ধর নির্ভয় গান-সব শেষ হয়ে যায়নি by আলী যাকের

আমি অবশ্য আশাহত নই কোনোকালেই। চরম অত্যাচারের বিরুদ্ধে যখন একটা যুদ্ধ করতে হয়েছে, যখন এত রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ রয়েছে আমাদের, তখন হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমরা পারি না এমন কোনো কাজ নেই। আমাদের সাধারণ মানুষই ঘুরে দাঁড়াবে আবার।


মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত হবে প্রতিবাদে। এই বিষয়টি সম্বন্ধে আমি আরও আশাবাদী হই, যখন আজকের তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকাই। আজকের তরুণ অনেক
বেশি সচেতন


এই শহর! আমার প্রাণের ঢাকা!! এখানে আমার বাস পাঁচ দশকের ওপরে। একটি নগরের মধ্য দিয়ে বহতা নদীর মতোই অনেক সুখ-দুঃখের সঙ্গী আমি এই শহরের। সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই বাকরখানি দিয়ে নাশতা হতো। এই বাকরখানির সঙ্গে থাকত অমৃতি। অমৃতের মতোই স্বাদ যার। অনেকে মনে করেন, জিলাপির ওপরে বাড়তি অলঙ্কার দিয়ে অমৃতি তৈরি করা হয়। মন্তব্যটি সত্যের কাছাকাছি হলেও সর্বৈব সত্য নয়। আমি জানি না এখনও পুরান ঢাকার সেই বিখ্যাত অমৃতি আছে কি-না? যদি পাওয়া যায় তাহলে জিলাপি এবং অমৃতি খেয়ে রসিকজন দেখতে পারেন। আমার মনে হয় ফারাকটা সহজেই ধরা পড়বে। এই নাশতা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে হতো, বিশেষ করে ছুটির দিনে। বড় প্রিয় ছিল আমাদের এবং আমার মায়ের। বাবার শরীরে শর্করার আধিক্য থাকায় তিনি এ রসবঞ্চিত ছিলেন। বড় আদর করে এই ব্যামোটি আমার কাছে তিনি চালান দিয়ে গেছেন ধরাধাম থেকে চলে যাওয়ার আগে। অতএব আমি এখন মিষ্টিবঞ্চিত। আরও মনে পড়ে, সকালে নাশতায় চায়ে ডুবিয়ে গরম গরম ডালপুরি খাবার কথা। মাঝে মধ্যে নেহারি এবং নানরুটি। তখন ঢাকার প্রধান রেলস্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়ায়। সেখানে নেমে পালকি ঘোড়ার গাড়িতে করে আমরা গেণ্ডারিয়ার বাড়ি পর্যন্ত আসতাম। এই ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ানদের নিয়ে বিস্তর গল্প চালু আছে। তাদের মতো রসিক লোক আজকাল আর দেখা যায় না। তবে ওই বিস্তারে এখন যাব না। আরেকদিনের জন্য রাখা রইল। ঢাকার রাস্তাগুলো তখন সরু হলেও ঝকঝকে-তকতকে ছিল, যার ওপর দিয়ে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করা যেত। প্রত্যেক পাড়াতে একাধিক মাঠ কি ময়দান ছিল। জলাভূমি ও পুকুর ছিল, যেসব পুকুরে গ্রীষ্মের প্রদাহে আমরা দুপুরবেলা অবগাহন স্নান করতাম। ঢাকায় রমনা বলে একটি পাড়া ছিল। পাড়াটি এখনও আছে, তবে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে বিভিন্ন নামে নামাঙ্কিত হয়েছে। ওই রমনায় ছিল সবুজের সমারোহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা এলাকার বনায়ন করেছিলেন লন্ডনের বিখ্যাত কিউ গার্ডেন-এর জনৈক রচয়িতা। ঢাকার প্রায় প্রতি রাস্তাতেই একাধিক বটগাছ ছিল, যার ছায়ায় ক্লান্ত পথচারী দু'দণ্ডের শান্তি খুঁজে পেত। আমার সেই শান্তিময় ঢাকা ভালো নেই আজ। ভাবলে বড় কষ্ট হয় বুকে। ছোট্ট শহর ঢাকা আজ মহানগর হয়েছে। মহানগর হয়েছে কেবল