ভাষা চর্চা কেন্দ্রের গুরুত্ব by মিল্টন বিশ্বাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করি আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে। সে সময় ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সবার কাছে স্পষ্ট হলেও স্প্যানিশ ভাষা শেখার উদ্দেশ্য অনেকেই জানতে চেয়েছিলেন।
ছাত্রজীবনে তৃতীয় এই ভাষাটির ওপর এক বছরের কোর্স আমার চাকরি জীবনে কোনো কাজে আসেনি সত্য, তবে আমার চেতনায় স্প্যানিশ ভাষার অনুরণন রয়ে গেছে এখনো। ভাষার কি সেই জাদুমন্ত্র, যার অনুরণন অনেক দিন পর্যন্ত ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে লেপ্টে থাকে? আসলে ভাষাটি শেখার সময় আমি কেবল বলা কিংবা লেখার বিষয়ে গুরুত্ব দিইনি, বরং সে ভাষার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরার চেষ্টা করেছিলাম। স্প্যানিশ গিটারের সুরের মূর্ছনা, হিস্পানিক কবিদের গ্রামীণ জীবনের সরল ব্যঞ্জনা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। ভাষা শিক্ষার পরে স্পেনের কয়েকজন কবির কবিতা অনুবাদ করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেছিলাম। স্পেনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখতাম। অনুশীলনের অভাবে ক্রমান্বয়ে ভাষাটি আমার আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, তার ভেতরে আর প্রবেশ করতে পারি না। তবে ভাষা শিক্ষার সেই প্রশিক্ষণ আমার জীবনে ব্যর্থ হয়নি। স্প্যানিশভাষী সাহিত্যিকরা নোবেলজয়ী হলে আমি আনন্দিত হই। মাতৃভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব আমরা বিশ্বায়নের যুগে বসে আরো বেশি করে উপলব্ধি করতে পারছি। বর্তমানে আমরা নিজের ভাষা সম্পর্কে যেমন শ্রদ্ধাশীল তেমনি বিদেশি ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে সমান আগ্রহী। আর এই আগ্রহের বারুদ প্রজ্বলনে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট_সরকারি পর্যায়ে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশি ভাষা চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ ছাড়া দেশের মধ্যে ব্রিটিশ ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ ভাষা চর্চার কেন্দ্র হিসেবে স্ব স্ব বিদেশি দূতাবাসগুলোর নিজস্ব সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো কেবল ভাষা শিক্ষা দেয় না, বরং তারা নিজেদের ঐতিহ্য বাংলাদেশে পরিচিত করার জন্য চলচ্চিত্র ও চিত্র প্রদর্শনী এবং সংগীতসন্ধ্যার আয়োজন করে থাকে। লাইব্রেরির পরিবেশ আকর্ষণীয় করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটানো হয়। ভাষা শিক্ষার যে পরিবেশ বিদেশি দূতাবাসগুলো আমাদের দিয়ে থাকে, দেশি ভাষা চর্চা কেন্দ্রগুলো তা দিতে ব্যর্থ হয়। বিদেশি ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ দরকার, দরকার আধুনিক ভাষা প্রশিক্ষণের সরঞ্জামাদি। একই সঙ্গে দরকার যোগ্য শিক্ষক। এসবের সমন্বিত ব্যবস্থা স্বাধীনতার এত দিন পরও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দিতে কেন ব্যর্থ হয়েছে, সে প্রশ্ন আমাদের সবার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি বিদেশি ভাষা চর্চার সুযোগ করে দিয়েছে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট। কোনো কোনো বিভাগে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার পাশে তৃতীয় একটি ভাষা জানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশকের মাথায় ভাষা চর্চার কেন্দ্রগুলোর গুরুত্ব ও এর অবদান বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে কেন্দ্রগুলো সে অর্থে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং বিদেশি ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে তাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর গুরুত্ব অধিক।
বলা যায় আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। এক কিংবা দুই বছরের একটি কোর্স সমাপ্ত করে বিদেশে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। ঢাকাকে অনুসরণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। এখানে খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার আগে এই ব্যবস্থা যৌক্তিক ছিল; কিন্তু প্রতিটি বিদেশি ভাষার জন্য পর্যাপ্ত পূর্ণকালীন শিক্ষক ব্যতীত এর কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কা অমূলক নয়। কেবল ইংরেজি ভাষার শিক্ষক দিয়ে ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার দরকার ছিল কি?
