বিচারপতির মন্তব্যে স্পিকারের রুলিং
জাতীয় সংসদের স্পিকারকে উদ্দেশ করে হাইকোর্টের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী সম্প্রতি কিছু মন্তব্য করেছিলেন। একই দিন সংসদে কয়েকজন সাংসদ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ওই বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানান।
এর ১৩ দিনের মাথায় গতকাল সোমবার স্পিকার আবদুল হামিদ সংসদে একটি রুলিং দিয়েছেন। স্পিকারের এই রুলিং নিচে তুলে ধরা হলো।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
গত ২৯ মে ২০১২ তারিখ মহান এ সংসদে কয়েকজন মাননীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি কিছু কথা বলেছিলাম। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল মূলত সংসদ, আদালত ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক এবং তাদের কল্যাণ সাধন। মাননীয় সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সাধারণ মন্তব্য করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ৫ জুন ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ মর্মে সংবাদ পরিবেশিত হয় যে হাইকোর্ট বেঞ্চের একজন মাননীয় বিচারপতি আমার বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন এবং আমার ও জাতীয় সংসদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ ও অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেছেন। ওই দিনই সংসদ চলাকালীন আপনাদের মধ্যে সিনিয়র কয়েকজন মাননীয় সদস্য পয়েন্ট অব অর্ডারে এ বিষয়ে সংসদের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে ওই মাননীয় বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, এমনকি সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনপূর্বক অপসারণের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। উপস্থিত সকল মাননীয় সদস্য ওই বক্তব্য সমর্থন করেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। ওই দিন স্পিকারের দায়িত্ব পালনরত মাননীয় ডেপুটি স্পিকার এ বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আপনাদের জানিয়েছিলেন। স্পিকার তথা সংসদকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন না করা, সংসদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সংসদকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সেদিন আপনারা এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এবং বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বস্তুত সেই মুহূর্তে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। আপনাদের এ সেন্টিমেন্টকে আমি শ্রদ্ধা করি, আপনাদের প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
এটা প্রণিধানযোগ্য যে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে আন্তসম্পর্ক ও সমন্বয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, যথাযথ Check & balance গড়ে তোলার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ শত শত বছর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। কারণ আমরা সবাই অবগত যে Democracy is not a system only, it is a culture too. আমরাও এই মহান সংসদে সেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আর তাই কিছু দিন আগে আমাদের দেশের একজন অধ্যাপক, বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিষয়ে সংসদে কিছু আলোচনা হয়েছিল। যখনই সংসদের কাছে তাঁর বক্তব্য সম্পর্কিত সঠিক ব্যাখ্যা গোচরীভূত হয়, তখনই সংসদ এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছে। অপ্রয়োজনীয় অংশ এক্সপাঞ্জ করেছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, মাননীয় বিচারপতি সমস্ত বিষয়টি হূদয়ঙ্গম করবেন এবং মাত্রা অতিক্রমকারী বক্তব্য পরিহারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
আমার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মহামান্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি যে বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন এবং পরবর্তীতে এ নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তা সত্যিই দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেব না বা মন্তব্য করব না। সবাই স্বীয় বিবেচনায় বিষয়টি অনুধাবন করবেন। কিন্তু পরে দেখলাম, এটির সঙ্গে আমার এবং মহান সংসদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমার অবস্থান স্পষ্ট না করলে মহান সংসদ এবং আমার সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা থেকে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, ‘যেটা নিয়ে অন্যের সঙ্গে ব্যবহার চলছে, যার প্রয়োজন এবং মূল্য সত্যভাবে স্থির হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে কোন যাচনদার যদি এমন কিছু বলেন যা আমার মতে সংগত নয়, তবে চুপ করে গেলে নিতান্ত অবিনয় হবে।’ শেষে ঠিক করেছি, এ বিষয়ে আমি আমার বক্তব্য স্পষ্ট করব।