আকারে। আর কোনো কিছুতেই নয়। আমার চিরচেনা সুন্দর ঢাকা আজ কুৎসিত পাথরের জঙ্গল। এই মহানগরে নাগরিক সুবিধা বলতে কিছু নেই। অপরিকল্পিত একটি নরক যেন আজকের ঢাকা। এখানে না আছে জল বিতরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা, না জল নিষ্কাশনের। শহরের মধ্যখানের সব খাল ভরাট করে ফেলা হয়েছে। নর্দমা তৈরি করা হয়েছে মাটির তল দিয়ে। সিমেন্টের নর্দমা। আমাদের নিজেদেরই সচেতনতার অভাবে এই নর্দমাগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। ফলে নোংরা পানি বেরোবার আর কোনো পথ পাচ্ছে না। একটি মজার ঘটনা লক্ষ্য করেছি আমি সেই বাল্যকাল থেকেই। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে ব্রিটিশ আমলের পুরনো বিল্ডিংগুলোর ওপরে সংযোজিত হয়েছে নতুন দালান। কিন্তু নিচের এবং ওপরের মধ্যে চেহারার মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই। নিচতলাটি হয়তো লাল ইটের তৈরি আর দ্বিতলটি হয়েছে অতি কুৎসিত হলুদ রঙের। নকশাও ভিন্ন, নিচে গোল, ওপরে চৌকো। নতুন যে ভবনগুলো তৈরি করা হয়েছে, সাধারণত সরকারি আবাসস্থল হিসেবে, সেগুলো আরও কুৎসিত। যেমন আজিমপুর কলোনি অথবা মতিঝিল কলোনি কিংবা ইস্কাটন এলাকার আবাসিক ভবনগুলো? এগুলোর কোনো চরিত্র নেই। আমার মনে হয়, পাকিস্তানি প্রকৌশলীরা মনে করেছিলেন ব্রিটিশরা একরকম নকশা করেছে, তাই তাদের ভিন্ন হতে হবে। ভিন্নতাই যে স্বকীয়তা নয়, বোধকরি এই বিষয়টি তারা জানতেনই না। যেখানে-সেখানে সরকারি ভবন তৈরি করা হয়েছে ওই পাকিস্তানি আমলে। অথবা বাজার গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে ভারি সুন্দর শহর আমাদের, ক্রমেই কুৎসিত হয়ে উঠেছে।
এ তো ছিল পাকিস্তানি আমলের ব্যাপার। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও আমরা এই শহরের প্রতি কম অবিচার করিনি। প্রথমত, একটা সময় ছিল যখন ঢাকায় গাছ কাটার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। অনেক পাঠকেরই হয়তো মনে আছে, শাহবাগ থেকে বাংলামটর পর্যন্ত রাস্তার মাঝখানে ছিল সারিবদ্ধ কৃষ্ণচূড়া বীথি। আমাদের বাংলাদেশে প্রথম সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর একদিন সকালে সব কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোকে শহীদ করে দেওয়া হলো। ওই গাছ থাকলে নাকি নিরাপত্তা বিঘি্নত হয়। বেচারা কৃষ্ণচূড়া কী করে কোনো মানুষের নিরাপত্তা কেড়ে নিতে পারে, সেটি আজও আমার বোধগম্য নয়। এই বাংলাদেশে মানুষকে তো মানুষই মারে। বন্দুকধারী মানুষরা মারে এবং তারা কেউ গাছের ওপরে চড়ে গুলি করে না। ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে মারে।
যা হোক, বেশি সত্য কথা বললে আমাকেই হয়তো মেরে ফেলবে! অবশ্য '৭১ থেকে তো জীবনের অতিরিক্ত সময়ই পার করে চলেছি। সেই একাত্তরেই শেষ হয়ে যেতে পারতাম তো! আমরা দেখেছি, অতি সহজে অর্থোপার্জনের লোভ মানুষকে কোথায় নিয়ে গেছে। এই শহরের যত্রতত্র খালি জমি দখল করে সেখানে কুৎসিত সব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দেশটিকে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছে 'এক শহর'-এর দেশে। অতএব, দেশের সবদিক থেকে