ভাষা আন্দোলনের মাস এলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের বিষয়টি আলোচনায় আসে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরও এর অবকাঠামো ছাড়া আর অন্য কোনো কর্মকাণ্ড শুরু হয়নি। এমনকি প্রয়োজনীয় লোকবলও নেই সেখানে। ক্ষমতায় আসার পরে মহাজোট সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটিকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর আগ্রহ ও আন্তরিকতার স্বতন্ত্র মূল্য আছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটির ভাষা সংরক্ষণ ও গবেষণার কার্যক্রম আমরা প্রত্যক্ষ করছি না।
ভাষা আন্দোলনের এত দিন পরও দেশের ভেতর যথার্থ দেশি (বাংলা ও আদিবাসী ভাষা) এবং বিদেশি ভাষা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সংখ্যা কম বলে অভিমত প্রকাশ করে থাকেন অনেকে। তবে বিদেশে গিয়ে শ্রমবাজারের প্রয়োজনীয় ভাষা হয়তো অনেকেই জানেন। দেশের মধ্যে কোরিয়ান, জাপানিজ ও চীনা ভাষা শিক্ষার জন্য একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইংরেজি ভাষা নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন শতাধিক ব্যক্তি। এসব ব্যক্তির অনেকেরই ধারণা, বাংলা ভাষা বিদেশি ভাষার দাপটে ম্রিয়মাণ। বাংলা ভাষার চর্চাকারীরা ইংরেজি জানেন না, বাংলা সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা পোষণকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে কি? আমার মনে হয়, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিদেশি ভাষার গুরুত্ব স্বীকার করেছে। তবে বাংলা ভাষার প্রতি তাদের মমত্ববোধ কখনো কমবে বলে মনে হয় না। বরং আবহমান বাঙালির প্রাণের উৎসবগুলোতে বাংলা ভাষার দিগন্ত দেশ থেকে দেশের বাইরে ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রকৃত অর্থে একাধিক ভাষা ভালোভাবেই আয়ত্ত-আত্মস্থ করেছিলেন। অথচ তিনিই বাংলা সাহিত্যের বিষয় ও আঙ্গিকে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এ জন্য বিদেশি ভাষা চর্চা কেন্দ্রের গুরুত্ব আমাদের কাছে স্পষ্ট। এ ছাড়া বিদেশি ভাষায় বিশ্বের কাছে দেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্য সরকারি ভাষা চর্চা কেন্দ্রগুলোকে ঢেলে সাজানো দরকার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বলা যায় আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। এক কিংবা দুই বছরের একটি কোর্স সমাপ্ত করে বিদেশে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। ঢাকাকে অনুসরণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। এখানে খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার আগে এই ব্যবস্থা যৌক্তিক ছিল; কিন্তু প্রতিটি বিদেশি ভাষার জন্য পর্যাপ্ত পূর্ণকালীন শিক্ষক ব্যতীত এর কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কা অমূলক নয়। কেবল ইংরেজি ভাষার শিক্ষক দিয়ে ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার দরকার ছিল কি?
ভাষা আন্দোলনের মাস এলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের বিষয়টি আলোচনায় আসে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরও এর অবকাঠামো ছাড়া আর অন্য কোনো কর্মকাণ্ড শুরু হয়নি। এমনকি প্রয়োজনীয় লোকবলও নেই সেখানে। ক্ষমতায় আসার পরে মহাজোট সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটিকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর আগ্রহ ও আন্তরিকতার স্বতন্ত্র মূল্য আছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটির ভাষা সংরক্ষণ ও গবেষণার কার্যক্রম আমরা প্রত্যক্ষ করছি না।
ভাষা আন্দোলনের এত দিন পরও দেশের ভেতর যথার্থ দেশি (বাংলা ও আদিবাসী ভাষা) এবং বিদেশি ভাষা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সংখ্যা কম বলে অভিমত প্রকাশ করে থাকেন অনেকে। তবে বিদেশে গিয়ে শ্রমবাজারের প্রয়োজনীয় ভাষা হয়তো অনেকেই জানেন। দেশের মধ্যে কোরিয়ান, জাপানিজ ও চীনা ভাষা শিক্ষার জন্য একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইংরেজি ভাষা নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন শতাধিক ব্যক্তি। এসব ব্যক্তির অনেকেরই ধারণা, বাংলা ভাষা বিদেশি ভাষার দাপটে ম্রিয়মাণ। বাংলা ভাষার চর্চাকারীরা ইংরেজি জানেন না, বাংলা সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা পোষণকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে কি? আমার মনে হয়, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিদেশি ভাষার গুরুত্ব স্বীকার করেছে। তবে বাংলা ভাষার প্রতি তাদের মমত্ববোধ কখনো কমবে বলে মনে হয় না। বরং আবহমান বাঙালির প্রাণের উৎসবগুলোতে বাংলা ভাষার দিগন্ত দেশ থেকে দেশের বাইরে ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রকৃত অর্থে একাধিক ভাষা ভালোভাবেই আয়ত্ত-আত্মস্থ করেছিলেন। অথচ তিনিই বাংলা সাহিত্যের বিষয় ও আঙ্গিকে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এ জন্য বিদেশি ভাষা চর্চা কেন্দ্রের গুরুত্ব আমাদের কাছে স্পষ্ট। এ ছাড়া বিদেশি ভাষায় বিশ্বের কাছে দেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্য সরকারি ভাষা চর্চা কেন্দ্রগুলোকে ঢেলে সাজানো দরকার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments