সোনার ডিম পাড়া হাঁস মারা কেন? by তারিক আলী
প্রতিশোধ আকাঙ্ক্ষাতাড়িত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আর এক শত্রুকে নিশানা করে হত্যা করেছে। তাদের নাগরিকরা এখন এই মিশনের সাফল্য উদযাপন করছে। আর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবি্লউ বুশের আমলের কর্মকর্তারা বলছেন, এতেই প্রমাণিত হয় যে, শেষ পর্যন্ত গুয়ানতানামো বের নির্যাতন কাজ দিয়েছে।
ইউরোপ তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিশ্বে অন্যত্র অনুগতরা (পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টসহ) মার্কিন মিশনের সাফল্যে গদগদ।
বিন লাদেনকে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীর কাছে একটি বাড়িতে নিরাপদ আস্তানা করে দেওয়ার বিষয়টি কিছুটা উদ্ভট বটে। পাকিস্তানের সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানার বাইরে এই কর্মটি ঘটে থাকতে পারবে, এমন ধারণা বাজারে বিকোবার নয়। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে আমার ২০০৬ সালে আলাপের কথাটি এখানে উল্লেখ করা যায়। এটি আমার পাকিস্তান নিয়ে সর্বশেষ বইতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সে সময় ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন যে, মার্কিনিরা বিন লাদেনের মৃত্যু চায়। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখা পাকিস্তানের স্বার্থেই প্রয়োজন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শত শত কোটি ডলারের মার্কিন অর্থ ও অস্ত্র সাহায্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, 'যে হাঁসটি সোনার ডিম দিচ্ছে তাকে মারা কেন?' সে সময় আমার কাছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাটি উদ্ভট বা ভুল তথ্য দিয়ে আমাকে ভুলানোর চেষ্টা করছে কি-না সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। এখন মনে হচ্ছে, তিনি আমাকে সত্য কথাই বলেছিলেন।
পাকিস্তান এখন প্রচণ্ড বিতর্কের মধ্যে পড়ে গেল। যাই ঘটুক না কেন দেশটির রাজনৈতিক-সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট পড়েছে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। এ ঘটনা তারা জানত, একথা স্বীকার করা মাত্র তাদের নিজেদের মধ্যেই সমালোচনার ঝড় বয়ে যেত। পাকিস্তানের সৈন্যদের সীমান্ত মিশনে পাঠিয়ে নিজে দেশের লোকদের হত্যা করতে বাধ্য করার ঘটনা নিয়ে এমনিতেই জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষ এবং তীব্র বাদানুবাদ রয়েছে। আবার এটা যদি প্রকাশ পায় যে, জঙ্গি হেলিকপ্টারগুলো ওসামাকে খতম করার মিশনে পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশের সময় ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ওয়াশিংটন অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেনি, তাহলেও বিপদ।
সিআইএর বিদায়ী প্রধান লিওন পেনেটা বলেন, অপারেশনের খবর যাতে ফাঁস হয়ে না যায় সে কারণেই পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আগেভাগে কিছু জানানো হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু কাহিনী যেভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে কোন বর্ণনা যে ঠিক আর কোনটা ঠিক নয় তা নির্ণয় করাই মুশকিল। উইকিলিকস যেমনটা বলেছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে মার্কিন চালকবিহীন গোয়েন্দা বিমান হামলায় জনগণের মধ্যে ক্রোধ দেখা দেবে বিধায় ইসলামাবাদ প্রকাশ্যে এ হামলার ঘটনাকে নিন্দা জানালেও তারা এটাকে সহ্য করে যাবে মর্মে ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সমঝোতা রয়েছে। অন্যদিকে সমঝোতাটি ফাঁস হয়ে পড়ায় সিআইএ পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে আখ্যায়িত করেছে। বিন লাদেন মিশনে অংশ নেওয়া হেলিকপ্টারগুলোকে সম্ভবত রুটিন গোয়েন্দা মিশন পরিচালনার অংশ হিসেবে পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢুকতে অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকবে। তবে অতীতে যেমন এ ধরনের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের রাডার ব্যবস্থায় জ্যাম সৃষ্টি করত এবার সে ধরনের কিছুই করা হয়নি। পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য সূত্রও জোর দিয়ে বলছে যে, এই অভিযানের আগাম কোনো খবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ছিল না। আর এটা যদি পাকিস্তানিরা আগেভাগে টের পেত তাহলে আইএসআই এটাকে ভণ্ডুল করে দেওয়ার চেষ্টা করত এবং তখন তা পাকিস্তানের জন্যই বিপুল ক্ষতির কারণ হতে পারত। এতে পাকিস্তানে মার্কিন ভবিষ্যৎ সাহায্য আটকে যেত। ওয়াজিরিস্তানের পাহাড়ি এলাকার মতো কম অস্বস্তিকর কোনো দুর্গম স্থানে এ ধরনের অভিযান হলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জড়িত হতে পারত হয়তো।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সুবিধার হলে ওবামার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা ছাড়া বিন লাদেনের মৃত্যুতে কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। ইরাকে দখলদারিত্ব, আফগানিস্তান-পাকিস্তান যুদ্ধ ও ন্যাটোর লিবীয় এডভেন্সার অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হয়। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল অচলাবস্থাও অব্যাহত রয়েছে। ওসামার মৃত্যুতে আফগানিস্তানের তালেবান নেতারা এই ভেবে স্বস্তি পেতে পারেন যে, তাদের আর আল কায়দার সঙ্গী হিসেবে চিত্রিত করা হবে না। কিন্তু বিন লাদেনের মৃত্যুর ফলে আফগানিস্তান পরিস্থিতির সামান্য পরিবর্তনও ঘটবে না। বিদ্রোহীরা হয়তো কাবুল দখল করার অবস্থায় নেই (রাশিয়ার দখলদারিত্বের সময়ও তাদের সে অবস্থা ছিল না)। তবে তারা আফগানিস্তানের প্রচুর এলাকা কব্জা করার মতো অবস্থায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে না। যত তাড়াতাড়ি তারা আফগানিস্তান ছেড়ে যায় ততই মঙ্গল। আর যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হচ্ছে, ততক্ষণ তাদের পাকিস্তানের ওপরই নির্ভর করতে হবে।
তারিক আলী :আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী; গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
বিন লাদেনকে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীর কাছে একটি বাড়িতে নিরাপদ আস্তানা করে দেওয়ার বিষয়টি কিছুটা উদ্ভট বটে। পাকিস্তানের সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানার বাইরে এই কর্মটি ঘটে থাকতে পারবে, এমন ধারণা বাজারে বিকোবার নয়। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে আমার ২০০৬ সালে আলাপের কথাটি এখানে উল্লেখ করা যায়। এটি আমার পাকিস্তান নিয়ে সর্বশেষ বইতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সে সময় ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন যে, মার্কিনিরা বিন লাদেনের মৃত্যু চায়। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখা পাকিস্তানের স্বার্থেই প্রয়োজন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শত শত কোটি ডলারের মার্কিন অর্থ ও অস্ত্র সাহায্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, 'যে হাঁসটি সোনার ডিম দিচ্ছে তাকে মারা কেন?' সে সময় আমার কাছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাটি উদ্ভট বা ভুল তথ্য দিয়ে আমাকে ভুলানোর চেষ্টা করছে কি-না সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। এখন মনে হচ্ছে, তিনি আমাকে সত্য কথাই বলেছিলেন।
