প্রতিক্রিয়া-পোশাক নয়, কৌপীনটাই আসল by অসীম সাহা
কবি-সাংবাদিক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘কৌপীন নয়, পোশাকটাই আসল’ শিরোনামে একটি চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। তিনি তাঁর লেখাটি শুরু করেছেন একজন সিদ্ধপুরুষের প্রতারণার কাহিনি দিয়ে এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সময়ের রাজনীতি, সরকার, সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও বিরোধী দলের নেত্রী ও তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কেও কিছু কথা বলেছেন।
তিনি প্রথমেই একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি আধ্যাত্মিক সাধনার চেয়ে কিছুমাত্র কম কষ্টসাধ্য নয়। রাষ্ট্র যেহেতু কোটি কোটি লোকের কারবার, তাই তা ঠিকঠাকভাবে চালানো অসাধারণ দক্ষতা ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের সেই সিদ্ধপুরুষের মতো (আসলে প্রতারক) হলে শেষরক্ষা হওয়া তো দূরে কথা—কোনো রকমে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় উপায় থাকে না। টাইট করে কৌপীন পরা নিয়ে কসরত করতেই যাঁদের সময় পার হয়, তাঁরা লক্ষ্যে পৌঁছার সময় পেতেই পারেন না।’
সত্যিই তাই। আমাদের কিছু নেতা, পাতিনেতা, মন্ত্রী, উপদেষ্টা সব সময় আত্মপ্রচার, স্তাবকতা এবং ভারসাম্যহীন কথাবার্তা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে তাঁদের পক্ষে সাধনা করা তো দূরের কথা, কারও কারও পক্ষে এই সাধনা করেও এসব পদে অধিষ্ঠিত থাকার অধিকার আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠলে তাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। ছোটখাটো মন্ত্রীদের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাঁদের উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন, তাঁরা কী সাধনা করেন এবং কী ধরনের উপদেশ দেন, তা মোদাচ্ছের আলীর মতো লোকদের কথাবার্তা শুনলেই সহজে বোঝা যায়। মুশকিলটা হলো, যাঁর কাজ প্রধানমন্ত্রীকে যথার্থ উপদেশ দেওয়া, তিনিই যখন বালখিল্য উক্তি করে নিজেদের সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকেই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেন, তখন সন্দেহ জাগে মোদাচ্ছের আলীর মতো লোকেরা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দেওয়া তো দূরের কথা, রাজনীতি কিংবা কূটনীতির সামান্যতম কিছু বোঝেন কি না। তিনি প্রকাশ্যে, সাংবাদিকদের সামনে স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাড়ে ১৩ হাজার জনকে কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে যে নিয়োগ দেওয়া হবে, তার মধ্যে ‘১৩ হাজার ৫০০ পোস্টের একটাও (আল্লাহর ইচ্ছায় দু-একটা যেতে পারে) যাতে আমাদের দলের বাইরে না হয়, পরীক্ষিত কর্মীরা পায়, সেই জন্য আমি মোটামুটি একটা সিস্টেম করছি। আমি তো আমার অফিসারকে বলে দেব, আমার লোককে চাকরি দিতে হবে।’ এই কথা বলে যে অর্বাচীনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা এই সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য যথেষ্ট।
উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পরে সৈয়দ আবুল মকসুদ যতই বলুন, ‘কৌপীন নয়, পোশাকটাই আসল’, ততই আমার মনে হচ্ছে, আসলে ‘পোশাক নয়, কৌপীনটাই আসল’।
আবুল মকসুদ যে খুব মৃদু ও ভদ্র ভাষায় নাপাক শরীরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ না করার কথা বলেছেন, আমার তো মনে হয়, সে কথা বলারও কোনো সুযোগ নেই। কেননা, এই কথার পর শরীর নাপাক হলো না পাক হলো, তাতেই বা কী এসে যায়! যারা মেধাসম্পন্ন, যারা রাজনীতি করে না, যারা রাজনীতিবিদদের কূটকচাল বোঝে না, সেসব মেধাসম্পন্ন প্রার্থীর তা হলে কী হবে? দেশে যে সংবিধান আছে, যে নিয়মকানুন, বিধিবিধান আছে, তার কোনো রকম তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রীর কোনো একজন উপদেষ্টা এ ধরনের কথা বলতে পারেন, এটা ভাবতেই অবাক লাগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারকে ডোবানোর জন্য তাঁরা যে ধরনের লাগামহীন ‘সার্ভিস’ দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে সরকারের ভরাডুবির পথ উন্মুক্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে যাঁদের মনে সংশয়ের উদয় হয়েছে, তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, আমার ধারণা, তিনি চুপ করে বসে নেই। সময়মতো তিনি তাঁর সঠিক ভূমিকাই পালন করবেন, এটা আমার স্থির বিশ্বাস। কেন, ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক আওয়ামী লীগের নেতা