স্মরণ-লাল-সবুজের শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান by সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
স্বাধীনতার আহ্বান রক্তে বহন না করলে এমন করে পারে না কেউ। স্বাধীনতাকে শুধু নীরবে সমর্থন নয়, শত্রুর ঘৃণিত মুখের অবয়ব দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন প্রতিরোধের জোয়ার। ভালোবাসা থেকে যেমন তৈরি করেছেন সদ্য জন্মানো দেশের পতাকা, তেমনি হিংস্র ইয়াহিয়া খানের ভয়ানক মুখচ্ছবির পোস্টারেরও সৃষ্টি পটুয়া কামরুল হাসান।
নিজেকে পটুয়া পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। এর পেছনে যুক্তিও ছিল। কালিঘাটের পট শিল্পমাধ্যম এ দেশে তিনিই জনপ্রিয় করেছিলেন। মাটির পটের ওপর রঙের আঁচড় মানেই যেন তিনি। অংকন শিল্পের আরো অনেক কিছুতেই তিনি প্রথম। কিউবিজমের ব্যবহার করে বাংলাদেশের শিল্পে এনেছেন আধুনিকতা, তবে তাঁর বিশেষত্ব স্রোতে ভেসে নিজস্ব ধারা মিলিয়ে ফেলেননি। স্বকীয়তা রেখে ব্যবহার করেছেন নতুন নতুন পদ্ধতি। শিল্পী কামরুল হাসানের জন্ম কলকাতায়। পড়ালেখা করেছেন কলকাতা মডেল এম ই স্কুল, কলকাতা মাদ্রাসা এবং পরে সরকারি আর্ট কলেজে। ভৌত অনুশীলনে ১৯৪৫ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় সমসাময়িক অন্যান্য মুসলিম যুবকের মতো তিনিও পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। দেশভাগের পর ৪৮ সালে চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। এ বছরই শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে মিলে এক সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস, যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত চারুকলা বিভাগ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেন। বামপন্থী রাজনৈতিক ধারায় বিশ্বাসী শিল্পী কামরুল হাসানের মুক্তিযুদ্ধে অবদান গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে ১৯৬৯ সালে আইয়ূব-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও রেডিওর কলা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের নকশা কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন শিল্পী কামরুল। দেশে ও দেশের বাইরে বহু একক ও যৌথ চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর। পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সন্মাননা, বাংলা একাডেমী ফেলো। এঁকেছেন তৈলচিত্র, জলরং, পেনসিল স্কেচ, কালিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। আরো একটি প্রসিদ্ধ প্রতিবাদ ছিল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালে সামরিক সরকার ইয়াহিয়া খানের রক্তচক্ষু মুখমণ্ডল এঁকে আলোড়ন তুলেছেন। ছবির ক্যাপশন ছিল 'এই জানোয়ারকে হত্যা করুন'। এঁকেছিলেন এক চক্ষু এরশাদের স্কেচ। ক্যাপশন ছিল 'দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে'। এ সবই হলো তাঁর সচেতনতা ও প্রতিবাদের শিল্প ভাষা। অপরদিকে তাঁর শিল্পকর্মে স্থান পেয়েছে গ্রামীণ জীবন, নারী ও পাখির অবয়ব। শুধু শিল্প নয়, তাঁর ভাবনায় ছিল দেশ ও রাজনীতি। তাই মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকালীন উত্তপ্ত সময় থেকে প্রতিদিন লিখে রাখতেন দিনপঞ্জি। প্রতিদিনের পট-পরিবর্তন আর নিত্যনতুন ঘটনা। মৃত্যুর পর পাওয়া যায় ৪০টির মতো আঁকার খাতা ও ডায়রি। ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় কবিতা উৎসবের মঞ্চে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এ সময়েই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান পটুয়া কামরুল হাসান। শিব নারায়ণের পতাকা থেকে তৈরি করেছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। যত দিন সবুজের বুকে লাল বৃত্ত ফুটে উঠবে, তত দিন একটি স্বাধীন জাতির চেতনায় অমর হয়ে থাকবেন পটুয়া কামরুল হাসান। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
No comments