মৎস্যসম্পদ-মা-ইলিশকে ডিম ছাড়তে দিন by শেখ মুস্তাফিজুর রহমান
বাংলাদেশের অনেক গর্বের মধ্যে অন্যতম জাতীয় মাছ ইলিশ। আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। অনাদিকাল থেকেই ইলিশ আমাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, দরিদ্রজনের আমিষ সরবরাহ, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ইত্যাদিতে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২ শতাংশ এবং মোট দেশজ আয়ের
এক শতাংশ আসছে ইলিশ থেকে। অর্থাৎ, যদি ধরা যায় যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১০০টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে তার একটি পিলার হলো ইলিশ থেকে পাওয়া আয়। বর্তমানে ইলিশের মোট উৎপাদন প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য ২৫০ টাকা কেজি ধরা হলেও প্রায় সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিগত অর্থবছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ইলিশ বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং ইলিশ পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, রপ্তানি ইত্যাদি কাজে অতিরিক্ত প্রায় ২০-২৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এ থেকেই এ সম্পদটির গুরুত্ব অনুধাবনযোগ্য। আর এ সম্পদটির সুরক্ষাও আমাদের অবশ্যকর্তব্য।
ইলিশ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু মাছ। খাদ্যমানের দিক দিয়েও এটি সমৃদ্ধ। এ মাছে উচ্চমাত্রায় আমিষ, চর্বি ও ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। মানবদেহের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাসে ইলিশের চর্বিতে উপস্থিত অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড অত্যন্ত কার্যকর। আমাদের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না, এমন নয়টি প্রয়োজনীয় অ্যামিনো এসিড পাওয়া যায় ইলিশের আমিষে। এ ছাড়া ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ইত্যাদিও রয়েছে উচ্চপরিমাণে। তদুপরি ইলিশের তেলে রয়েছে ভিটামিন এ ও ডি। ইলিশ থেকে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ খাওয়ার উপযোগী মাংস পাওয়া যায়, যা অন্যান্য মাছের চেয়ে অনেক বেশি। এর তেলের গন্ধ অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। রান্নার সময়, বিশেষত ভাজার সময় এর সুঘ্রাণ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, যা সবার রসনাকে সিক্ত করে তোলে। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও রয়েছে ইলিশের সরব উপস্থিতি। ‘ইলশে গুঁড়ি’, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি কবিতা-উপন্যাস মূলত ইলিশাশ্রয়ী। প্রাচীনকালে এ বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে অর্থাৎ দুর্গাপূজার দশমীর দিন থেকে সরস্বতী পূজার দিন (মাঘ-ফাল্গুন মাসের শ্রীপঞ্চমী) পর্যন্ত ইলিশ ধরা, বিপণন, খাওয়া বন্ধ রাখা হলে এ মাছ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের গর্ব ইলিশ মাছ আন্তর্জাতিকভাবে ইন্ডিয়ান শ্যাড নামে পরিচিত। ইলিশের পাঁচটি প্রজাতি পাওয়া যায়। এর বিস্তৃতি পারস্য উপসাগর থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। সারা পৃথিবীতে ধৃত ইলিশের ৬০ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে ধরা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এর বিস্তৃতি ব্যাপক এলাকাজুড়ে। এর মধ্যে প্রধান এলাকা হলো মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চল, পটুয়াখালী জেলার আন্ধারমানিক নদী, তেঁতুলিয়া নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল এবং সমগ্র উপকূল অঞ্চল। আগে পদ্মা, ধলেশ্বরী, চিত্রা, গড়াই নদীতে ইলিশ পাওয়া গেলেও এখন আর পাওয়া যায় না বলা যায়।