সেদিন অর্থাৎ ২৯ মে মাননীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম সংসদে সড়ক বিভাগের অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় বৃদ্ধির বিষয়টি মাননীয় আইনমন্ত্রীর নজরে আনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, মাননীয় আইনমন্ত্রী নেই, থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটি দেখতেন। এরপর আমি যে কথাগুলো বলেছি, তার সারমর্ম হচ্ছে মহামান্য আদালতের প্রতি আমাদের সবার শ্রদ্ধা আছে। আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। সড়ক ভবনের বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। রাষ্ট্রের তিনটি অংগ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। এগুলো একটি আরেকটিকে সহযোগিতার জন্য রয়েছে। হঠাৎ এ ভবনকে সরিয়ে নিলে এর কার্যক্রম paralised হয়ে যাবে, যা সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এ বিষয়গুলো যেন মহামান্য আদালত বিচার বিবেচনা করেন, সে অনুরোধটুকু সেদিন করেছিলাম। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের আলোচনার মাধ্যমে তা সুরাহা হলে সুন্দর হয় বলেও উল্লেখ করেছিলাম। শেষে রাষ্ট্রের সব অঙ্গের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব রাখার কথা বলে এ পর্যায়ে আমার বক্তব্য শেষ করি।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
ওই দিন মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মইনউদ্দীন খান বাদল আদালতসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখলে আমি হাস্যচ্ছলে বলেছি, আমার স্পিকারশিপের মেয়াদ শেষ হলে আমাকে আবার কালো কোট পরে কোর্টে যেতে হবে। সুতরাং হিসাব করে কথা বলতে হয়। আবার কোনো সমস্যায় পড়ে যাই। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে রিলিফ নাও পেতে পারি। এরপর গণমানুষের কাছে সবার জবাবদিহির বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলাম, সংসদে সংসদ-সদস্যরা যে আইনগুলো পাস করেন, সেগুলো যদি জনগণের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত জনগণ আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। কোর্টের বিচারে যদি দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয় তাহলে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মানুষ একদিন হয়তো রুখে দাঁড়াতে পারে। একইভাবে যদি কোনো সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করে সে ক্ষেত্রে জনগণের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস আছে। সবাইকে চিন্তাভাবনা করে চলা প্রয়োজন। আত্মঅহমিকা বিসর্জন দিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার কথা বলেছি। কোনো আদালত বা কোনো মামলা বা কোনো বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে কোনো কথা বলা হয়নি। মূলত রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কাজে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে কী হতে পারে তারই একটা ধারণার কথা বলেছি।
২৯ মে সংসদে আমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। প্রথমেই তিনি বলেছেন আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। আমার উপরিউক্ত কথাগুলোর কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতা কী, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি তাঁর বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, ওই দিন আদালতের বিচারক বলেছেন, ‘আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বিচার বিভাগের কাজে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো চাপ নেই। অথচ স্পিকার সংসদে বলেছেন—আইনমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে সড়ক ভবনের সম্পত্তির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তাঁকে বলা যেত। তাহলে কি স্পিকার মনে করেন আইনমন্ত্রীর নির্দেশে বিচার বিভাগ চলে?’ বিজ্ঞ বিচারপতি আমার বক্তব্য ভালভাবে না শুনে না পড়ে যে মন্তব্য করেছেন তাতে তিনি তাঁর বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে সমর্থ হননি মর্মে অনুমিত হয়। আসলে ওই দিন মাননীয় সংসদ-সদস্য স্পিকারের মাধ্যমে মাননীয় আইনমন্ত্রীর কাছে সড়ক ভবন সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন। মাননীয় আইনমন্ত্রী তখন সংসদে উপস্থিত না থাকায় আমি বিষয়টি সংসদকে অবহিত করি এবং বলি ‘থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটা দেখতেন’। এটুকুই বলেছি। এখানে ‘আইনমন্ত্রীকে সড়ক ভবনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি’—এ ধরনের কোনো কথা বলিনি।
আমার জ্ঞান, মেধা, যোগ্যতা ও আইনজীবী হিসেবে আমার সনদ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। আমি প্রায়শই বলি আমি কম লেখাপড়া জানা মানুষ। ষাটের দশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে, তাঁর সান্নিধ্যে এসে ছাত্র অবস্থায় এ দেশের মানুষের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলাম। রাজনীতির পাশাপাশি আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ ৩৭ বৎসর কাজ করেছি। সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্য হিসেবে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেছি। সাবেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব এম এম রুহুল আমিন, জনাব এ বি এম খায়রুল হক ও বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতির আদালতে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বড় বড় বই হয়তো পড়িনি কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের কথাটি বিগত ৫৪ বছর ধরে পড়ে আসছি। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের কাছ থেকেও আমি সারা জীবন অনেক কিছু শিখেছি। তাঁদের মনের কথাটি পড়তে পারি বলেই হয়তো তাঁদের মনে ঠাঁই পেয়েছি। জনগণ আমাকে সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। গণমানুষের কল্যাণে জনগণের নেওয়া নির্বাচনী পরীক্ষায় বারবার উত্তীর্ণ হয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছি।
