সময়ের প্রতিধ্বনি-আশার ছলনে ভোলানো যাবে না by মোস্তফা কামাল
যদি প্রশ্ন করা হয়, এ মুহূর্তে দেশে প্রধান সমস্যা কী? সবাই এক কথায় বলবেন, দ্রব্যমূল্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ ঊর্ধ্বমুখী গতিকে কিছুতেই নিম্নমুখী করা যাচ্ছে না। শুরুতে আমরা বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানকে অনেক দৌড়ঝাঁপ দিতে দেখেছি। বাজারে বাজারে ঘুরে সস্তা প্রচার নিতে দেখেছি।
বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক বক্তৃতা-বিবৃতিও শুনেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম থাকলেও আমাদের এখানে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। একবার দাম বাড়াতে পারলেই হলো। সেই দাম আর কমে না।
হঠাৎ হঠাৎ একেকটা জিনিসের দাম বেড়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিনিসপত্রের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ বাজার সিন্ডিকেট। সরকারের পক্ষ থেকে এ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হলেও ব্যবসায়ীদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না। বরং তাদের সিন্ডিকেট আরো জোরদার হয়েছে। সরকারের নির্দেশ তারা থোড়াই কেয়ার করছে। এর কারণও আছে। বাণিজ্যমন্ত্রী ধমক দিয়ে ব্যবসায়ীদের সোজা করতে চেয়েছিলেন। এখনকার যুগে ধমক দিলে হিতে বিপরীত হয়। তার পরও কেন ফারুক খান সে কাজটি করতে গেলেন তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
অনেক সময়ই দেখা গেছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ফারুক খান চাল, তেল, চিনি প্রভৃতির দাম বেঁধে দেন। এতে জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়ে। এ কারণে অনেকে মনে করেন, ফারুক খানের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আঁতাত রয়েছে। তা ছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙার ব্যাপারে বারবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান অনেক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট তাঁরা ভাঙতে পারেননি। আসলে তাঁরা যে পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন সেটা মোটেও সঠিক পথ নয়। এখানে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে এগোতে হবে। ব্যবসায়ীদের খেপিয়ে তুলে সমস্যার সমাধান হবে না, বরং সমস্যা আরো প্রলম্বিত হবে।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে, তাদের মুনাফাখোরী মনোভাব। দ্রুত বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার আশায় তাঁরা বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। তাঁরা দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভাবেন না। তাঁরা কেবল নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবেন। এই অতি মুনাফাখোরী ব্যবসায়ীদের একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। এটা নতুন করে গজিয়ে ওঠেনি। এ সিন্ডিকেট বিএনপির আমলেও ছিল, এখনো আছে। আরো আছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। এদের কারণে ক্রেতারা ঠকছে। দেশের কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে পারে না।
আমরা জানি, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, ক্ষমতায় যেতে পারলে তারা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে। মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু মানুষের সেই আশা দুরাশায় পরিণত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সব সময়ই দাবি করে, এ দলটি জনগণের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা দল। এ দলটি জনগণের দুঃখ-বেদনা টের পায়। আওয়ামী লীগই সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াবে, মানুষের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। এখনো আওয়ামী লীগের ওপর সাধারণ মানুষের এ আস্থাটুকু রয়েছে। সেই আস্থার যেন অপমৃত্যু না ঘটে।
প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আমরা গত শুক্রবার কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে জনমত যাচাই করেছিলাম। পরের দিন শনিবার তা পূর্ণপৃষ্ঠা ছাপা হয়েছে। তাতে পাঠকরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। পাঠকরা বলেছেন, সিন্ডিকেটের ফাঁদ ভাঙতে হবে, খাদ্যমূল্য নাগালের মধ্যে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুদদারি রোধ করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূমিহীনদের ভূমি প্রদান এবং বৈজ্ঞানিক কৃষিব্যবস্থা চালু করতে হবে। একই সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হার রোধ করতে হবে। পাঠকদের এ পরামর্শগুলো যদি কার্যকর করা যায় তাহলে খাদ্যদ্রব্যের দাম নিয়ে যে টালবাহানা চলছে তা কিছুটা হলেও কমবে। সরকার এ বিষয়গুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।