ইলিশ উৎপাদনের গতিধারা লক্ষ করলে দেখা যায়, ২০০১-০২ সালের উৎপাদন ২ দশমিক ২০ লাখ টনের তুলনায় ২০০২-০৩ সালে ইলিশ উৎপাদন ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১ দশমিক ৯৯ লাখ টনে দাঁড়িয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল জলবায়ু পরিবর্তন, নদী ও সাগরের পরিবেশদূষণ, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, পলি ভরাটের ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ইলিশ আহরণকারী মৎস্যজীবীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, জাল ও নৌকার সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়া, কারেন্ট জাল ব্যবহার ও জালের ফাঁস কমিয়ে চারাপোনা পর্যন্ত তুলে ফেলা ইত্যাদি। ইলিশ আহরণ কমার হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় সরকার ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। জাটকা রক্ষা কর্মসূচি, অভয়াশ্রম ঘোষণা, ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ সময়, জেলেদের পুনর্বাসন, ইলিশ আহরণ নিয়ন্ত্রণ, আইন করে ইলিশ আহরণকারী জালের ফাঁসের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়ায় পুনরায় ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৩-০৪ সালে ২ দশমিক ৫৬ লাখ টন এবং ২০০৯-১০ সালে প্রায় তিন লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
ইলিশ মাছ প্রধানত প্লাংকটনভোজি। এর খাদ্যতালিকায় অ্যালজি ৪২ শতাংশ, বালুকণা ৩৬, ডায়াটম ১৫, রটিফার তিন, ক্রাস্টাসিয়া দুই, প্রটোজোয়া এক এবং অন্যান্য এক শতাংশ পাওয়া গেছে। সাধারণত এক বছর পূর্ণ হলেই মাছ পরিপক্ব হয়। সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী-পুরুষ মাছের অনুপাত প্রায় সমান থাকে। মজার ব্যাপার হলো, ৪৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের চেয়ে বড় অধিকাংশ মাছই স্ত্রী মাছ আর ২০-২৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট অধিকাংশ মাছই পুরুষ মাছ।
ইলিশের প্রধান প্রজননকাল অক্টোবর মাসের বড় পূর্ণিমা। এ সময় প্রায় ৬০-৭০ ভাগ ইলিশ পরিপক্ব হয়ে ডিম ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হয়। একটি পরিপক্ব ইলিশ প্রতিবার প্রায় ২০ থেকে ২৪ লাখ ডিম ছাড়ে। ইলিশের প্রধান প্রজননক্ষেত্র হলো উত্তর-পূর্ব সীমানা পয়েন্ট (শাহেরখালী/হাইতকান্দি পয়েন্ট, মিরসরাই, চট্টগ্রাম, জিপিএস পয়েন্ট ৯১০ ২র্৮ ৫৫.২০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২২০ ৪র্২ ৫৭.৬০ উত্তর অক্ষাংশ), উত্তর-পশ্চিম সীমানা পয়েন্ট (উত্তর তজুমুদ্দিন/পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট, ভোলা, জিপিএস পয়েন্ট ৯০০ ৫র্২ ৫১.৬০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২২০ ১র্৯ ৫৬.৪০ উত্তর অক্ষাংশ), দক্ষিণ-পূর্ব সীমানা পয়েন্ট (উত্তর কুতুবদিয়া/গন্ডামারা পয়েন্ট, কক্সবাজার, জিপিএস পয়েন্ট ৯১০ ৫র্২ ৫১.৬০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২১০ ৫র্৫ ১৯.০০ উত্তর অক্ষাংশ) এবং দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা পয়েন্ট (লতাচাপলি পয়েন্ট, কলাপাড়া, পটুয়াখালী, জিপিএস পয়েন্ট ৯০০ ১র্২ ৩৯.৬০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২১০ ৪র্৭ ৫৬.৪০ উত্তর অক্ষাংশ), এ চারটি পয়েন্টের অভ্যন্তরীণ ছয় হাজার ৮৮২ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সরকার মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০-এর অধীনে অক্টোবর মাসের বড় পূর্ণিমার পাঁচ দিন আগে এবং পাঁচ দিন পরে (১৫ থেকে ২৪ অক্টোবর) ওই এলাকায় মা-ইলিশ মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করেছে। এতে পরিপক্ব ইলিশ মাছ নিরুপদ্রবে সেখানে ডিম ছাড়তে পারবে। প্রতিটি পরিপক্ব ইলিশকে যদি নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া যায় এবং জাটকা (বাচ্চা ইলিশ) ধরা বন্ধ করা সম্ভব হয়, তাহলে ইলিশের বর্তমান উৎপাদন তিন লাখ মেট্রিক টন, আগামী ২০১২-১৩ সালে চার লাখ, ২০১৩-১৪ সালে পাঁচ লাখ টনে উন্নীত করা খুবই সম্ভব।
