কারখানা বন্ধ রাখলে মালিক-শ্রমিক উভয়েরই ক্ষতি by ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান

আশুলিয়ায় গার্মেন্টগুলো বন্ধ ঘোষণা দুঃখজনক। কারখানা বন্ধ করে দিলে কোনো পক্ষেরই উপকার হয় না, বরং মালিক-শ্রমিক উভয়েরই ক্ষতি। তাহলে ক্ষতিকর কাজটির মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান কি সম্ভব? কারখানা বন্ধ করে দিলে সংশয়, সন্দেহ, অনিশ্চয়তা ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে।


আর এই ভুল বোঝাবুঝি থেকে তৃতীয় একটি পক্ষ ষড়যন্ত্রের গুজব ছড়াবে। কোনো ধরনের নেতিবাচক গুজব কাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ গুজব বা মিথ্যা প্রচারণা ইউরোপ ও আমেরিকার কূটনীতিকদের কানে যাচ্ছে। যাঁরা আমাদের দেশে রয়েছেন। এতে তাঁদের মনেও একটি ভুল ধারণা জন্ম নিতে পারে। আমরা যখন নিজেরাই বলতে থাকব- উদ্ভূত উচ্ছৃঙ্খল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির কারণে বাজার হারানোর আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন ওই সব কূটনীতিক এ গুজব বা আশঙ্কার পেছনে কিছু একটার অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে চাইবেন। তাই 'ষড়যন্ত্র চলছে'- এসব ভিত্তিহীন কথাকে ভিত্তি তৈরি করে দেওয়ার আগে দৃশ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।
শ্রমিকদের যেসব বাস্তব সমস্যা দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে প্রধান কারণই বাড়িভাড়া ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। আশুলিয়ার কারখানা শ্রমিকরা যে এলাকায় বসবাস করে, সেখানে গত ছয় মাসে তিনবার বাড়িভাড়া বেড়েছে। বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্তরাও হাঁসফাঁস করছে। এ অবস্থায় এই স্বল্প আয়ের শ্রমিকদের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে, তা উপলব্ধি করতে ধৈর্য ও নূ্যনতম দরদ থাকা দরকার। ২০১০ সালে শ্রমিকের বেতন বেড়েছিল আন্দোলন ও অনেক আলোচনা-সমালোচনা এবং সরকারের মধ্যস্থতার মধ্য দিয়ে। তারপর দুই বছরে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার হার কত, সে হিসাবের সঙ্গে অযৌক্তিক বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার যোগ করলে দেখা যাচ্ছে, শ্রমিকদের জীবন অচল হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য কেনার টাকাও থাকছে না।
আমরা জানি, মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে বাধাহীন ও মুক্তভাবে। তাই আমরা প্রস্তাব করেছিলাম শ্রমিকদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মূল্যবৃদ্ধির হার অনুযায়ী শ্রমিকদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে শ্রমিকরা বাঁচবে। অন্যদিকে মালিকরাও রেহাই পাবেন কিছুদিন পর পর বেতন বৃদ্ধির চাপ থেকে। এতে প্রকৃত মজুরি রক্ষা পায়। মালিকপক্ষও ঝামেলামুক্ত থাকে। 'ষড়যন্ত্রকারীরাও' সুযোগ পাবে না, কেউ কারো কথা শোনে না, আলোচনায় বসার পরিস্থিতি থাকে না, শ্রমিক পক্ষের কথা বলার কোনো সংগঠন নেই। ফলে নির্বাচিত কোনো বৈধ নেতা-নেত্রীও নেই। পোশাক শিল্প একটি শ্রমঘন শিল্প। লাখ লাখ শ্রমিক। অসংখ্য সমস্যা সৃষ্টি হয়, হতে পারে। অথচ তাদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই। শোনারও কেউ নেই বা কোনো বিশ্বাসযোগ্য ও জবাবদিহিমূলক সংগঠন বা নেতৃত্ব নেই। বিশৃঙ্খলার মূল কারণও তাই। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে যখন, তখন আর ঘরে বসে সমস্যা সমাধানের পরিস্থিতি থাকে না।
আমি মনে করি, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার না দেওয়ায়ই দিন দিন গার্মেন্টগুলোর সমস্যা নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে মালিক-শ্রমিকের যোগসূত্র থাকে। কথা বলা, শোনা এবং সমস্যার সমাধান করার যৌক্তিক ও বিধিসম্মত পথ থাকে। এতে শ্রমিকেরও জবাবদিহিতা থাকে। শুধু অভিযোগ করলেই চলবে না। ইচ্ছা করলেই রাস্তায় নামা সম্ভব হবে না তখন। এতে গার্মেন্ট শিল্পের সুন্দর পরিবেশ ও উত্তরোত্তর বিকাশের সম্ভাবনা নিশ্চিত হতে পারবে। আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখতে
অনুরোধ করছি।
গ্রন্থনা : লুৎফর রহমান রনো

No comments

Powered by Blogger.