কালান্তরের কড়চা-একটি স্পর্শকাতর অনভিপ্রেত ঘটনা by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

কালের কণ্ঠের কিছু সহৃদয় পাঠক, যাঁরা আমার কলামটি নিয়মিত পাঠ করেন, তাঁরা জানতে চেয়েছেন, সম্প্রতি জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার আবদুল হামিদ এবং উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরীর (মানিক) পরস্পরবিরোধী বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যে বিতণ্ডা হয়ে গেল, তা নিয়ে আমি কিছু লিখিনি বা এখনো কিছু লিখছি না


কেন? এক পাঠক বন্ধু টেলিফোনে আমাকে প্রশ্নটি করেছিলেন। তাঁকে বলেছি, বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে আলোচনা করতে চাইনি। পার্লামেন্ট এবং জুডিশিয়ারি- আধুনিক গণতন্ত্রের এই দুটি স্তম্ভের মর্যাদা সর্বোচ্চ। এই মর্যাদা রক্ষা করে কথা বলতে না পারলে বিপদ হয়। তা ছাড়া বিষয়টি তো এখন প্রায় মীমাংসিত।
পাঠক বন্ধুরা তবু আমাকে ছাড়েননি। বলেছেন, বিতর্কটি প্রায় মীমাংসিত; কিন্তু ইস্যুটি নয়। ইস্যুটি হলো, পার্লামেন্ট ও জুডিশিয়ারির মধ্যে সম্পর্ক কী হওয়া উচিত এবং তারা প্রকাশ্যে একে অপরের সমালোচনা করতে পারে কি না অথবা করা উচিত কি না? আমি পাঠক বন্ধুদের বলেছি, এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের কথা বলা উচিত। আমি আর দশজন মানুষের মতো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকে কথা বলতে পারি। তার বেশি কিছু নয়। তাও এই দুই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করে।
রাষ্ট্রপতি, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি এবং পার্লামেন্টের স্পিকার, তাঁদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের নিরপেক্ষ প্রতীক হিসেবে সব সমালোচনার উর্ধ্বে রাখা হয়। বিচারপতির সমালোচনা অনেক সময় আদালত অবমাননার সমতুল্য। স্পিকারকে সমালোচনার ব্যাপারে অবশ্য এতটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় না। এই ট্র্যাডিশনটা কলোনিয়াল যুগের। ব্রিটেনের কনস্টিটিউশনাল মনার্কও ছিলেন বহুকাল সমালোচনার উর্ধ্বে। সমালোচনা করা হলে তাকে রাজদ্রোহ বলে মনে করা হতো। �King can do no wrong� (রাজা অন্যায় করতে পারেন না)- এই ধারণা থেকে রাজা/রাষ্ট্রপতি, সর্বোচ্চ আদালতকে সব সমালোচনার উর্ধ্বে রাখা হয়েছিল। পার্লামেন্টের স্পিকারও বহুকাল এই সম্মানের অধিকারী ছিলেন।
আমেরিকান গণতন্ত্রে অবশ্য রাষ্ট্রপতি, সিনেট ও কংগ্রেসের প্রধান এবং প্রধান বিচারপতিসহ সব বিচারপতিরই সমালোচনা করা যায়। তাঁদের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট, এমনকি তাঁদের অপসারণেরও ব্যবস্থা করা হয়। ব্রিটেনে এই সমালোচনার সুযোগ আগে তেমন ছিল না। বর্তমানে রাজতন্ত্র, জুডিশিয়ারি ও পার্লামেন্টের স্পিকারও সমভাবে সমালোচিত হচ্ছেন।
আমাদের মতো সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে উপনিবেশ যুগের রীতিনীতি এখনো দাপটের সঙ্গে বহাল রয়েছে। এটা ভালো কি মন্দ, সে প্রশ্নের আলোচনায় আজ যাব না। তবে নিজের দেশের সাম্প্রতিক ঘটনায় আসি। হাইকোর্টের কিছু জমি রোড অ্যান্ড হাইওয়েজের দখলে ছিল। সেই জমি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে হাইকোর্টের রায় নিয়েই স্পিকার বনাম বিচারপতির বিতণ্ডার শুরু। এ সম্পর্কিত এক মোশনের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে স্পিকার বলেছেন, হাইকোর্টে অসংখ্য মামলা ঝুলে থাকে, অথচ নিজেদের জমির ব্যাপারে তাঁরা তড়িঘড়ি রায় দিয়েছেন। হাইকোর্ট এ ধরনের কাজকারবার চালালে জনগণ তা রুখে দাঁড়াবে। হাইকোর্টে স্পিকারের এই মন্তব্যটি উত্থাপিত হলে বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী একে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে উল্লেখ করে স্পিকারের সমালোচনা করেছেন।