খাদ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকার ইতিমধ্যেই দেশে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি শুরু করেছে। সরকারের এ উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। তবে এর ফলে বাজারে যে প্রভাব পড়ার কথা তা কিন্তু পড়েনি। তবে ন্যায্যমূল্যে চাল কেনার লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়িয়ে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকায় নিম্নবিত্তদের সঙ্গে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা লাইনে দাঁড়িয়ে চাল কিনছে। এটা ঠিক, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এখন আর আগের মতো মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়ার এ গতি অব্যাহত থাকলে হয়তো কেনার ক্ষমতাও থাকবে না। ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি অব্যাহত রাখার মাধ্যমে বাজারে প্রভাব ফেলতে হবে।
এ মুহূর্তে দেশে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। যতই দিন যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের বেফাঁস কথার পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। এখন তিনি বলছেন, সব মানুষের নিরাপত্তা সরকার দিতে পারবে না। জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি তা না পারেন তাহলে দায় স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরে যেতে পারেন। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আছেন, যাঁরা যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত! তা ছাড়া বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার না করে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অস্বীকার করলে কোনো দিনও সমস্যার সমাধান হবে না।
আর বিলম্ব না করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। জেলা ও থানা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-পাতিনেতারা। এসব নেতা-পাতিনেতা পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছেন বলেই তারা এর সুযোগ নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে তাদের আগ্রহ কম। পুলিশ বাহিনীতে এক ধরনের গা-ছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে মানুষ ফুঁসে উঠবে। এ দেশের মানুষ একবার খেপে গেলে তাকে দাবিয়ে রাখা খুব কঠিন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সচেতন হওয়া উচিত এবং সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই অতীতের কথা ভুলে যাননি। বিগত আওয়ামী লীগ মরকারের আমলে তিনি যদি দলীয় কিছু লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন তাহলে আবারও আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হতো। সেটা পারেনি বলেই প্রতিপক্ষরা তার সুযোগ নিয়েছে। এবার আগে থেকে সতর্ক না হলে কিছু দলীয় লোকের কারণে আওয়ামী লীগকে খেসারত দিতে হবে।
আরেকটি বিষয় সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। আমরা জানি, নানা সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা নগরী। এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ সমস্যা তেমন না থাকলেও গ্যাস এবং পানি সমস্যায় নগরবাসী অতিষ্ঠ। সাধারণত শীত মৌসুমে অতটা সমস্যা হয় না। অথচ এবার শীতেই গ্যাস ও পানি সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকটের কারণে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কেরোসিনের তুলা জ্বালাতে হচ্ছে। কোনো কোনো বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার কিনে রান্নাবান্না করা হচ্ছে। এ সমস্যার ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া দরকার। সব কিছুর দায় নগর মেয়রের ওপর চাপালে চলবে না। নিজেদের উদ্যোগে নগরবাসীর সমস্যা সমাধান করতে হবে।
একইভাবে বিদু্যুৎ সমস্যার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে আগে থেকেই কাজ শুরু করা দরকার। এখন শীত মৌসুম। তাই বিদ্যুৎ খরচ কম হচ্ছে। তার পরও নতুন বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানও বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছে না। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে দেশে শিল্পায়ন হুমকির মুখে পড়েছে। এ কারণে নতুন উদ্যোক্তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। গ্রীষ্ম আসার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই সরকার অবগত আছে।
সরকার এ-ও অবগত আছে, এখন আর জনগণকে আশ্বাসের বাণী শোনালে চলবে না। তারা আর আশ্বাসের বাণী শুনতেও চায় না। তারা কাজ দেখতে চায়। আগামী তিন বছর জনকল্যাণে যা যা করণীয় তা সরকার করবে বলে আশা করি।
আমরা জানি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জীবন দিয়ে হলেও এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাবেন। তিনি জনগণকে বারবার এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