ইলিশ ও জাটকা আহরণে নিয়োজিত মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ সুফলভোগী। এ সম্পদের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রত্যক্ষ সুফলভোগীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। দেশের ইলিশ আহরণকারী মৎস্যজীবীরা যদি এ সময় সাগরে মা-ইলিশ না ধরেন, ভবিষ্যতে ইলিশের প্রাচুর্য হলে তাঁরাই উপকৃত হবেন। যদিও আমাদের মৎস্যজীবীরা অত্যন্ত দরিদ্র, সাগরে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে তাঁদের জীবন যাপিত হয়, তথাপি নিজেদের ভবিষ্যৎ উন্নত করার স্বার্থেই তাঁদের এ সময় মা-ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। এ বিষয়ে আমরা যাঁরা ইলিশের ভোক্তা, তাঁদেরও করণীয় আছে। রসনায় যদি ইলিশের স্বাদ অব্যাহত রাখতে চাই, তাহলে এ সময় ডিমওয়ালা ইলিশ খাওয়াও বন্ধ করতে হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে ডিমওয়ালা ইলিশকে ডিম ছাড়তে সহায়তা করি। ইলিশ বিনিময়ে আমাদের দেবে প্রোটিন, ভিটামিন, প্রয়োজনীয় অ্যামিনো এসিড, স্বাদু খাবার, অর্থ, কর্মসংস্থান আর সর্বোপরি...গর্ব।
শেখ মুস্তাফিজুর রহমান: জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, কক্সবাজার।
ইলিশ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু মাছ। খাদ্যমানের দিক দিয়েও এটি সমৃদ্ধ। এ মাছে উচ্চমাত্রায় আমিষ, চর্বি ও ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। মানবদেহের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাসে ইলিশের চর্বিতে উপস্থিত অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড অত্যন্ত কার্যকর। আমাদের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না, এমন নয়টি প্রয়োজনীয় অ্যামিনো এসিড পাওয়া যায় ইলিশের আমিষে। এ ছাড়া ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ইত্যাদিও রয়েছে উচ্চপরিমাণে। তদুপরি ইলিশের তেলে রয়েছে ভিটামিন এ ও ডি। ইলিশ থেকে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ খাওয়ার উপযোগী মাংস পাওয়া যায়, যা অন্যান্য মাছের চেয়ে অনেক বেশি। এর তেলের গন্ধ অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। রান্নার সময়, বিশেষত ভাজার সময় এর সুঘ্রাণ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, যা সবার রসনাকে সিক্ত করে তোলে। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও রয়েছে ইলিশের সরব উপস্থিতি। ‘ইলশে গুঁড়ি’, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি কবিতা-উপন্যাস মূলত ইলিশাশ্রয়ী। প্রাচীনকালে এ বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে অর্থাৎ দুর্গাপূজার দশমীর দিন থেকে সরস্বতী পূজার দিন (মাঘ-ফাল্গুন মাসের শ্রীপঞ্চমী) পর্যন্ত ইলিশ ধরা, বিপণন, খাওয়া বন্ধ রাখা হলে এ মাছ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের গর্ব ইলিশ মাছ আন্তর্জাতিকভাবে ইন্ডিয়ান শ্যাড নামে পরিচিত। ইলিশের পাঁচটি প্রজাতি পাওয়া যায়। এর বিস্তৃতি পারস্য উপসাগর থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। সারা পৃথিবীতে ধৃত ইলিশের ৬০ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে ধরা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এর বিস্তৃতি ব্যাপক এলাকাজুড়ে। এর মধ্যে প্রধান এলাকা হলো মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চল, পটুয়াখালী জেলার আন্ধারমানিক নদী, তেঁতুলিয়া নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল এবং সমগ্র উপকূল অঞ্চল। আগে পদ্মা, ধলেশ্বরী, চিত্রা, গড়াই নদীতে ইলিশ পাওয়া গেলেও এখন আর পাওয়া যায় না বলা যায়।
ইলিশ উৎপাদনের গতিধারা লক্ষ করলে দেখা যায়, ২০০১-০২ সালের উৎপাদন ২ দশমিক ২০ লাখ টনের তুলনায় ২০০২-০৩ সালে ইলিশ উৎপাদন ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১ দশমিক ৯৯ লাখ টনে দাঁড়িয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল জলবায়ু পরিবর্তন, নদী ও সাগরের পরিবেশদূষণ, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, পলি ভরাটের ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ইলিশ আহরণকারী মৎস্যজীবীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, জাল ও নৌকার সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়া, কারেন্ট জাল ব্যবহার ও জালের ফাঁস কমিয়ে চারাপোনা পর্যন্ত তুলে ফেলা ইত্যাদি। ইলিশ আহরণ কমার হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় সরকার ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। জাটকা রক্ষা কর্মসূচি, অভয়াশ্রম ঘোষণা, ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ সময়, জেলেদের পুনর্বাসন, ইলিশ আহরণ নিয়ন্ত্রণ, আইন করে ইলিশ আহরণকারী জালের ফাঁসের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়ায় পুনরায় ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৩-০৪ সালে ২ দশমিক ৫৬ লাখ টন এবং ২০০৯-১০ সালে প্রায় তিন লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