এ ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার কাজে এ সরকার তাদের অনেক ব্যর্থতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় পার্লামেন্ট ও জুডিশিয়ারির মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হলে বা বিতর্ক-বিতণ্ডা দেখা দিলে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই বিপন্ন করবে। এ ব্যাপারে পার্লামেন্ট ও জুডিশিয়ারি দুয়েরই সতর্ক থাকা উচিত।
আমি মাননীয় স্পিকার আবদুল হামিদ এবং মাননীয় বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী (মানিক) দুজনকেই ব্যক্তিগতভাবে এবং ঘনিষ্ঠভাবে জানি। দুজনই যোগ্য এবং ভালো মানুষ। স্পিকার এবং বিচারপতি হিসেবে তাঁদের কোনো বক্তব্য নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। তা আমার এখতিয়ারের বাইরে হতে পারে। কিন্তু যেহেতু তাঁদের আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, তাই ব্যক্তিমানুষ হিসেবে দুটি কথা তাঁদের বলতে পারি। স্পিকার এবং বিচারপতি হিসেবে নয়।
'জনগণ আদালতকে রুখে দাঁড়াবে'- এই কথাটি পার্লামেন্টের ভেতরে উচ্চারিত হওয়া ঠিক হয়নি। মাননীয় স্পিকারও একজন মানুষ। তিনি ভাবাবেগে হয়তো কথাটি বলে ফেলেছেন। তাঁর কানে তখন হয়তো একটি গানের কলি ভাসছিল- 'বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।' কিন্তু এটি কলোনিয়াল যুগের একটি গণ-আন্দোলনের গান; স্বাধীন দেশে পার্লামেন্টে উচ্চারিত হওয়া শোভন নয়। স্পিকার অবশ্যই উচ্চ আদালতের কোনো রায় মনঃপূত না হলে সে সম্পর্কে নিজের মর্যাদা রক্ষা করে কথা বলতে পারেন; কিন্তু গোটা আদালতকে গণবিরোধী বলা যায় না, তা উচিত নয়।
অন্যদিকে স্পিকারের মন্তব্যে মাননীয় বিচারপতি যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাও তাঁর উচ্চ মর্যাদার উপযোগী কি না তা তাঁকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। স্পিকারের মন্তব্য অনভিপ্রেত হলে সে কথা তিনি বলুন; তিনি স্পিকার সম্পর্কে ব্যক্তিগত রেফারেন্সটি এড়াতে পারতেন। ঘটনাটি পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি হিসেবে বিবেচিত এবং সঙ্গে সঙ্গে সংশোধিত হলে ভালো ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি পার্লামেন্টেরই কিছু অতিউৎসাহী প্রবীণ সদস্যের কার্যকলাপে।
দেশে গণতন্ত্রের এখন বড় নাজুক অবস্থা। গণতান্ত্রিক সরকার দেশ শাসনে তেমন সাফল্য দেখাতে পারছে না। তারা নানা চক্রান্তের দ্বারা বেষ্টিত। গণতন্ত্রের শত্রুরা তাই উৎসাহী এবং অত্যন্ত সক্রিয়। এ অবস্থায় পার্লামেন্ট ও জুডিশিয়ারির মধ্যে যেকোনো কারণেই হোক কোনো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হলে তাকে বাড়তে না দিয়ে, কোনো পক্ষের মর্যাদাতেই আঘাত না দিয়ে যে সম্মানজনক একটা মীমাংসায় পেঁৗছাতে সাহায্য করা দরকার, এটা আমাদের কয়েকজন অত্যন্ত প্রবীণ এবং সবার শ্রদ্ধাভাজন সদস্য ভুলে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারপতির বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের দাবি তুলে সংসদ ভবন যেভাবে উত্তপ্ত করে তুলেছিলেন, তা দুর্ভাগ্যজনক। যা হোক, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি এবং স্পিকারও যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে এটিকে আর বেশি দূর গড়াতে দেননি, সে জন্য তাঁদের অভিনন্দন জানাই।
জানা যায়, কয়েকজন সংসদ সদস্য যে বিষয়টি নিয়ে এতটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছেন, তার পেছনেও কারণ ছিল।
(পরবর্তী অংশ আগামীকাল)
লন্ডন, ১৮ জুলাই, সোমবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.