ইব্রাহিমের হত্যাকাণ্ডে সাংসদ শাওনের জড়িত থাকা না-থাকার ব্যাপারে বেফাঁস মন্তব্য করে কী পরিণতি বরণ করেছেন, তা থেকেই কি প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা স্পষ্ট হয় না? যাঁরা এ ব্যাপারে সমালোচনা করেন, তাঁদেরও আয়নায় নিজেদের মুখটা একটু ভালো করে দেখে নিতে বলি। আর যাঁদের নিয়ে সমালোচকদের চিন্তা, তাঁরা তো জ্ঞানপাপী। জেনে-শুনেই তাঁরা নিজেরা বিষ পান না করে তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গলায় তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর বিএনপি তো সুযোগের অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মতো হাঁ করে বসেই আছে। প্রতি মুহূর্তেই বিরোধী দলের নেত্রী, মহাসচিব (তাঁরা সভানেত্রী কিংবা সাধারণ সম্পাদক বলেন না, বলেন চেয়ারপারসন, মহাসচিব। কারণ শব্দ দুটি বাংলা নয়, বাংলার প্রতি যে তাঁদের যমের চেয়েও বেশি অরুচি) এবং তাঁদের নেতা-নেত্রীরা এই সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। আর সেই হুমকির আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন মোদাচ্ছের আলীরা। কিন্তু এই উপদেষ্টাকে সমালোচনা করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ সব দায়টা চাপিয়ে দিয়েছেন বর্তমান সরকারের কাঁধে। তিনি যে বলেছেন, ‘এভাবে যারা (এখানে তাঁর বহুবচন ব্যবহার করা উচিত হয়নি) নিজেদের লোকদের চাকরি দেয়, তাদের যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, তাকে (হবে তাদের) গণতান্ত্রিক সরকার বলে না—তা (হবে তারা) গণতন্ত্রের কলঙ্ক।’
আসলে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রবচনটা এই সরকারের ওপর প্রয়োগ করে আবুল মকসুদের মতো লেখকেরা খুব একটা বাহাদুরির কাজ করেন বলে মনে করেন। দল বা সরকারের দু-চারজন অর্বাচীন লোকের জন্য সব দোষ সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কি যুক্তিসংগত? তিনি তাঁর লেখায় যখন বললেন, ‘স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বাজিমাতের পরই বাজি (শ্রদ্ধেয় বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান) ফাটালেন। তার মানে অনেকক্ষণ ধরে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সমালোচনা করে তাঁকে ‘বাজিমাত’ করার সুযোগ দিয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রশংসাই করে বসলেন।
আমি বলি কি, সরকার অন্যায় কাজ করে থাকলে তাদের সমালোচনা করুন, কিন্তু সত্যি যদি এই দেশের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকেন, তা হলে এমন কথা বলবেন না, যা নিজের জ্ঞানের বহর এবং রাজনীতির যথার্থতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং মৌলবাদীরা তার সুযোগ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বর্তমান সরকারকে কোনো বেকায়দায় ফেলতে পারে।
অবশ্য একটা ব্যাপারে আমি সৈয়দ আবুল মকসুদকে ধন্যবাদ দিতে চাই, তিনি অন্তত অন্যদিকেরও একটি সত্য কথা বলেছেন, ‘সবার কথাই বললাম, একটি পদের কথা বাদ পড়েছে। সেটি হলো পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা। আমাদের দেশে এই পদটি তুলে দিলেই ভালো ছিল। আমাদের গণতন্ত্রে এই একটি মাত্র পদ, যার কোনো কাজ নেই। রাষ্ট্র তাঁকে অফিস ও লোকজন সবই দিয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রকে দেওয়ার মতো কোনো কাজ তাঁর নেই। তিনি দলের কাজ করেন মধ্যরাত পর্যন্ত, দলীয় নেতাদের উপদলীয় কোন্দল মেটান, কিন্তু ঘণ্টা দুই দেশের কাজ করার ফুরসত পান না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে গুরুত্বের দিক থেকে বিরোধী দলের নেতার স্থান প্রধানমন্ত্রীর পরেই।’
সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখার মধ্যে অনেক সত্য লুকিয়ে আছে, যাকে আমি পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করি। কিন্তু লেখাটি লিখতে গিয়ে তিনি এক রান্নায় সব মসলা ব্যবহারের যে চেষ্টা করেছেন, তাতে লেখাটি অনেকটাই বিস্বাদ হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে।
তা হোক, তবু কতগুলো অনিবার্য সত্যের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনি সরকার এবং বিরোধী দল উভয়কে সতর্ক করার যে চেষ্টা করেছেন, তাকে সাধুবাদ জানাই। তবে এ প্রসঙ্গে আমি তাঁকে একটা অনুরোধ করি, একটু ধৈর্য ধরুন না, দেখুন প্রধানমন্ত্রী কী করেন? তা না করে আগেই যদি ধনুকের সব তীর একবারেই ফুরিয়ে ফেলেন, তা হলে ভবিষ্যতে তো কোনো আক্রমণই শাণাতে পারবেন না। সেটা কি একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের কাজ হতে পারে?
