অরণ্যে রোদন-কুড়ি বছর পরের বাংলাদেশ by আনিসুল হক
আজ থেকে কুড়ি বছর পরে, ২০৩২ সালে, কেমন হবে বাংলাদেশ? আজকের সংবাদপত্র খুলে কোথাও কোনো আশা দেখতে পাই না। আশুলিয়ায় পোশাক তৈরির কারখানাগুলো বন্ধ, শ্রমিকেরা রাস্তায়, প্রাণপণ লড়াই করছে পুলিশের সঙ্গে। সংবাদপত্রের শিরোনাম, আশুলিয়া-কাঁচপুর রণক্ষেত্র।
এসব শিরোনাম আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে, শব্দ তার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য হারিয়েছে, রণক্ষেত্র মানে যে যুদ্ধের ময়দান, এই কথাটা আমরা, পাঠকেরা খুব আর ভেবে দেখি না। অন্যদিকে, শেয়ার মার্কেটের হতাশ বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় বসে পড়েছেন। খবরে প্রকাশ, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার ছেড়ে যাচ্ছেন। মহাসড়কে খানাখন্দ। সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক, তার ওপর যানজট। ঢাকা শহর চলে না, কিন্তু ঢাকা থেকে বাইরেও যাওয়া কষ্টকর। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা খুলনা বা রাজশাহী বা সিলেট বা ময়মনসিংহ যাত্রা করলে গন্তব্যে কখন পৌঁছানো যাবে, কেউ বলতে পারে না। অন্যদিকে, টিআইবির বার্ষিক সাধারণ সভায় ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দুর্নীতির ব্যাপকতায়’ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আরেকটি সেমিনারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘বাংলাদেশে শুধু অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নয়, আন্তর্জাতিক দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। দেশের বড় বড় দুর্নীতিবাজ শাস্তি না পেয়ে উল্টো পুরস্কৃত হচ্ছেন বলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।... দেশীয় দুর্নীতিবাজদের অনৈতিকতা ও অবক্ষয়কে রাষ্ট্র থেকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কুইক রেন্টালে ব্যাপক দুর্নীতি হলেও এ নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না নির্দেশ রয়েছে। এ জন্য এ খাতের অবস্থা এখন যথেচ্ছা হয়ে পড়েছে।’ (দৈনিক যুগান্তর, ১৮ জুন ২০১২) মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের বস্তা বাঁধতে ব্যস্ত, দেশ শেষ হয়ে যাক, মানুষ নিশ্চিহ্ন হোক; পরিবেশ, ও আবার কোন বালাই! এটা সলিমুদ্দি-কলিমুদ্দির মনোভাব হলে এক; কিন্তু শীর্ষস্থানীয়রা, ক্ষমতাবানেরা যখন কেবল নিজের পোঁটলাটা সামলাতে ব্যস্ত, তখন আশার আর কোনো জায়গা থাকে না। তখন সবকিছু ভেঙে পড়ে! তখন রাস্তাঘাট অচল হয়ে পড়ে, পুলিশ কথা শোনে না, বাতি জ্বলে না, সেতুর জায়গায় সেতু গড়ে ওঠে না। আমরা কেবল দুর্নীতিবাজ নই, আমরা অদক্ষও। বছর শেষে বাজেট ফিরে যায়, কারণ আমরা খরচ করতে পারি না। বাজেট যাতে ফিরে না যায়, সে জন্য তড়িঘড়ি করে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় এবং হরিলুট হয়।
