উন্নয়ন-রংপুর সিটি করপোরেশন কত দূর?
রংপুর সিটি করপোরেশন নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। রংপুর সিটি করপোরেশন হবে কি না, এ ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। অথবা হলে কত বছর পরে হবে, তা নিয়েও চলে তর্ক-বিতর্ক। চায়ের দোকানের একটি আড্ডার কথা বলি। একজন বলছেন, রংপুর সিটি করপোরেশন অবশ্যই হবে।
কারণ, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই ঘোষণা দিয়েছেন। পাশেই বসা একজন ক্ষুব্ধ হয়ে বলে উঠলেন, রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণাও তো প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিগত শাসনামলে দিয়েছিলেন! কই, সেটা তো হয়নি! অন্য একজন তাঁর ক্ষোভের মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, এই সরকার হয়তো ঘোষণা দিয়ে যাবে, জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করবে যদি ঘোষণাকারী সরকারের সাংসদপ্রার্থীরা ক্ষমতায় না আসেন, তাহলে সিটি করপোরেশন বাস্তবায়িত হবে না। সুতরাং আমাদের ভোট দেন। একজন বিড়বিড় করে হতাশার সুরে বলছেন, সরকারের বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে ভবিষ্যৎ খুব পরিষ্কার বলে মনেও হচ্ছে না। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ থাকা এক টগবগে তরুণ বলে বসল, এত সহজ নয়। অনেক হয়েছে। রংপুর নিয়ে আর রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।
চায়ের দোকানের এই আডডায় যে ক্ষোভ আর হতাশা, তা আসলে রংপুরবাসী সবারই। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় এক দশক। বলা যায়, এই এরশাদই যেন রংপুরের কষ্টের অন্যতম কারণ। তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন রংপুরে সোডিয়াম আলোর ব্যবস্থা করেছিলেন। মানুষের মুখে মুখে তখন শোনা যেত, রাষ্ট্রপতি নাকি রংপুরের রং বদলে দিয়েছেন। রাতের আলোয় রংপুরের বাহ্যিক রং বদলালেও রংপুরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অবহেলা, তার কমেনি কিছুই, মানুষের ক্ষুধা যা ছিল তা-ই আছে। মঙ্গার দেশ রংপুর। এখনো চৈত্র-বৈশাখ মাসে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালে চোখে পড়বে লুঙ্গি পরা, কাস্তে হাতে হাজার হাজার মানুষ, যারা বাসের ছাদে করে সামান্য আয়ের জন্য যাচ্ছে বগুড়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, কুমিল্লাসহ দেশের দূর-দূরান্তে। তবু সরকারের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বিগত সরকারের সময়ে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেছিলেন, তিনি মঙ্গা বোঝেন না। তিনি বুঝবেনই বা কী করে! তাঁর তো ধারণা ছিল, বাংলাদেশের মানুষ বেশি খায় বলে দেশের অভাব দূর হয় না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রায় দুই দশকের মধ্যে নাকি একবারই শুধু অর্থমন্ত্রী রংপুরে এসেছিলেন। তিনি সাইফুর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বোধন করতে এসে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আপনাদের প্রতি নাখোশ। আপনারা ভোট দেন না, তাই।’
সত্যি সত্যি রংপুরের অনুন্নয়নের জন্য এই ক্ষমতাসীন সরকারের ভোট না পাওয়াই বড় কারণ। স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তখন রংপুরে জাতীয় পার্টির আধিপত্য। বিএনপি তাই রংপুরের উন্নয়নের জন্য কোনো কাজই করেনি। এরপর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখনো রংপুরে জাতীয় পার্টির রমরমা অবস্থা। এরপর যখন আবার চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায়, তখন আবার জাতীয় পার্টি রংপুরে একচ্ছত্র। প্রতিবারই বিরোধী দল হিসেবে রংপুরের অবস্থান ছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও যে এই দিনগুলোতে খুব ভালো ছিলেন, তাও নয়। কখনো জেলে আর কখনো জেলে যাওয়ার ভীতি তাঁকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি। এসবই রংপুর বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস।