দ্বিতীয় বার স্পিকার হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব পেয়েছি। তবে স্পিকার হিসেবে আমি একক কোনো সত্তা নই। এ সংসদের অনেক সদস্য আছেন যাঁরা লেখাপড়ায় উচ্চশিক্ষিত, জ্ঞান গরিমায় আমার চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ। তারপরও সরকারি দল, বিরোধী দল ও অন্যান্য দল আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে স্পিকার নির্বাচিত করেছেন। আমার জ্ঞান, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তা সংসদের সব মাননীয় সদস্যের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ধরনের উক্তি করার আগে বিজ্ঞ বিচারক আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে ভালো করতেন। বিজ্ঞ বিচারক আরও অনেক বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন যা আমি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি না।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
আদালতের মাননীয় বিচারকের মন্তব্যের সূত্র ধরে অনেকেই বিশেষ করে পত্রপত্রিকাগুলো একে সংসদের সঙ্গে বিচার বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে মর্মে উল্লেখ করেছেন। সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে আসলে এটি কোনো বৈরিতা নয়। এটি সংসদ সম্পর্কে জনৈক মাননীয় বিচারপতির কিছু অসৌজন্যমূলক মন্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণপ্রসূত উক্তি। পুরো বিচার বিভাগকে এর সঙ্গে জড়ানো ঠিক হবে না। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে বর্তমানে এ দেশ পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ। আবারও বলছি, বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে রয়েছে ৪০ বছর ধরে গড়ে ওঠা গভীর সম্প্রীতি ও আস্থার সম্পর্ক। পারস্পরিক এ সুসম্পর্কের কারণেই অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এ দেশটি আজ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এবং স্পিকার হিসেবে সব সময় বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একে অপরের পরিপূরক এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন। এ ক্ষেত্রে কর্মপদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে কিন্তু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক—এবং তা হলো সর্বাবস্থায় জনগণের কল্যাণ সাধন। দেশ ও জাতির কল্যাণে এ সম্পর্ক আরও অটুট হোক—এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
৫ জুন ২০১২ তারিখে মাননীয় সংসদ সদস্যরা তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশের এক পর্যায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনপূর্বক উক্ত মাননীয় বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে একটি রেজ্যুলেশন গ্রহণ করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রেরণের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। আপনাদের প্রস্তাবকে আমি সমর্থন করে বিনীতভাবে বলতে চাই, একজন বিচারকের অশোভন আচরণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারে না। এ মহান সংসদের অভিভাবক হিসেবে আরও বলতে চাই, আমরা ১৬ কোটি জনগণের প্রতিনিধিরা একজন ব্যক্তিবিশেষের আচরণ দিয়ে পুরো বিচার বিভাগকে মূল্যায়ন করতে পারি না। আপনারা সবাই সিদ্ধান্ত নিলে আমার জন্য তা bindings হয়ে যায়। সার্বিক বিবেচনায় যেহেতু এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি না, তাই আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করব সংসদে আপনাদের উত্থাপিত প্রস্তাবটি আপনারা আমার সঙ্গে একমত হয়ে প্রত্যাহার করবেন।
আমি আশা করব, মাননীয় বিচারপতির সংসদ-সম্পর্কিত মন্তব্যের বিষয়ে মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিচার বিভাগের মাননীয় বিচারক ও বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ, নির্বাহী বিভাগের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ, সুশীল সমাজের সম্মানিত প্রতিনিধিগণ, সম্মানিত বুদ্ধিজীবী, সম্মানিত সাংবাদিকসহ সব পেশার মানুষ, সর্বোপরি আমার পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় দেশের আপামর জনসাধারণ স্বীয় বিবেচনায় মূল্যায়ন করবেন। একই সঙ্গে বলব, আদালতের এ ধরনের আচরণে কী করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
রাষ্ট্রের ভিত্তি সংবিধান। সংবিধানের মূল স্তম্ভ সংসদ। এই সংসদই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। এই পদ্ধতিতেই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সংবিধান আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সংবিধানকে সমুন্নত রাখব-দেশবাসী এটাই প্রত্যাশা করে।