অবশ্য আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই, আবুল মকসুদ কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এ কথাগুলো বলার চেষ্টা করেননি। যদি তা-ই হতো, তা হলে তিনি কিছুতেই বলতে পারতেন না, ‘রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য মন্ত্রী, উপমন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রীর কথা তিনি ভুলে গেছেন), উপদেষ্টা, সচিব, রাষ্ট্রদূত ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ পাঁচ-ছয় শ মানুষ দায়ী। সব দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে যে যা খুশি তা-ই করবেন, জনগণ তা মেনে নেবেন না।’
না, আবুল মকসুদ শুধু জনগণই নয়, আমি যতটুকু বুঝেছি, তাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এটা মেনে নেবেন না। এই জাতীয় লোকদের যে তিনি অচিরেই শায়েস্তা করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। অতএব দেখুন, পড়ুন এবং তারপর লিখুন। দেখবেন, সবকিছু পরিপূর্ণভাবে না হোক, অন্তত অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে চলছে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখার চমৎকার শিরোনামটির উল্লেখ করে এবং তাঁর শিরোনামটিকে একটু ঘুরিয়ে দিয়ে। কেন বলেছিলাম, একটু খোলাসা করেই বলি। আবুল মকসুদ যে বলেছেন, ‘কৌপীন নয়, পোশাকটাই আসল’, তা-ই যদি সত্যি হয়, তা হলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পরনেও তো পোশাকই ছিল, তার পরও একজন পোশাকহীন মানুষের মতো তিনি ওই ধরনের কথাগুলো বলতে গেলেন কেন? আসলে শরীরে পোশাক থাকলেই হয় না, আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে অনেক সুন্দর মনে হলেও তাঁর পেছনে যে কুৎসিত চেহারাটা ঢাকা পড়ে থাকে, কৌপীনঅলাদের কিন্তু তা থাকে না। তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ গান্ধীজি, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, এমনকি হাল আমলের সৈয়দ আবুল মকসুদও। তা হলে?
অসীম সাহা: কবি ও সাংবাদিক
asimsaha1949@gmail.com
সত্যিই তাই। আমাদের কিছু নেতা, পাতিনেতা, মন্ত্রী, উপদেষ্টা সব সময় আত্মপ্রচার, স্তাবকতা এবং ভারসাম্যহীন কথাবার্তা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে তাঁদের পক্ষে সাধনা করা তো দূরের কথা, কারও কারও পক্ষে এই সাধনা করেও এসব পদে অধিষ্ঠিত থাকার অধিকার আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠলে তাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। ছোটখাটো মন্ত্রীদের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাঁদের উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন, তাঁরা কী সাধনা করেন এবং কী ধরনের উপদেশ দেন, তা মোদাচ্ছের আলীর মতো লোকদের কথাবার্তা শুনলেই সহজে বোঝা যায়। মুশকিলটা হলো, যাঁর কাজ প্রধানমন্ত্রীকে যথার্থ উপদেশ দেওয়া, তিনিই যখন বালখিল্য উক্তি করে নিজেদের সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকেই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেন, তখন সন্দেহ জাগে মোদাচ্ছের আলীর মতো লোকেরা প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দেওয়া তো দূরের কথা, রাজনীতি কিংবা কূটনীতির সামান্যতম কিছু বোঝেন কি না। তিনি প্রকাশ্যে, সাংবাদিকদের সামনে স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাড়ে ১৩ হাজার জনকে কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে যে নিয়োগ দেওয়া হবে, তার মধ্যে ‘১৩ হাজার ৫০০ পোস্টের একটাও (আল্লাহর ইচ্ছায় দু-একটা যেতে পারে) যাতে আমাদের দলের বাইরে না হয়, পরীক্ষিত কর্মীরা পায়, সেই জন্য আমি মোটামুটি একটা সিস্টেম করছি। আমি তো আমার অফিসারকে বলে দেব, আমার লোককে চাকরি দিতে হবে।’ এই কথা বলে যে অর্বাচীনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা এই সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য যথেষ্ট।
উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পরে সৈয়দ আবুল মকসুদ যতই বলুন, ‘কৌপীন নয়, পোশাকটাই আসল’, ততই আমার মনে হচ্ছে, আসলে ‘পোশাক নয়, কৌপীনটাই আসল’।
আবুল মকসুদ যে খুব মৃদু ও ভদ্র ভাষায় নাপাক শরীরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ না করার কথা বলেছেন, আমার তো মনে হয়, সে কথা বলারও কোনো সুযোগ নেই। কেননা, এই কথার পর শরীর নাপাক হলো না পাক হলো, তাতেই বা কী এসে যায়! যারা মেধাসম্পন্ন, যারা রাজনীতি করে না, যারা রাজনীতিবিদদের কূটকচাল বোঝে না, সেসব মেধাসম্পন্ন প্রার্থীর তা হলে কী হবে? দেশে যে সংবিধান আছে, যে নিয়মকানুন, বিধিবিধান আছে, তার কোনো রকম তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রীর কোনো একজন উপদেষ্টা এ ধরনের কথা বলতে পারেন, এটা ভাবতেই অবাক লাগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারকে ডোবানোর জন্য তাঁরা যে ধরনের লাগামহীন ‘সার্ভিস’ দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে সরকারের ভরাডুবির পথ উন্মুক্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে যাঁদের মনে সংশয়ের উদয় হয়েছে, তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, আমার ধারণা, তিনি চুপ করে বসে নেই। সময়মতো তিনি তাঁর সঠিক ভূমিকাই পালন করবেন, এটা আমার স্থির বিশ্বাস। কেন, ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক আওয়ামী লীগের নেতা ইব্রাহিমের হত্যাকাণ্ডে সাংসদ শাওনের জড়িত থাকা না-থাকার ব্যাপারে বেফাঁস মন্তব্য করে কী পরিণতি বরণ করেছেন, তা থেকেই কি প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা স্পষ্ট হয় না? যাঁরা এ ব্যাপারে সমালোচনা করেন, তাঁদেরও আয়নায় নিজেদের মুখটা একটু ভালো করে দেখে নিতে বলি। আর যাঁদের নিয়ে সমালোচকদের চিন্তা, তাঁরা তো জ্ঞানপাপী। জেনে-শুনেই তাঁরা নিজেরা বিষ পান না করে তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গলায় তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর বিএনপি তো সুযোগের অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মতো হাঁ করে বসেই আছে। প্রতি মুহূর্তেই বিরোধী দলের নেত্রী, মহাসচিব (তাঁরা সভানেত্রী কিংবা সাধারণ সম্পাদক বলেন না, বলেন চেয়ারপারসন, মহাসচিব। কারণ শব্দ দুটি বাংলা নয়, বাংলার প্রতি যে তাঁদের যমের চেয়েও বেশি অরুচি) এবং তাঁদের নেতা-নেত্রীরা এই সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। আর সেই হুমকির আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন মোদাচ্ছের আলীরা। কিন্তু এই উপদেষ্টাকে সমালোচনা করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ সব দায়টা চাপিয়ে দিয়েছেন বর্তমান সরকারের কাঁধে। তিনি যে বলেছেন, ‘এভাবে যারা (এখানে তাঁর বহুবচন ব্যবহার করা উচিত হয়নি) নিজেদের লোকদের চাকরি দেয়, তাদের যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, তাকে (হবে তাদের) গণতান্ত্রিক সরকার বলে না—তা (হবে তারা) গণতন্ত্রের কলঙ্ক।’
আসলে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রবচনটা এই সরকারের ওপর প্রয়োগ করে আবুল মকসুদের মতো লেখকেরা খুব একটা বাহাদুরির কাজ করেন বলে মনে করেন। দল বা সরকারের দু-চারজন অর্বাচীন লোকের জন্য সব দোষ সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কি যুক্তিসংগত? তিনি তাঁর লেখায় যখন বললেন, ‘স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বাজিমাতের পরই বাজি (শ্রদ্ধেয় বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান) ফাটালেন। তার মানে অনেকক্ষণ ধরে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সমালোচনা করে তাঁকে ‘বাজিমাত’ করার সুযোগ দিয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রশংসাই করে বসলেন।
আমি বলি কি, সরকার অন্যায় কাজ করে থাকলে তাদের সমালোচনা করুন, কিন্তু সত্যি যদি এই দেশের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকেন, তা হলে এমন কথা বলবেন না, যা নিজের জ্ঞানের বহর এবং রাজনীতির যথার্থতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং মৌলবাদীরা তার সুযোগ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বর্তমান সরকারকে কোনো বেকায়দায় ফেলতে পারে।