মানুষ এসে জড়ো হয়েছে এখানে। গড়ে উঠেছে অস্বাস্থ্যকর, কদর্য, কুৎসিত সব বস্তি। অভাব দেখা দিয়েছে পানির, বিদ্যুতের এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার। আমার প্রাণের শহর বাসযোগ্যতা হারিয়েছে ক্রমে। অবশ্য সব খারাপেরই একটা ভালো দিক আছে। আজকের চিন্তাশীল মানুষরা, আজকের গণমাধ্যম, বিশেষ করে পত্রপত্রিকা প্রতিবাদ করছে। জেগে উঠেছে চিন্তাশীল মানুষ। জেগে উঠেছে কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে। অরাজকতা ক্রমেই শ্লথ হয়ে এসেছে। ধন্যবাদ জানাই এই মুষ্টিমেয় প্রতিবাদী গণমাধ্যমকে।
আমি অবশ্য আশাহত নই কোনোকালেই। চরম অত্যাচারের বিরুদ্ধে যখন একটা যুদ্ধ করতে হয়েছে, যখন এত রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ রয়েছে আমাদের, তখন হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমরা পারি না এমন কোনো কাজ নেই। আমাদের সাধারণ মানুষই ঘুরে দাঁড়াবে আবার। মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত হবে প্রতিবাদে। এই বিষয়টি সম্বন্ধে আমি আরও আশাবাদী হই, যখন আজকের তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকাই। আজকের তরুণ অনেক বেশি সচেতন। আজকের দুর্বৃত্তরা এই তরুণদের চেতনা নস্যাৎ করতে পারেনি, করতে পারবে না।
সেদিন শুক্রবারে, গ্রীষ্মের দুপুরের তাপকে অগ্রাহ্য করে আমি ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছিলাম। হাঁটছিলাম রমনা এলাকা দিয়ে। হঠাৎ সচকিত হয়ে লক্ষ্য করলাম মাথার ওপরে কৃষ্ণচূড়া রাঙিয়ে দিয়েছে আকাশ, সোনালুর হলুদ কিংবা জারুলের বেগুনি। ভাবলাম, আরে! এই তো সেই আমার চিরচেনা ঢাকা। এখনও তো সম্ভব ঢাকার পুনর্বিন্যাস। সেদিন রাতে রমনা পার্কের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নাকে এলো নানারকম জানা-অজানা উদ্ভিদের গুণগন্ধ। ভাবলাম, এখনও সব হারিয়ে যায়নি হয়তো। কয়েকদিন আগে ভারতীয় শিল্পী রশিদ খানের খেয়াল শুনছিলাম বাগেশ্রী রাগে। কয়েকশ' মানুষ তার শুদ্ধ সঙ্গীতের সৃষ্ট আবেশে বুঁদ হয়ে গান শুনছিলেন। আমি ভাবছিলাম, এখনও শেষ হয়ে যায়নি আমাদের রুচি, যত বড় আঘাতই আসুক তার ওপর। তারও কিছুদিন আগে পণ্ডিত যশরাজের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে উপস্থিত ছিলাম আমি। তিনি গান শেষ করলেন এবং সকলের করতালির জবাবে বললেন, 'জয় হো'। হঠাৎ শুনলাম হলের পেছনে কিছু তরুণের কণ্ঠ নিঃসৃত স্লোগান যেন। তারপর লক্ষ্য করলাম, ২০-২৫ জন তরুণ সমস্বরে 'জয় হো' বলতে বলতে এগিয়ে এলেন মঞ্চের দিকে। শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন যশরাজকে। তারপর চলে গেলেন 'জয় হো' বলতে বলতে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। তারা যতদিন আছে, আমার ঢাকার আশা আছে। দুর্বৃত্তদের ঝুঁটি ধরে তারা নাড়াবে। তাদের কুকর্মের হবে অবসান। আমার ঢাকা শেষ হয়ে যায়নি। শেষ হয়ে যেতে পারে না। আজকের তরুণের হাত ধরে ঢাকা আবার বলিষ্ঠ পদক্ষেপে সব সুরুচিকে বক্ষে ধারণ করে এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। জয় হোক ঢাকার।

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.