আওয়ামী লীগ তৃণমূল থেকে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক মঞ্চ। এক কথায় জনগণের দল। এ দলটি সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতির মূল্য দেবে, কষ্টে পাশে দাঁড়াবে, আনন্দে হাসবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। জনগণের দল কখনোই জনবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকারও জনবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
হঠাৎ হঠাৎ একেকটা জিনিসের দাম বেড়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিনিসপত্রের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ বাজার সিন্ডিকেট। সরকারের পক্ষ থেকে এ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হলেও ব্যবসায়ীদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না। বরং তাদের সিন্ডিকেট আরো জোরদার হয়েছে। সরকারের নির্দেশ তারা থোড়াই কেয়ার করছে। এর কারণও আছে। বাণিজ্যমন্ত্রী ধমক দিয়ে ব্যবসায়ীদের সোজা করতে চেয়েছিলেন। এখনকার যুগে ধমক দিলে হিতে বিপরীত হয়। তার পরও কেন ফারুক খান সে কাজটি করতে গেলেন তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
অনেক সময়ই দেখা গেছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ফারুক খান চাল, তেল, চিনি প্রভৃতির দাম বেঁধে দেন। এতে জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়ে। এ কারণে অনেকে মনে করেন, ফারুক খানের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আঁতাত রয়েছে। তা ছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙার ব্যাপারে বারবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান অনেক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট তাঁরা ভাঙতে পারেননি। আসলে তাঁরা যে পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন সেটা মোটেও সঠিক পথ নয়। এখানে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে এগোতে হবে। ব্যবসায়ীদের খেপিয়ে তুলে সমস্যার সমাধান হবে না, বরং সমস্যা আরো প্রলম্বিত হবে।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে, তাদের মুনাফাখোরী মনোভাব। দ্রুত বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার আশায় তাঁরা বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। তাঁরা দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভাবেন না। তাঁরা কেবল নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবেন। এই অতি মুনাফাখোরী ব্যবসায়ীদের একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। এটা নতুন করে গজিয়ে ওঠেনি। এ সিন্ডিকেট বিএনপির আমলেও ছিল, এখনো আছে। আরো আছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। এদের কারণে ক্রেতারা ঠকছে। দেশের কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে পারে না।
আমরা জানি, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, ক্ষমতায় যেতে পারলে তারা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে। মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু মানুষের সেই আশা দুরাশায় পরিণত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সব সময়ই দাবি করে, এ দলটি জনগণের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা দল। এ দলটি জনগণের দুঃখ-বেদনা টের পায়। আওয়ামী লীগই সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াবে, মানুষের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। এখনো আওয়ামী লীগের ওপর সাধারণ মানুষের এ আস্থাটুকু রয়েছে। সেই আস্থার যেন অপমৃত্যু না ঘটে।
প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আমরা গত শুক্রবার কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে জনমত যাচাই করেছিলাম। পরের দিন শনিবার তা পূর্ণপৃষ্ঠা ছাপা হয়েছে। তাতে পাঠকরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। পাঠকরা বলেছেন, সিন্ডিকেটের ফাঁদ ভাঙতে হবে, খাদ্যমূল্য নাগালের মধ্যে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুদদারি রোধ করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূমিহীনদের ভূমি প্রদান এবং বৈজ্ঞানিক কৃষিব্যবস্থা চালু করতে হবে। একই সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হার রোধ করতে হবে। পাঠকদের এ পরামর্শগুলো যদি কার্যকর করা যায় তাহলে খাদ্যদ্রব্যের দাম নিয়ে যে টালবাহানা চলছে তা কিছুটা হলেও কমবে। সরকার এ বিষয়গুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।