দেশটা আসলে চলছে না। কিন্তু তবু তো চলছেই। খেয়েপরে বেঁচেই তো আছি। বাজারে গেলে তো চাল-ডাল কিনতেও পারি। আবার টাকা দিলে তো দোকানি জিনিসপাতি দেয়ও। এখনো তো এই নৈরাজ্য আসেনি, টাকা দিলাম, বললাম, দু কেজি চাল দাও, দোকানি গলা ধাক্কা দিয়ে বলল, টাকা দিলেই চাল দিতে হবে, এটা মগের মুল্লুক নাকি! এই যে বলছি, দেশ চলছে না, আবার বলছি চলছে, এই কথাটার মানে হলো, দেশের চাকা ঘোরাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের মেহনতি কৃষক। স্বাধীনতার সময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ছিল, এখন জনসংখ্যা তার দ্বিগুণ, কিন্তু কী বিপ্লবটাই না ঘটে গেছে কৃষিক্ষেত্রে, বছরে তিন ফসল, মাছ চাষে বিপ্লব, পোলট্রি খাতে বিপ্লব, এ কি যা-তা কথা। কাজ করছেন আমাদের উদ্যোক্তারা, ব্যবসায়ীরা, কারিগরেরা, শ্রমিকেরা। বিচিত্র ব্যবসা, বিচিত্র শিল্পোদ্যোগ। আর আছেন আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা, যাঁরা বহু কষ্টে বিদেশে যান, ততোধিক কষ্ট করে আয় করেন এবং দেশে টাকা পাঠান। এই যে প্রতিটা মানুষের নিজস্ব উদ্যোগ, এটাই দেশের চাকাটা ঘোরাচ্ছে। আর আমরা, কতিপয় স্বার্থভোগী মানুষ, এই সাধারণ পরিশ্রমী সৎ মানুষের পথচলাটাকে প্রতিনিয়ত থামিয়ে দিয়ে বলছি, টাকা দাও। আমাদের কোটি কোটি টাকা দরকার। দাও দাও। আমাদের কর্তব্য ছিল তাদের চলার পথটা মসৃণ করব, তাদের চলার গতিটা ত্বরান্বিত করব, নির্বিঘ্ন করব, কিন্তু করছি উল্টোটা। দেশে যে যথাসময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না, দেশে যে পদ্মা সেতু হয় না, সে দোষ তো গরিব দেশবাসীর নয়! কিন্তু ভুগতে হবে তাদেরই।
এ অবস্থায় আশা কোথায়?
দুই বছর পরে দেশটার কী হবে? যথাসময়ে নির্বাচন হবে? সেই নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে? ফলটা মোটামুটি গ্রহণীয় হবে, জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে নির্বাচনে? আমাদের মুদ্রার যে মাত্র দুটো পিঠ, দুই পিঠই তো আমরা দেখে ফেলেছি। আমরা যে বারবার ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপিত হচ্ছি। সেই কথাটা ভাবলেও তো চোখেমুখে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখি না। বাংলাদেশের মানুষের সামনে বাছাই করে নেওয়ার জন্য আছে দুটো দল বা জোট, হয় বিএনপি, নয়তো আওয়ামী লীগ। দুবার করে উভয়ের শাসনই দেখা হলো! তবু তো জনগণ পাঁচ বছর পর পর ভোট দিয়ে ক্ষমতায় কে যাবে নির্ধারণ করার মালিক ছিল, জনতার সেই ক্ষমতাটাও আদৌ থাকবে তো! আমাদের নেতাদের কথাবার্তা, হাবে-ভাবে বোঝা যায়, তাঁরা মনে করেন, তাঁরা খুব ভালো দেশ চালাচ্ছেন বা অতীতে চালিয়েছেন, তাঁদের আচার-আচরণ পরিবর্তনের কোনো কারণ ঘটেনি।
এ অবস্থায় আগামী পাঁচ বছর পরের বাংলাদেশটা কেমন হবে, কল্পনা করতে পারি না। দশ বছর পরের বাংলাদেশ কেমন হবে, হয়তো কল্পনা করা যায়, কিন্তু কল্পনা করার সাহস পাই না। একমাত্র উপায় হলো, কল্পনায় বিশ বছর পরের বাংলাদেশটাকে দেখা।
সেদিন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বিনায়ক সেন, আকবর আলি খান এসেছিলেন প্রথম আলোর কার্যালয়ে, বাজেট নিয়ে কথা বলতে। ড. মোস্তাফিজুর রহমানই বললেন, ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে সাত বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়, আজকে যদি মাথাপিছু আয় ৮০০ ডলার হয়, সাত বছর পরে হবে ১৬০০ ডলার, ১৪ বছর পরে ৩২০০ ডলার, ২১ বছর পরে ৬৪০০ ডলার। সেটা একটা কল্পনা হতে পারে। আরেকটা কল্পনা হলো, শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া তখন অবসরে যাবেন। তখন দেশটার নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে। আমাদের উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়ই তো সবচেয়ে বড় উপাদান।