আশা করি, আমার এ বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে এ আলোচনার অবসান হবে। আপনাদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ।
১৮ জুন, ২০১২
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
গত ২৯ মে ২০১২ তারিখ মহান এ সংসদে কয়েকজন মাননীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি কিছু কথা বলেছিলাম। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল মূলত সংসদ, আদালত ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক এবং তাদের কল্যাণ সাধন। মাননীয় সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সাধারণ মন্তব্য করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ৫ জুন ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ মর্মে সংবাদ পরিবেশিত হয় যে হাইকোর্ট বেঞ্চের একজন মাননীয় বিচারপতি আমার বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন এবং আমার ও জাতীয় সংসদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ ও অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেছেন। ওই দিনই সংসদ চলাকালীন আপনাদের মধ্যে সিনিয়র কয়েকজন মাননীয় সদস্য পয়েন্ট অব অর্ডারে এ বিষয়ে সংসদের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে ওই মাননীয় বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, এমনকি সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনপূর্বক অপসারণের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। উপস্থিত সকল মাননীয় সদস্য ওই বক্তব্য সমর্থন করেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। ওই দিন স্পিকারের দায়িত্ব পালনরত মাননীয় ডেপুটি স্পিকার এ বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আপনাদের জানিয়েছিলেন। স্পিকার তথা সংসদকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন না করা, সংসদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সংসদকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সেদিন আপনারা এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এবং বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বস্তুত সেই মুহূর্তে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। আপনাদের এ সেন্টিমেন্টকে আমি শ্রদ্ধা করি, আপনাদের প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
এটা প্রণিধানযোগ্য যে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে আন্তসম্পর্ক ও সমন্বয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, যথাযথ Check & balance গড়ে তোলার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ শত শত বছর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। কারণ আমরা সবাই অবগত যে Democracy is not a system only, it is a culture too. আমরাও এই মহান সংসদে সেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আর তাই কিছু দিন আগে আমাদের দেশের একজন অধ্যাপক, বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিষয়ে সংসদে কিছু আলোচনা হয়েছিল। যখনই সংসদের কাছে তাঁর বক্তব্য সম্পর্কিত সঠিক ব্যাখ্যা গোচরীভূত হয়, তখনই সংসদ এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছে। অপ্রয়োজনীয় অংশ এক্সপাঞ্জ করেছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, মাননীয় বিচারপতি সমস্ত বিষয়টি হূদয়ঙ্গম করবেন এবং মাত্রা অতিক্রমকারী বক্তব্য পরিহারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
আমার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মহামান্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি যে বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন এবং পরবর্তীতে এ নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তা সত্যিই দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেব না বা মন্তব্য করব না। সবাই স্বীয় বিবেচনায় বিষয়টি অনুধাবন করবেন। কিন্তু পরে দেখলাম, এটির সঙ্গে আমার এবং মহান সংসদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমার অবস্থান স্পষ্ট না করলে মহান সংসদ এবং আমার সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা থেকে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, ‘যেটা নিয়ে অন্যের সঙ্গে ব্যবহার চলছে, যার প্রয়োজন এবং মূল্য সত্যভাবে স্থির হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে কোন যাচনদার যদি এমন কিছু বলেন যা আমার মতে সংগত নয়, তবে চুপ করে গেলে নিতান্ত অবিনয় হবে।’ শেষে ঠিক করেছি, এ বিষয়ে আমি আমার বক্তব্য স্পষ্ট করব।