ইলিশ মাছ প্রধানত প্লাংকটনভোজি। এর খাদ্যতালিকায় অ্যালজি ৪২ শতাংশ, বালুকণা ৩৬, ডায়াটম ১৫, রটিফার তিন, ক্রাস্টাসিয়া দুই, প্রটোজোয়া এক এবং অন্যান্য এক শতাংশ পাওয়া গেছে। সাধারণত এক বছর পূর্ণ হলেই মাছ পরিপক্ব হয়। সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী-পুরুষ মাছের অনুপাত প্রায় সমান থাকে। মজার ব্যাপার হলো, ৪৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের চেয়ে বড় অধিকাংশ মাছই স্ত্রী মাছ আর ২০-২৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট অধিকাংশ মাছই পুরুষ মাছ।
ইলিশের প্রধান প্রজননকাল অক্টোবর মাসের বড় পূর্ণিমা। এ সময় প্রায় ৬০-৭০ ভাগ ইলিশ পরিপক্ব হয়ে ডিম ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হয়। একটি পরিপক্ব ইলিশ প্রতিবার প্রায় ২০ থেকে ২৪ লাখ ডিম ছাড়ে। ইলিশের প্রধান প্রজননক্ষেত্র হলো উত্তর-পূর্ব সীমানা পয়েন্ট (শাহেরখালী/হাইতকান্দি পয়েন্ট, মিরসরাই, চট্টগ্রাম, জিপিএস পয়েন্ট ৯১০ ২র্৮ ৫৫.২০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২২০ ৪র্২ ৫৭.৬০ উত্তর অক্ষাংশ), উত্তর-পশ্চিম সীমানা পয়েন্ট (উত্তর তজুমুদ্দিন/পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়া পয়েন্ট, ভোলা, জিপিএস পয়েন্ট ৯০০ ৫র্২ ৫১.৬০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২২০ ১র্৯ ৫৬.৪০ উত্তর অক্ষাংশ), দক্ষিণ-পূর্ব সীমানা পয়েন্ট (উত্তর কুতুবদিয়া/গন্ডামারা পয়েন্ট, কক্সবাজার, জিপিএস পয়েন্ট ৯১০ ৫র্২ ৫১.৬০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২১০ ৫র্৫ ১৯.০০ উত্তর অক্ষাংশ) এবং দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা পয়েন্ট (লতাচাপলি পয়েন্ট, কলাপাড়া, পটুয়াখালী, জিপিএস পয়েন্ট ৯০০ ১র্২ ৩৯.৬০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২১০ ৪র্৭ ৫৬.৪০ উত্তর অক্ষাংশ), এ চারটি পয়েন্টের অভ্যন্তরীণ ছয় হাজার ৮৮২ বর্গকিলোমিটার এলাকা। সরকার মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০-এর অধীনে অক্টোবর মাসের বড় পূর্ণিমার পাঁচ দিন আগে এবং পাঁচ দিন পরে (১৫ থেকে ২৪ অক্টোবর) ওই এলাকায় মা-ইলিশ মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করেছে। এতে পরিপক্ব ইলিশ মাছ নিরুপদ্রবে সেখানে ডিম ছাড়তে পারবে। প্রতিটি পরিপক্ব ইলিশকে যদি নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া যায় এবং জাটকা (বাচ্চা ইলিশ) ধরা বন্ধ করা সম্ভব হয়, তাহলে ইলিশের বর্তমান উৎপাদন তিন লাখ মেট্রিক টন, আগামী ২০১২-১৩ সালে চার লাখ, ২০১৩-১৪ সালে পাঁচ লাখ টনে উন্নীত করা খুবই সম্ভব।
ইলিশ ও জাটকা আহরণে নিয়োজিত মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ সুফলভোগী। এ সম্পদের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রত্যক্ষ সুফলভোগীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। দেশের ইলিশ আহরণকারী মৎস্যজীবীরা যদি এ সময় সাগরে মা-ইলিশ না ধরেন, ভবিষ্যতে ইলিশের প্রাচুর্য হলে তাঁরাই উপকৃত হবেন। যদিও আমাদের মৎস্যজীবীরা অত্যন্ত দরিদ্র, সাগরে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে তাঁদের জীবন যাপিত হয়, তথাপি নিজেদের ভবিষ্যৎ উন্নত করার স্বার্থেই তাঁদের এ সময় মা-ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। এ বিষয়ে আমরা যাঁরা ইলিশের ভোক্তা, তাঁদেরও করণীয় আছে। রসনায় যদি ইলিশের স্বাদ অব্যাহত রাখতে চাই, তাহলে এ সময় ডিমওয়ালা ইলিশ খাওয়াও বন্ধ করতে হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে ডিমওয়ালা ইলিশকে ডিম ছাড়তে সহায়তা করি। ইলিশ বিনিময়ে আমাদের দেবে প্রোটিন, ভিটামিন, প্রয়োজনীয় অ্যামিনো এসিড, স্বাদু খাবার, অর্থ, কর্মসংস্থান আর সর্বোপরি...গর্ব।
শেখ মুস্তাফিজুর রহমান: জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, কক্সবাজার।
No comments