খাদ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকার ইতিমধ্যেই দেশে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি শুরু করেছে। সরকারের এ উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। তবে এর ফলে বাজারে যে প্রভাব পড়ার কথা তা কিন্তু পড়েনি। তবে ন্যায্যমূল্যে চাল কেনার লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়িয়ে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকায় নিম্নবিত্তদের সঙ্গে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা লাইনে দাঁড়িয়ে চাল কিনছে। এটা ঠিক, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এখন আর আগের মতো মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়ার এ গতি অব্যাহত থাকলে হয়তো কেনার ক্ষমতাও থাকবে না। ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি অব্যাহত রাখার মাধ্যমে বাজারে প্রভাব ফেলতে হবে।
এ মুহূর্তে দেশে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। যতই দিন যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের বেফাঁস কথার পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। এখন তিনি বলছেন, সব মানুষের নিরাপত্তা সরকার দিতে পারবে না। জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি তা না পারেন তাহলে দায় স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরে যেতে পারেন। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আছেন, যাঁরা যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত! তা ছাড়া বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার না করে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অস্বীকার করলে কোনো দিনও সমস্যার সমাধান হবে না।
আর বিলম্ব না করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। জেলা ও থানা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-পাতিনেতারা। এসব নেতা-পাতিনেতা পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছেন বলেই তারা এর সুযোগ নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে তাদের আগ্রহ কম। পুলিশ বাহিনীতে এক ধরনের গা-ছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে মানুষ ফুঁসে উঠবে। এ দেশের মানুষ একবার খেপে গেলে তাকে দাবিয়ে রাখা খুব কঠিন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সচেতন হওয়া উচিত এবং সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই অতীতের কথা ভুলে যাননি। বিগত আওয়ামী লীগ মরকারের আমলে তিনি যদি দলীয় কিছু লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন তাহলে আবারও আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হতো। সেটা পারেনি বলেই প্রতিপক্ষরা তার সুযোগ নিয়েছে। এবার আগে থেকে সতর্ক না হলে কিছু দলীয় লোকের কারণে আওয়ামী লীগকে খেসারত দিতে হবে।
আরেকটি বিষয় সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। আমরা জানি, নানা সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা নগরী। এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ সমস্যা তেমন না থাকলেও গ্যাস এবং পানি সমস্যায় নগরবাসী অতিষ্ঠ। সাধারণত শীত মৌসুমে অতটা সমস্যা হয় না। অথচ এবার শীতেই গ্যাস ও পানি সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকটের কারণে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কেরোসিনের তুলা জ্বালাতে হচ্ছে। কোনো কোনো বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার কিনে রান্নাবান্না করা হচ্ছে। এ সমস্যার ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া দরকার। সব কিছুর দায় নগর মেয়রের ওপর চাপালে চলবে না। নিজেদের উদ্যোগে নগরবাসীর সমস্যা সমাধান করতে হবে।
একইভাবে বিদু্যুৎ সমস্যার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে আগে থেকেই কাজ শুরু করা দরকার। এখন শীত মৌসুম। তাই বিদ্যুৎ খরচ কম হচ্ছে। তার পরও নতুন বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানও বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছে না। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে দেশে শিল্পায়ন হুমকির মুখে পড়েছে। এ কারণে নতুন উদ্যোক্তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। গ্রীষ্ম আসার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই সরকার অবগত আছে।
সরকার এ-ও অবগত আছে, এখন আর জনগণকে আশ্বাসের বাণী শোনালে চলবে না। তারা আর আশ্বাসের বাণী শুনতেও চায় না। তারা কাজ দেখতে চায়। আগামী তিন বছর জনকল্যাণে যা যা করণীয় তা সরকার করবে বলে আশা করি।
আমরা জানি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জীবন দিয়ে হলেও এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাবেন। তিনি জনগণকে বারবার এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
আওয়ামী লীগ তৃণমূল থেকে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক মঞ্চ। এক কথায় জনগণের দল। এ দলটি সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতির মূল্য দেবে, কষ্টে পাশে দাঁড়াবে, আনন্দে হাসবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। জনগণের দল কখনোই জনবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকারও জনবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
No comments