থাক। কল্পনা করতে পারছি না। রংপুরে গিয়েছিলাম জিপিএ-৫ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। ২৩০০ ছেলেমেয়ের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। এরা সবাই মাধ্যমিক পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ফলটুকু অর্জন করে নিয়েছে। একজন বক্তৃতা করল, সে তিস্তা নদের জেলের ছেলে। সারা রাত বাবার সঙ্গে মাছ ধরে সকালবেলা ফিরেছে। বাবা বাজারে গিয়ে মাছ বেচে চাল কিনে ফিরেছেন, তারপর পরিবারের সবার খাবার জুটেছে। শিক্ষা একটা জাদুর কাঠি। কলকাতা থেকে কত দূরে ছিল বিদ্যাসাগরের বাড়ি, সেই যে হেঁটে হেঁটে মাইলফলক দেখে ধারাপাত শিখেছেন, আর কলকাতায় যে বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় পেয়েছিলেন, তাতে তাঁর পা পুরোটো মেলা যেত না। কিন্তু লেখাপড়া শিখে কেবল নিজে পাল্টে গেলেন না, সমাজটাকে পাল্টানোর ব্রতও তো গ্রহণ করলেন। পায়রাবন্দের রোকেয়া বাড়ির নিষেধ উপেক্ষা করে ইংরেজি আর বাংলা পড়তেন বলেই না আজ বাংলাদেশের নারীরা এতটা এগিয়ে! ৯০ ভাগের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, আশি হাজারেরও বেশি ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বিশ বছর পর এই বাচ্চাদের বয়স হবে ৩৬-৩৭। ওরা দায়িত্ব নেবে এই দেশটা গড়ার। ওরা কৃষক হলে ভালো কৃষক হবে, শ্রমিক হলে লেখাপড়া জানা শ্রমিক হবে। ওদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে নতুন দিনের দেশ গড়ার কারিগরেরা। ওরা অনেকেই বিদেশ যাবে এবং পাঠাবে মূল্যবান বিদেশি মুদ্রা, আর পাঠাবে তার চেয়েও মূল্যবান জ্ঞান, প্রযুক্তি, আইডিয়া।
পুঁজি গড়ে ওঠার কালে নৈরাজ্য হয়, লুটপাট হয়। কিন্তু পুঁজি গড়ে ওঠার পরে নিজের স্বার্থেই নিজেকে পাহারা দেয়, তার তখন দরকার হয় আইনের শাসন। সেটা কি কুড়ি বছর পরে পাব না?
অন্যদিকে, সর্বব্যাপী লুটপাট, তার সঙ্গে ক্ষমতায় থাকার ওতপ্রোত সম্পর্ক আমাদের রাজনীতিকে করে তুলেছে সংঘাতময়, সেটা কত ভয়াবহ পর্যায় পর্যন্ত যাবে, আমরা জানি না। আইভরি কোস্টে দুজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীই নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন, তারপর দুজনেই শপথ নিয়ে ফেলেছিলেন, তারপর শুরু হয়েছিল দুই পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই। আমরা কি সেই রকম সংঘর্ষের দিকে যাব? একটা ব্যাখ্যা হলো, আফ্রিকায় কৃষিসভ্যতাই আসেনি, আমরা কৃষিসভ্যতাটা পেয়েছিলাম। কাজেই একেবারে পুরোপুরি ব্যর্থ একটা রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কোনো আশঙ্কা আমাদের নেই।
যে জাতি যে রকম, সেই জাতি সেই রকম নেতাই তৈরি করে। কিন্তু এই জাতি তো একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা, তাজউদ্দীন আহমদের মতো সংগঠক পেয়েছিল। সময়ও তো মানুষ তৈরি করে। আমরা কি একজন যোগ্য নেতা পাব না? নাকি যোগ্য নেতা পাওয়ার মতো যোগ্যতা এই জাতির হয়নি! দুঃখে আমার প্রাণ ফেটে যায়, যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা চিকিৎসক বা প্রকৌশলীর মতো শিক্ষিত মানুষ নির্লজ্জ দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় শামিল হন! কিন্তু তারও চেয়ে অধিক দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের নেতারা এই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, কে কত বড়লোক হতে পারেন, কে কত কামিয়ে নিতে পারেন। না, বর্তমান নিয়ে শোক আর করব না!