সেই ইতিহাসের মধ্যে একটি ছেদ পড়বে এমনটিই আশা করেছিলেন এবার রংপুরের মানুষ। প্রতিবারই বিরোধী দলে থাকা এরশাদের সামনে নতুন করে সুযোগ এসেছিল। কৌশলগতভাবে তাঁর অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবু রংপুরের প্রতি সরকারের আচরণ বিমাতাসুলভ বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে মহাজোটের শরিক হওয়া সত্ত্বেও রংপুর সিটি করপোরেশনের দাবিতে জাতীয় পার্টিকে আন্দোলন করতে হয়েছে।
২৭ মে যে রংপুরে হরতাল হলো, তা ছিল ধারাবাহিক আন্দোলনের একটি পর্যায়। এর আগে গণ-অনশন করেছে রংপুরবাসী। মিছিল-সভা চলছেই। ফেসবুক খুললেই দেখা যাবে রংপুর সিটি করপোরেশন নিয়ে অসংখ্য মন্তব্য। ২৪ মে রংপুরের হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে রংপুর পৌরসভা ঘেরাও করে। তারা রংপুর সিটি করপোরেশন লেখা একটি ব্যানার দিয়ে ‘রংপুর পৌরসভা’ লেখা ফলক ঢেকে দেয়। ঢাকায়ও রংপুরের সন্তানেরা রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য আন্দোলন করছেন। সবার চেষ্টা—আগামী অর্থবছরে যেন সিটি করপোরেশনের জন্য বরাদ্দ থাকে।
রংপুরে সিটি করপোরেশনের দাবিতে যে আন্দোলন হচ্ছে, এতে যোগ দিচ্ছেন রংপুরের সব সংগঠন ও সব স্তরের মানুষ। জাতীয় পার্টির ডাকে ২৭ তারিখ যে হরতাল পালিত হলো, তা রংপুরের শুধু জাতীয় পার্টির দাবি নয়, বরং রংপুরের সব মানুষের দাবি। এ দিনের হরতালে তাই রংপুর শহরে কোনো দোকান খোলেনি, চলেনি কোনো যানবাহন। ২৭ মের হরতাল থেকে হরতালবিষয়ক শিক্ষা নিতে পারে সরকার। জনস্বার্থে হরতাল হলে জনগণ যে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে, তা-ই দেখা গেল রংপুরে। রংপুর সিটি করপোরেশনের দাবিতে সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটিও অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর রংপুর সিটি করপোরেশন ঘোষণার পর নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন বাস্তবায়িত হলেও রংপুর সিটি করপোরেশন কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না, তা এখন রংপুরের সর্বস্তরের মানুষের প্রশ্ন। সিটি করপোরেশন হবে বলে রংপুর পৌর মেয়রের মেয়াদ শেষ হওয়ার চার বছর হলেও রংপুর পৌরসভা এবং পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় রংপুরের স্বাভাবিক উন্নয়নও ব্যাহত হচ্ছে। রংপুরের উন্নয়নে আন্দোলনই রংপুরবাসীর একমাত্র পথ।
লেখকবৃন্দ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের শিক্ষক।
চায়ের দোকানের এই আডডায় যে ক্ষোভ আর হতাশা, তা আসলে রংপুরবাসী সবারই। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় এক দশক। বলা যায়, এই এরশাদই যেন রংপুরের কষ্টের অন্যতম কারণ। তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন রংপুরে সোডিয়াম আলোর ব্যবস্থা করেছিলেন। মানুষের মুখে মুখে তখন শোনা যেত, রাষ্ট্রপতি নাকি রংপুরের রং বদলে দিয়েছেন। রাতের আলোয় রংপুরের বাহ্যিক রং বদলালেও রংপুরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অবহেলা, তার কমেনি কিছুই, মানুষের ক্ষুধা যা ছিল তা-ই আছে। মঙ্গার দেশ রংপুর। এখনো চৈত্র-বৈশাখ মাসে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালে চোখে পড়বে লুঙ্গি পরা, কাস্তে হাতে হাজার হাজার মানুষ, যারা বাসের ছাদে করে সামান্য আয়ের জন্য যাচ্ছে বগুড়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, কুমিল্লাসহ দেশের দূর-দূরান্তে। তবু সরকারের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বিগত সরকারের সময়ে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেছিলেন, তিনি মঙ্গা বোঝেন না। তিনি বুঝবেনই বা কী করে! তাঁর তো ধারণা ছিল, বাংলাদেশের মানুষ বেশি খায় বলে দেশের অভাব দূর হয় না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রায় দুই দশকের মধ্যে নাকি একবারই শুধু অর্থমন্ত্রী রংপুরে এসেছিলেন। তিনি সাইফুর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বোধন করতে এসে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আপনাদের প্রতি নাখোশ। আপনারা ভোট দেন না, তাই।’