সেদিন অর্থাৎ ২৯ মে মাননীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম সংসদে সড়ক বিভাগের অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় বৃদ্ধির বিষয়টি মাননীয় আইনমন্ত্রীর নজরে আনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, মাননীয় আইনমন্ত্রী নেই, থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটি দেখতেন। এরপর আমি যে কথাগুলো বলেছি, তার সারমর্ম হচ্ছে মহামান্য আদালতের প্রতি আমাদের সবার শ্রদ্ধা আছে। আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। সড়ক ভবনের বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। রাষ্ট্রের তিনটি অংগ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। এগুলো একটি আরেকটিকে সহযোগিতার জন্য রয়েছে। হঠাৎ এ ভবনকে সরিয়ে নিলে এর কার্যক্রম paralised হয়ে যাবে, যা সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এ বিষয়গুলো যেন মহামান্য আদালত বিচার বিবেচনা করেন, সে অনুরোধটুকু সেদিন করেছিলাম। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের আলোচনার মাধ্যমে তা সুরাহা হলে সুন্দর হয় বলেও উল্লেখ করেছিলাম। শেষে রাষ্ট্রের সব অঙ্গের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব রাখার কথা বলে এ পর্যায়ে আমার বক্তব্য শেষ করি।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
ওই দিন মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মইনউদ্দীন খান বাদল আদালতসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখলে আমি হাস্যচ্ছলে বলেছি, আমার স্পিকারশিপের মেয়াদ শেষ হলে আমাকে আবার কালো কোট পরে কোর্টে যেতে হবে। সুতরাং হিসাব করে কথা বলতে হয়। আবার কোনো সমস্যায় পড়ে যাই। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে রিলিফ নাও পেতে পারি। এরপর গণমানুষের কাছে সবার জবাবদিহির বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলাম, সংসদে সংসদ-সদস্যরা যে আইনগুলো পাস করেন, সেগুলো যদি জনগণের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত জনগণ আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। কোর্টের বিচারে যদি দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয় তাহলে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মানুষ একদিন হয়তো রুখে দাঁড়াতে পারে। একইভাবে যদি কোনো সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করে সে ক্ষেত্রে জনগণের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস আছে। সবাইকে চিন্তাভাবনা করে চলা প্রয়োজন। আত্মঅহমিকা বিসর্জন দিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার কথা বলেছি। কোনো আদালত বা কোনো মামলা বা কোনো বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে কোনো কথা বলা হয়নি। মূলত রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কাজে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে কী হতে পারে তারই একটা ধারণার কথা বলেছি।
২৯ মে সংসদে আমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। প্রথমেই তিনি বলেছেন আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। আমার উপরিউক্ত কথাগুলোর কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতা কী, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি তাঁর বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, ওই দিন আদালতের বিচারক বলেছেন, ‘আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বিচার বিভাগের কাজে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো চাপ নেই। অথচ স্পিকার সংসদে বলেছেন—আইনমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে সড়ক ভবনের সম্পত্তির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তাঁকে বলা যেত। তাহলে কি স্পিকার মনে করেন আইনমন্ত্রীর নির্দেশে বিচার বিভাগ চলে?’ বিজ্ঞ বিচারপতি আমার বক্তব্য ভালভাবে না শুনে না পড়ে যে মন্তব্য করেছেন তাতে তিনি তাঁর বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে সমর্থ হননি মর্মে অনুমিত হয়। আসলে ওই দিন মাননীয় সংসদ-সদস্য স্পিকারের মাধ্যমে মাননীয় আইনমন্ত্রীর কাছে সড়ক ভবন সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন। মাননীয় আইনমন্ত্রী তখন সংসদে উপস্থিত না থাকায় আমি বিষয়টি সংসদকে অবহিত করি এবং বলি ‘থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটা দেখতেন’। এটুকুই বলেছি। এখানে ‘আইনমন্ত্রীকে সড়ক ভবনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি’—এ ধরনের কোনো কথা বলিনি।
আমার জ্ঞান, মেধা, যোগ্যতা ও আইনজীবী হিসেবে আমার সনদ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। আমি প্রায়শই বলি আমি কম লেখাপড়া জানা মানুষ। ষাটের দশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে, তাঁর সান্নিধ্যে এসে ছাত্র অবস্থায় এ দেশের মানুষের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলাম। রাজনীতির পাশাপাশি আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ ৩৭ বৎসর কাজ করেছি। সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্য হিসেবে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেছি। সাবেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব এম এম রুহুল আমিন, জনাব এ বি এম খায়রুল হক ও বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতির আদালতে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বড় বড় বই হয়তো পড়িনি কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের কথাটি বিগত ৫৪ বছর ধরে পড়ে আসছি। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের কাছ থেকেও আমি সারা জীবন অনেক কিছু শিখেছি। তাঁদের মনের কথাটি পড়তে পারি বলেই হয়তো তাঁদের মনে ঠাঁই পেয়েছি। জনগণ আমাকে সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। গণমানুষের কল্যাণে জনগণের নেওয়া নির্বাচনী পরীক্ষায় বারবার উত্তীর্ণ হয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছি।
দ্বিতীয় বার স্পিকার হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব পেয়েছি। তবে স্পিকার হিসেবে আমি একক কোনো সত্তা নই। এ সংসদের অনেক সদস্য আছেন যাঁরা লেখাপড়ায় উচ্চশিক্ষিত, জ্ঞান গরিমায় আমার চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ। তারপরও সরকারি দল, বিরোধী দল ও অন্যান্য দল আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে স্পিকার নির্বাচিত করেছেন। আমার জ্ঞান, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তা সংসদের সব মাননীয় সদস্যের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ধরনের উক্তি করার আগে বিজ্ঞ বিচারক আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে ভালো করতেন। বিজ্ঞ বিচারক আরও অনেক বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন যা আমি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি না।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
আদালতের মাননীয় বিচারকের মন্তব্যের সূত্র ধরে অনেকেই বিশেষ করে পত্রপত্রিকাগুলো একে সংসদের সঙ্গে বিচার বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে মর্মে উল্লেখ করেছেন। সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে আসলে এটি কোনো বৈরিতা নয়। এটি সংসদ সম্পর্কে জনৈক মাননীয় বিচারপতির কিছু অসৌজন্যমূলক মন্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণপ্রসূত উক্তি। পুরো বিচার বিভাগকে এর সঙ্গে জড়ানো ঠিক হবে না। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে বর্তমানে এ দেশ পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ। আবারও বলছি, বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে রয়েছে ৪০ বছর ধরে গড়ে ওঠা গভীর সম্প্রীতি ও আস্থার সম্পর্ক। পারস্পরিক এ সুসম্পর্কের কারণেই অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এ দেশটি আজ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এবং স্পিকার হিসেবে সব সময় বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একে অপরের পরিপূরক এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন। এ ক্ষেত্রে কর্মপদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে কিন্তু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক—এবং তা হলো সর্বাবস্থায় জনগণের কল্যাণ সাধন। দেশ ও জাতির কল্যাণে এ সম্পর্ক আরও অটুট হোক—এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
৫ জুন ২০১২ তারিখে মাননীয় সংসদ সদস্যরা তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশের এক পর্যায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনপূর্বক উক্ত মাননীয় বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে একটি রেজ্যুলেশন গ্রহণ করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রেরণের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। আপনাদের প্রস্তাবকে আমি সমর্থন করে বিনীতভাবে বলতে চাই, একজন বিচারকের অশোভন আচরণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারে না। এ মহান সংসদের অভিভাবক হিসেবে আরও বলতে চাই, আমরা ১৬ কোটি জনগণের প্রতিনিধিরা একজন ব্যক্তিবিশেষের আচরণ দিয়ে পুরো বিচার বিভাগকে মূল্যায়ন করতে পারি না। আপনারা সবাই সিদ্ধান্ত নিলে আমার জন্য তা bindings হয়ে যায়। সার্বিক বিবেচনায় যেহেতু এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি না, তাই আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করব সংসদে আপনাদের উত্থাপিত প্রস্তাবটি আপনারা আমার সঙ্গে একমত হয়ে প্রত্যাহার করবেন।
আমি আশা করব, মাননীয় বিচারপতির সংসদ-সম্পর্কিত মন্তব্যের বিষয়ে মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিচার বিভাগের মাননীয় বিচারক ও বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ, নির্বাহী বিভাগের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ, সুশীল সমাজের সম্মানিত প্রতিনিধিগণ, সম্মানিত বুদ্ধিজীবী, সম্মানিত সাংবাদিকসহ সব পেশার মানুষ, সর্বোপরি আমার পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় দেশের আপামর জনসাধারণ স্বীয় বিবেচনায় মূল্যায়ন করবেন। একই সঙ্গে বলব, আদালতের এ ধরনের আচরণে কী করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
রাষ্ট্রের ভিত্তি সংবিধান। সংবিধানের মূল স্তম্ভ সংসদ। এই সংসদই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। এই পদ্ধতিতেই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সংবিধান আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সংবিধানকে সমুন্নত রাখব-দেশবাসী এটাই প্রত্যাশা করে।
আশা করি, আমার এ বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে এ আলোচনার অবসান হবে। আপনাদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ।
১৮ জুন, ২০১২
No comments