ভবিষ্যতের স্বপ্নই দেখি। একটা নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে দুনিয়া-সেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার, তারা এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওড়ায় দেশের পতাকা। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোদ্যোগ, শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে আসছে নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে, সৃজনশীলতা নিয়ে।
তারা নিশ্চয়ই যোগ্য নেতা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়েই বেড়ে উঠছে, এগিয়ে আসছে।
আজ থেকে বিশ বছর পরে বাংলাদেশ যে একটা উন্নত আলোকিতসম্পন্ন বাংলাদেশ হবে, এটা একটা গাণিতিক বাস্তবতা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
দেশটা আসলে চলছে না। কিন্তু তবু তো চলছেই। খেয়েপরে বেঁচেই তো আছি। বাজারে গেলে তো চাল-ডাল কিনতেও পারি। আবার টাকা দিলে তো দোকানি জিনিসপাতি দেয়ও। এখনো তো এই নৈরাজ্য আসেনি, টাকা দিলাম, বললাম, দু কেজি চাল দাও, দোকানি গলা ধাক্কা দিয়ে বলল, টাকা দিলেই চাল দিতে হবে, এটা মগের মুল্লুক নাকি! এই যে বলছি, দেশ চলছে না, আবার বলছি চলছে, এই কথাটার মানে হলো, দেশের চাকা ঘোরাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের মেহনতি কৃষক। স্বাধীনতার সময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ছিল, এখন জনসংখ্যা তার দ্বিগুণ, কিন্তু কী বিপ্লবটাই না ঘটে গেছে কৃষিক্ষেত্রে, বছরে তিন ফসল, মাছ চাষে বিপ্লব, পোলট্রি খাতে বিপ্লব, এ কি যা-তা কথা। কাজ করছেন আমাদের উদ্যোক্তারা, ব্যবসায়ীরা, কারিগরেরা, শ্রমিকেরা। বিচিত্র ব্যবসা, বিচিত্র শিল্পোদ্যোগ। আর আছেন আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা, যাঁরা বহু কষ্টে বিদেশে যান, ততোধিক কষ্ট করে আয় করেন এবং দেশে টাকা পাঠান। এই যে প্রতিটা মানুষের নিজস্ব উদ্যোগ, এটাই দেশের চাকাটা ঘোরাচ্ছে। আর আমরা, কতিপয় স্বার্থভোগী মানুষ, এই সাধারণ পরিশ্রমী সৎ মানুষের পথচলাটাকে প্রতিনিয়ত থামিয়ে দিয়ে বলছি, টাকা দাও। আমাদের কোটি কোটি টাকা দরকার। দাও দাও। আমাদের কর্তব্য ছিল তাদের চলার পথটা মসৃণ করব, তাদের চলার গতিটা ত্বরান্বিত করব, নির্বিঘ্ন করব, কিন্তু করছি উল্টোটা। দেশে যে যথাসময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না, দেশে যে পদ্মা সেতু হয় না, সে দোষ তো গরিব দেশবাসীর নয়! কিন্তু ভুগতে হবে তাদেরই।
এ অবস্থায় আশা কোথায়?