সত্যি সত্যি রংপুরের অনুন্নয়নের জন্য এই ক্ষমতাসীন সরকারের ভোট না পাওয়াই বড় কারণ। স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তখন রংপুরে জাতীয় পার্টির আধিপত্য। বিএনপি তাই রংপুরের উন্নয়নের জন্য কোনো কাজই করেনি। এরপর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখনো রংপুরে জাতীয় পার্টির রমরমা অবস্থা। এরপর যখন আবার চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায়, তখন আবার জাতীয় পার্টি রংপুরে একচ্ছত্র। প্রতিবারই বিরোধী দল হিসেবে রংপুরের অবস্থান ছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও যে এই দিনগুলোতে খুব ভালো ছিলেন, তাও নয়। কখনো জেলে আর কখনো জেলে যাওয়ার ভীতি তাঁকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি। এসবই রংপুর বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস।
সেই ইতিহাসের মধ্যে একটি ছেদ পড়বে এমনটিই আশা করেছিলেন এবার রংপুরের মানুষ। প্রতিবারই বিরোধী দলে থাকা এরশাদের সামনে নতুন করে সুযোগ এসেছিল। কৌশলগতভাবে তাঁর অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবু রংপুরের প্রতি সরকারের আচরণ বিমাতাসুলভ বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে মহাজোটের শরিক হওয়া সত্ত্বেও রংপুর সিটি করপোরেশনের দাবিতে জাতীয় পার্টিকে আন্দোলন করতে হয়েছে।
২৭ মে যে রংপুরে হরতাল হলো, তা ছিল ধারাবাহিক আন্দোলনের একটি পর্যায়। এর আগে গণ-অনশন করেছে রংপুরবাসী। মিছিল-সভা চলছেই। ফেসবুক খুললেই দেখা যাবে রংপুর সিটি করপোরেশন নিয়ে অসংখ্য মন্তব্য। ২৪ মে রংপুরের হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে রংপুর পৌরসভা ঘেরাও করে। তারা রংপুর সিটি করপোরেশন লেখা একটি ব্যানার দিয়ে ‘রংপুর পৌরসভা’ লেখা ফলক ঢেকে দেয়। ঢাকায়ও রংপুরের সন্তানেরা রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য আন্দোলন করছেন। সবার চেষ্টা—আগামী অর্থবছরে যেন সিটি করপোরেশনের জন্য বরাদ্দ থাকে।
রংপুরে সিটি করপোরেশনের দাবিতে যে আন্দোলন হচ্ছে, এতে যোগ দিচ্ছেন রংপুরের সব সংগঠন ও সব স্তরের মানুষ। জাতীয় পার্টির ডাকে ২৭ তারিখ যে হরতাল পালিত হলো, তা রংপুরের শুধু জাতীয় পার্টির দাবি নয়, বরং রংপুরের সব মানুষের দাবি। এ দিনের হরতালে তাই রংপুর শহরে কোনো দোকান খোলেনি, চলেনি কোনো যানবাহন। ২৭ মের হরতাল থেকে হরতালবিষয়ক শিক্ষা নিতে পারে সরকার। জনস্বার্থে হরতাল হলে জনগণ যে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে, তা-ই দেখা গেল রংপুরে। রংপুর সিটি করপোরেশনের দাবিতে সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটিও অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর রংপুর সিটি করপোরেশন ঘোষণার পর নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন বাস্তবায়িত হলেও রংপুর সিটি করপোরেশন কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না, তা এখন রংপুরের সর্বস্তরের মানুষের প্রশ্ন। সিটি করপোরেশন হবে বলে রংপুর পৌর মেয়রের মেয়াদ শেষ হওয়ার চার বছর হলেও রংপুর পৌরসভা এবং পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় রংপুরের স্বাভাবিক উন্নয়নও ব্যাহত হচ্ছে। রংপুরের উন্নয়নে আন্দোলনই রংপুরবাসীর একমাত্র পথ।
লেখকবৃন্দ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের শিক্ষক।
No comments