অবশ্য একটা ব্যাপারে আমি সৈয়দ আবুল মকসুদকে ধন্যবাদ দিতে চাই, তিনি অন্তত অন্যদিকেরও একটি সত্য কথা বলেছেন, ‘সবার কথাই বললাম, একটি পদের কথা বাদ পড়েছে। সেটি হলো পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা। আমাদের দেশে এই পদটি তুলে দিলেই ভালো ছিল। আমাদের গণতন্ত্রে এই একটি মাত্র পদ, যার কোনো কাজ নেই। রাষ্ট্র তাঁকে অফিস ও লোকজন সবই দিয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রকে দেওয়ার মতো কোনো কাজ তাঁর নেই। তিনি দলের কাজ করেন মধ্যরাত পর্যন্ত, দলীয় নেতাদের উপদলীয় কোন্দল মেটান, কিন্তু ঘণ্টা দুই দেশের কাজ করার ফুরসত পান না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে গুরুত্বের দিক থেকে বিরোধী দলের নেতার স্থান প্রধানমন্ত্রীর পরেই।’
সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখার মধ্যে অনেক সত্য লুকিয়ে আছে, যাকে আমি পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করি। কিন্তু লেখাটি লিখতে গিয়ে তিনি এক রান্নায় সব মসলা ব্যবহারের যে চেষ্টা করেছেন, তাতে লেখাটি অনেকটাই বিস্বাদ হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে।
তা হোক, তবু কতগুলো অনিবার্য সত্যের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনি সরকার এবং বিরোধী দল উভয়কে সতর্ক করার যে চেষ্টা করেছেন, তাকে সাধুবাদ জানাই। তবে এ প্রসঙ্গে আমি তাঁকে একটা অনুরোধ করি, একটু ধৈর্য ধরুন না, দেখুন প্রধানমন্ত্রী কী করেন? তা না করে আগেই যদি ধনুকের সব তীর একবারেই ফুরিয়ে ফেলেন, তা হলে ভবিষ্যতে তো কোনো আক্রমণই শাণাতে পারবেন না। সেটা কি একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের কাজ হতে পারে?
অবশ্য আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই, আবুল মকসুদ কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এ কথাগুলো বলার চেষ্টা করেননি। যদি তা-ই হতো, তা হলে তিনি কিছুতেই বলতে পারতেন না, ‘রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য মন্ত্রী, উপমন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রীর কথা তিনি ভুলে গেছেন), উপদেষ্টা, সচিব, রাষ্ট্রদূত ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ পাঁচ-ছয় শ মানুষ দায়ী। সব দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে যে যা খুশি তা-ই করবেন, জনগণ তা মেনে নেবেন না।’
না, আবুল মকসুদ শুধু জনগণই নয়, আমি যতটুকু বুঝেছি, তাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এটা মেনে নেবেন না। এই জাতীয় লোকদের যে তিনি অচিরেই শায়েস্তা করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। অতএব দেখুন, পড়ুন এবং তারপর লিখুন। দেখবেন, সবকিছু পরিপূর্ণভাবে না হোক, অন্তত অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে চলছে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখার চমৎকার শিরোনামটির উল্লেখ করে এবং তাঁর শিরোনামটিকে একটু ঘুরিয়ে দিয়ে। কেন বলেছিলাম, একটু খোলাসা করেই বলি। আবুল মকসুদ যে বলেছেন, ‘কৌপীন নয়, পোশাকটাই আসল’, তা-ই যদি সত্যি হয়, তা হলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পরনেও তো পোশাকই ছিল, তার পরও একজন পোশাকহীন মানুষের মতো তিনি ওই ধরনের কথাগুলো বলতে গেলেন কেন? আসলে শরীরে পোশাক থাকলেই হয় না, আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে অনেক সুন্দর মনে হলেও তাঁর পেছনে যে কুৎসিত চেহারাটা ঢাকা পড়ে থাকে, কৌপীনঅলাদের কিন্তু তা থাকে না। তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ গান্ধীজি, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, এমনকি হাল আমলের সৈয়দ আবুল মকসুদও। তা হলে?
অসীম সাহা: কবি ও সাংবাদিক
asimsaha1949@gmail.com
No comments