পাকিস্তান এখন প্রচণ্ড বিতর্কের মধ্যে পড়ে গেল। যাই ঘটুক না কেন দেশটির রাজনৈতিক-সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট পড়েছে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। এ ঘটনা তারা জানত, একথা স্বীকার করা মাত্র তাদের নিজেদের মধ্যেই সমালোচনার ঝড় বয়ে যেত। পাকিস্তানের সৈন্যদের সীমান্ত মিশনে পাঠিয়ে নিজে দেশের লোকদের হত্যা করতে বাধ্য করার ঘটনা নিয়ে এমনিতেই জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষ এবং তীব্র বাদানুবাদ রয়েছে। আবার এটা যদি প্রকাশ পায় যে, জঙ্গি হেলিকপ্টারগুলো ওসামাকে খতম করার মিশনে পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশের সময় ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ওয়াশিংটন অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেনি, তাহলেও বিপদ।
সিআইএর বিদায়ী প্রধান লিওন পেনেটা বলেন, অপারেশনের খবর যাতে ফাঁস হয়ে না যায় সে কারণেই পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আগেভাগে কিছু জানানো হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু কাহিনী যেভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে কোন বর্ণনা যে ঠিক আর কোনটা ঠিক নয় তা নির্ণয় করাই মুশকিল। উইকিলিকস যেমনটা বলেছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে মার্কিন চালকবিহীন গোয়েন্দা বিমান হামলায় জনগণের মধ্যে ক্রোধ দেখা দেবে বিধায় ইসলামাবাদ প্রকাশ্যে এ হামলার ঘটনাকে নিন্দা জানালেও তারা এটাকে সহ্য করে যাবে মর্মে ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সমঝোতা রয়েছে। অন্যদিকে সমঝোতাটি ফাঁস হয়ে পড়ায় সিআইএ পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে আখ্যায়িত করেছে। বিন লাদেন মিশনে অংশ নেওয়া হেলিকপ্টারগুলোকে সম্ভবত রুটিন গোয়েন্দা মিশন পরিচালনার অংশ হিসেবে পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢুকতে অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকবে। তবে অতীতে যেমন এ ধরনের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের রাডার ব্যবস্থায় জ্যাম সৃষ্টি করত এবার সে ধরনের কিছুই করা হয়নি। পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য সূত্রও জোর দিয়ে বলছে যে, এই অভিযানের আগাম কোনো খবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ছিল না। আর এটা যদি পাকিস্তানিরা আগেভাগে টের পেত তাহলে আইএসআই এটাকে ভণ্ডুল করে দেওয়ার চেষ্টা করত এবং তখন তা পাকিস্তানের জন্যই বিপুল ক্ষতির কারণ হতে পারত। এতে পাকিস্তানে মার্কিন ভবিষ্যৎ সাহায্য আটকে যেত। ওয়াজিরিস্তানের পাহাড়ি এলাকার মতো কম অস্বস্তিকর কোনো দুর্গম স্থানে এ ধরনের অভিযান হলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জড়িত হতে পারত হয়তো।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সুবিধার হলে ওবামার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা ছাড়া বিন লাদেনের মৃত্যুতে কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। ইরাকে দখলদারিত্ব, আফগানিস্তান-পাকিস্তান যুদ্ধ ও ন্যাটোর লিবীয় এডভেন্সার অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হয়। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল অচলাবস্থাও অব্যাহত রয়েছে। ওসামার মৃত্যুতে আফগানিস্তানের তালেবান নেতারা এই ভেবে স্বস্তি পেতে পারেন যে, তাদের আর আল কায়দার সঙ্গী হিসেবে চিত্রিত করা হবে না। কিন্তু বিন লাদেনের মৃত্যুর ফলে আফগানিস্তান পরিস্থিতির সামান্য পরিবর্তনও ঘটবে না। বিদ্রোহীরা হয়তো কাবুল দখল করার অবস্থায় নেই (রাশিয়ার দখলদারিত্বের সময়ও তাদের সে অবস্থা ছিল না)। তবে তারা আফগানিস্তানের প্রচুর এলাকা কব্জা করার মতো অবস্থায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে না। যত তাড়াতাড়ি তারা আফগানিস্তান ছেড়ে যায় ততই মঙ্গল। আর যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হচ্ছে, ততক্ষণ তাদের পাকিস্তানের ওপরই নির্ভর করতে হবে।
তারিক আলী :আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী; গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
No comments