাম ছিল লিলি ভিলা, কুয়োর পাশে আমাদের বড় আদরের দুটো গাছ কুল ও পেয়ারা। ওই পেয়ারা গাছে চড়ে কত যে পেয়ারা চিবিয়েছি তার শেষ নেই। কুল গাছটায় হতো মিষ্টি নারকোলি কুল। বারান্দার দু'পাশে দুটো বড় গাছ, একটা আম অন্যটা নিম। নিমগাছে মালি একটা দোলনা টাঙিয়ে দিয়েছিল, কত দোল খেয়েছি ওই দোলনায়, আর আম গাছের কচি আম পেড়ে তেল নুন লঙ্কা দিয়ে মেখে ছুটির দিনে বই পড়তে পড়তে খেয়েছি, সে কথা ভাবলে এখনো জিভে জল এসে যায় ...'।
মানিকের সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠতা শুরু, সে এক মজার কাহিনী। সেই গাল-ফোলা মানিকের গাল ভেঙে এখন মুখটা লম্বা হয়ে গেছে, আর ওর দিকে তাকাতে গেলে মুখটা অনেকখানি তুলতে হয়। বাইশ বছরের মানিকের ছবি সংগ্রহ করেছি, পাঠকদের উপহার দিলাম। রাসবিহারী এভিনিউর বাড়িতে বিজয়াকে আমি যেন কোথায় দেখেছি।
শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্নের শেষে আসমাকেও আমি দেখেছিলাম একই দৃষ্টিতে। মন্টু ভাইকে (মুস্তাফা মনোয়ার) গিয়ে বললাম, এই মেয়েটিকে আমার পছন্দ। মন্টু আমার দিকে তাকালো। বলল, ভারি মিষ্টি। কোথায় পেলে? সে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কাউকে পায়নি। বললাম, এর একটি পেন্সিল স্কেচ এঁকে দাও। পরদিন একসঙ্গে পেন্সিল স্কেচে অনিন্দ্যসুন্দরী আবির্ভূতা। বিজয়ার কাহিনী পড়ছি আর মনে মনে অবাক হয়ে যাচ্ছি। বার্লিন যাওয়ার সময় দমদম এয়ারপোর্টে হাজির সুপ্রিয়া, উত্তম কুমার, মানিক ও বিজয়া। এরা বাঙালির কাছে মহার্ঘ্য শুধু ছবিতেই নয়, কল্পনাতেও।
কোন পাতা ছেড়ে কোন পাতার কথা বলব। সব পাতা লজেন্সের মতো। অল্প করে যেমন লজেন্স ছোটবেলায় খেতাম! খানিকটা লুকিয়ে রাখতাম, পরে ওদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেতাম; এ বইও তেমনি।
একজন মুসলমান হিসেবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাকে দীনের কাছাকাছি আনবে। যা আনবে না, তার জন্য সময় ব্যয় করব না। তাহলে সত্যজিৎ রায় কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? এই জন্য যে, 'পথের পাঁচালী' অর্থাৎ পথের গানেই আছে জীবনের কথা, যার অপর নাম দীন। ওই যে রেলগাড়িটি মাঠের মধ্যে 'ঝিক' 'ঝিক' শব্দ করে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, চিরায়ত বাংলার পটভূমিতে অপুর জীবনের ট্রিলজি, মুহূর্তে যা চিনিয়ে দিল না বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিত্র নির্মাতাকে, এর সঙ্গে চিরায়ত মানুষকে। জানতে হবে মানুষই দীন, দীনই মানুষ।
'পথের পাঁচালী' (১৯৫৫), 'অপরাজিত' (১৯৫৬) এবং 'অপুর সংসার' (১৯৫৯) শুধু ক্যান ফেস্টিভ্যালে মনুষ্যজীবনের শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি হিসেবে ও ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে বিভূষিত হয়নি; জানিয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে এক ঐক্যের কথা। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র, সুকুমার রায়ের সুপুত্র তার ব্রাহ্মজীবনের পাঁচালি প্রকাশ করেননি এই ট্রিলজিতে, বরং সারা পৃথিবীকে জানিয়েছেন বাঙালি মানসের পরম সত্য_ 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'।
সারা পৃথিবী সত্যজিৎকে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদা দিয়েছে; সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পরেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাকে আনন্দিত করেছিল, কিন্তু তা নিয়ে যায়নি তাকে একটি শিল্পকর্মের দিকে। রিফিউজিদের দুঃখ-কষ্ট তার মনে প্রভাব ফেলেছিল, সোশিয়ালিজমের দিকে তার গন্তব্য ছিল না, বরং রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি ছিলেন একজন এলিটিস্ট। 'পথের পাঁচালী' ট্রিলজিতে যে দারিদ্র্যের ছবি তিনি এঁকেছেন তা তার নিজের দেখা। চিত্রতারকা নার্গিস তার সমালোচনা করে বলেছেন যে, রায় ভারতের দারিদ্র্য রফতানি করেছেন, আধুনিক ভারত নয়। 'সতরাঞ্জ কি খিলাড়ি'তে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ তার ওপর ভর করেছেন। এগিয়ে এসেছেন সায়িদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, রিচার্ড অ্যাটেনব্যুরো। রবীন্দ্রনাথকে, তার বাবা সুকুমার রায়কে নিয়ে তার ডকুমেন্টারি, সুনীলের লেখা 'অরণ্যের দিনরাত্রি'_ চার যুবকের অ্যাডভেঞ্চার; এর পরে 'প্রতিদ্বন্দ্বী', 'সীমাবদ্ধ' ও 'জনারণ্য' সেলুলয়েডে এনেছেন নতুন নতুন নিরীক্ষা।
বিজয়ার জীবনে হঠাৎ এলো কালো মেঘের বিষণ্নতা নিয়ে মাধবী। সত্যজিৎ তাকে ভালোবেসেছিলেন কিনা, বইতে লেখেননি বিজয়া। কষ্ট পেয়েছেন; মুখ বুজে সয়ে নিয়েছেন সে কষ্ট। রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী একজনই। তার নাম কাদম্বরী। একজনই ব্যতিক্রম, যিনি সমর্পিত শুধু প্রমীলায়, তার নাম নজরুল। নার্গিস-কানন-ফজিলাতুন্নেছার কাছে ক্ষণিকের অতিথি।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
No comments