একজন বিচারপতির অসৌজন্যমূলক মন্তব্য এটি-স্পিকারের রুলিং

বাংলাদেশে বিচার বিভাগ, পার্লামেন্ট ও শাসন বিভাগ পাকিস্তানের মতো মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াবে না- এ আশা ব্যক্ত করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ। হাইকোর্টের বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিনের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি যে উত্তেজনা দেখা দেয়, তার প্রেক্ষাপটে গতকাল সোমবার সংসদে দেওয়া রুলিংয়ে এ কথা বলেন


স্পিকার। অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন সংবিধান লঙ্ঘন করে সংসদ ও স্পিকার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। এ ধরনের মন্তব্য কোনো বিবেকবান মানুষ করতে পারে কি না সে প্রশ্নও করেন স্পিকার।
সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে কোনো বৈরিতা নেই উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, 'এটি সংসদ সম্পর্কে জনৈক মাননীয় বিচারপতির কিছু অসৌজন্যমূলক মন্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ-প্রসূত উক্তি। পুরো বিচার বিভাগকে এর সঙ্গে জড়ানো ঠিক হবে না। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, বর্তমানে এ দেশ পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ। আবারও বলছি, বাংলাদেশ।' পাকিস্তানে প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীকে অপসারণের পর শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ায়। এরপর সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ পদত্যাগে বাধ্য হন। সম্প্রতি বিচার বিভাগ দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকেও তলব করে।
ওই বিচারকের মন্তব্যের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি পদক্ষেপ নেবেন বলে রুলিংয়ে আশা ব্যক্ত করেন স্পিকার। সেই সঙ্গে তিনি ওই বিচারপতিকে অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাহারের জন্যও সংসদ সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানান।
গতকাল সোমবার বিকেলে সংসদ অধিবেশন শুরু হলে প্রশ্নোত্তর পর্ব টেবিলে উত্থাপনের পর স্পিকার এই রুলিং দেন। তিনি বলেন, 'গত ২৯ মে এ মহান সংসদে কয়েকজন সংসদ সদস্যের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি কিছু কথা বলেছিলাম। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল মূলত সংসদ, আদালত ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক এবং তাদের কল্যাণ সাধন। সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সাধারণ মন্তব্য করা হয়েছিল।'
স্পিকার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'আমার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মহামান্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি যে বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন এবং তা নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তা সত্যিই দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত। আমি ভেবেছিলাম, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেব না বা মন্তব্য করব না। সবাই স্বীয় বিবেচনায় বিষয়টি অনুধাবন করবেন। কিন্তু পরে দেখলাম, এটির সঙ্গে আমার এবং মহান সংসদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমার অবস্থান স্পষ্ট না করলে মহান সংসদ এবং আমার সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা থেকে যেতে পারে।'
স্পিকার আরো বলেন, 'ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। প্রথমেই তিনি বলেছেন, আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। আমার উপরোক্ত কথাগুলোর কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতা কী, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন- এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি তাঁর বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।'
অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেন, "বিজ্ঞ বিচারপতি আমার বক্তব্য ভালোভাবে না শুনে, না পড়ে যে মন্তব্য করেছেন তাতে তিনি তাঁর বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে সমর্থ হননি। আসলে ওই দিন একজন সংসদ সদস্য স্পিকারের মাধ্যমে আইনমন্ত্রীর কাছে সড়ক ভবন সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন। আইনমন্ত্রী তখন সংসদে উপস্থিত না থাকায় আমি বিষয়টি সংসদকে অবহিত করি এবং বলি, 'থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটা দেখতেন।' এটুকুই বলেছি। এখানে 'আইনমন্ত্রীকে সড়ক ভবনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি' এ ধরনের কথা বলিনি।"
স্পিকার ২৯ মে সংসদে আলোচনার বিষয়টি পুনরাবৃত্তি করে বলেন, 'সেদিন সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম সংসদে সড়ক বিভাগের অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় বৃদ্ধির বিষয়টি আইনমন্ত্রীর নজরে আনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম- আইনমন্ত্রী নেই, থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটি দেখতেন। এরপর আমি যে কথাগুলো বলেছি, তার সারমর্ম হচ্ছে- মহামান্য আদালতের প্রতি আমাদের সবার শ্রদ্ধা আছে। আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। সড়ক ভবনের বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। এগুলো একটি আরেকটিকে সহযোগিতার জন্য রয়েছে। হঠাৎ এ ভবনকে সরিয়ে নিলে এর কার্যক্রম প্যারালাইজড হয়ে যাবে, যা সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।' স্পিকার বলেন, 'এ বিষয়গুলো যেন মহামান্য আদালত বিচার-বিবেচনা করেন, সে অনুরোধটুকু সেদিন করেছিলাম।'
স্পিকার আরো বলেন, 'ওই দিন পরে সংসদ সদস্য মইন উদ্দীন খান বাদল আদালতসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য দিলে আমি হাস্যোচ্ছলে বলেছি, আমার স্পিকারশিপের মেয়াদ শেষ হলে আমাকে আবার কালো কোট পরে কোর্টে যেতে হবে। সুতরাং হিসাব করে কথা বলতে হয়। আবার কোন সমস্যায় পড়ে যাই। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে রিলিফ না-ও পেতে পারি। এরপর গণমানুষের কাছে সবার জবাবদিহিতার বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলাম, সংসদে সংসদ সদস্যরা যে আইনগুলো পাস করেন সেগুলো যদি জনগণের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে শেষপর্যন্ত জনগণ আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। কোর্টের বিচারে যদি দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয় তাহলে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মানুষ একদিন হয়তো রুখে দাঁড়াতে পারে। একইভাবে যদি কোনো সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করে সে ক্ষেত্রে জনগণের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস আছে। সবাইকে চিন্তাভাবনা করে চলা প্রয়োজন। আত্মঅহমিকা বিসর্জন দিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার কথা বলেছি। কোনো আদালত বা কোনো মামলা বা কোনো বিচারপতিকে উদ্দেশ করে কোনো কথা বলা হয়নি। মূলত রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কাজে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে কী হতে পারে তারই একটা ধারণার কথা বলেছি।'
'স্পিকার হিসেবে আমি একক কোনো সত্তা নই' মন্তব্য করে আবদুল হামিদ বলেন, 'আমার জ্ঞান, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সংসদের সব সদস্যের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ধরনের উক্তি করার আগে বিজ্ঞ বিচারক আরো গভীরভাবে চিন্তা করলে ভালো করতেন। বিজ্ঞ বিচারক আরো অনেক বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, যা আমি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি না।'
জ্ঞান, মেধা, যোগ্যতা ও আইনজীবী হিসেবে তাঁর সনদ নিয়ে কটাক্ষ করার জবাবে স্পিকার বলেন, 'আমি প্রায়ই বলি, আমি কম লেখাপড়া জানা মানুষ। ষাটের দশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে, তাঁর সানি্নধ্যে এসে ছাত্র অবস্থায় মানুষের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলাম। রাজনীতির পাশাপাশি আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ ৩৭ বছর কাজ করেছি। সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্য হিসেবে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেছি। মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন ও এ বি এম খায়রুল হক এবং বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতির আদালতে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বড় বড় বই হয়তো পড়িনি; কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের কথাটি ৫৪ বছর ধরে পড়ে আসছি। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের কাছ থেকেও আমি সারা জীবন অনেক কিছু শিখেছি। তাদের মনের কথাটি পড়তে পারি বলেই হয়তো তাদের মনে ঠাঁই পেয়েছি।'
স্পিকার আরো বলেন, 'কিছু দিন আগে আমাদের দেশের একজন অধ্যাপক, বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিষয়ে সংসদে কিছু আলোচনা হয়েছিল। যখনই সংসদের কাছে তাঁর বক্তব্য সম্পর্কিত সঠিক ব্যাখ্যা গোচরীভূত হয়, তখনই সংসদ এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছে। অপ্রয়োজনীয় অংশ এক্সপাঞ্জ করেছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, মাননীয় বিচারপতি সমস্ত বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করবেন এবং মাত্রা অতিক্রমকারী বক্তব্য পরিহারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।'
সংসদের ক্ষমতা সম্পর্কে স্পিকার বলেন, 'রাষ্ট্রের ভিত্তি সংবিধান। সংবিধানের মূল স্তম্ভ সংসদ। এ সংসদই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। এ পদ্ধতিতেই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সংবিধান আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সংবিধানকে সমুন্নত রাখব- দেশবাসী এটাই প্রত্যাশা করে।'
গত ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চ স্পিকারকে উদ্দেশ করে 'অজ্ঞ, অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী' ইত্যাদি মন্তব্য করলে ওই দিন সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মহাজোটের সিনিয়র সংসদ সদস্যরা ওই বিচারপতিকে অপসারণের জন্য তিন দিনের মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানান। বিষয়টি নিয়ে ৬ জুন সংসদে আবারও আলোচনা হয় এবং কয়েকজন সংসদ সদস্য এ বিষয়ে স্পিকারের রুলিং চান। ওই সময় সংসদ অধিবেশনে স্পিকারের দায়িত্বে থাকা ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী জানান, বিষয়টি স্পিকার নিজে বলবেন। অবশেষে গতকাল স্পিকার এ বিষয়ে রুলিং দিলেন।

No comments

Powered by Blogger.