দুই বছর পরে দেশটার কী হবে? যথাসময়ে নির্বাচন হবে? সেই নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে? ফলটা মোটামুটি গ্রহণীয় হবে, জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে নির্বাচনে? আমাদের মুদ্রার যে মাত্র দুটো পিঠ, দুই পিঠই তো আমরা দেখে ফেলেছি। আমরা যে বারবার ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপিত হচ্ছি। সেই কথাটা ভাবলেও তো চোখেমুখে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখি না। বাংলাদেশের মানুষের সামনে বাছাই করে নেওয়ার জন্য আছে দুটো দল বা জোট, হয় বিএনপি, নয়তো আওয়ামী লীগ। দুবার করে উভয়ের শাসনই দেখা হলো! তবু তো জনগণ পাঁচ বছর পর পর ভোট দিয়ে ক্ষমতায় কে যাবে নির্ধারণ করার মালিক ছিল, জনতার সেই ক্ষমতাটাও আদৌ থাকবে তো! আমাদের নেতাদের কথাবার্তা, হাবে-ভাবে বোঝা যায়, তাঁরা মনে করেন, তাঁরা খুব ভালো দেশ চালাচ্ছেন বা অতীতে চালিয়েছেন, তাঁদের আচার-আচরণ পরিবর্তনের কোনো কারণ ঘটেনি।
এ অবস্থায় আগামী পাঁচ বছর পরের বাংলাদেশটা কেমন হবে, কল্পনা করতে পারি না। দশ বছর পরের বাংলাদেশ কেমন হবে, হয়তো কল্পনা করা যায়, কিন্তু কল্পনা করার সাহস পাই না। একমাত্র উপায় হলো, কল্পনায় বিশ বছর পরের বাংলাদেশটাকে দেখা।
সেদিন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বিনায়ক সেন, আকবর আলি খান এসেছিলেন প্রথম আলোর কার্যালয়ে, বাজেট নিয়ে কথা বলতে। ড. মোস্তাফিজুর রহমানই বললেন, ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে সাত বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়, আজকে যদি মাথাপিছু আয় ৮০০ ডলার হয়, সাত বছর পরে হবে ১৬০০ ডলার, ১৪ বছর পরে ৩২০০ ডলার, ২১ বছর পরে ৬৪০০ ডলার। সেটা একটা কল্পনা হতে পারে। আরেকটা কল্পনা হলো, শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া তখন অবসরে যাবেন। তখন দেশটার নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে। আমাদের উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়ই তো সবচেয়ে বড় উপাদান।
থাক। কল্পনা করতে পারছি না। রংপুরে গিয়েছিলাম জিপিএ-৫ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। ২৩০০ ছেলেমেয়ের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। এরা সবাই মাধ্যমিক পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ফলটুকু অর্জন করে নিয়েছে। একজন বক্তৃতা করল, সে তিস্তা নদের জেলের ছেলে। সারা রাত বাবার সঙ্গে মাছ ধরে সকালবেলা ফিরেছে। বাবা বাজারে গিয়ে মাছ বেচে চাল কিনে ফিরেছেন, তারপর পরিবারের সবার খাবার জুটেছে। শিক্ষা একটা জাদুর কাঠি। কলকাতা থেকে কত দূরে ছিল বিদ্যাসাগরের বাড়ি, সেই যে হেঁটে হেঁটে মাইলফলক দেখে ধারাপাত শিখেছেন, আর কলকাতায় যে বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় পেয়েছিলেন, তাতে তাঁর পা পুরোটো মেলা যেত না। কিন্তু লেখাপড়া শিখে কেবল নিজে পাল্টে গেলেন না, সমাজটাকে পাল্টানোর ব্রতও তো গ্রহণ করলেন। পায়রাবন্দের রোকেয়া বাড়ির নিষেধ উপেক্ষা করে ইংরেজি আর বাংলা পড়তেন বলেই না আজ বাংলাদেশের নারীরা এতটা এগিয়ে! ৯০ ভাগের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, আশি হাজারেরও বেশি ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বিশ বছর পর এই বাচ্চাদের বয়স হবে ৩৬-৩৭। ওরা দায়িত্ব নেবে এই দেশটা গড়ার। ওরা কৃষক হলে ভালো কৃষক হবে, শ্রমিক হলে লেখাপড়া জানা শ্রমিক হবে। ওদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে নতুন দিনের দেশ গড়ার কারিগরেরা। ওরা অনেকেই বিদেশ যাবে এবং পাঠাবে মূল্যবান বিদেশি মুদ্রা, আর পাঠাবে তার চেয়েও মূল্যবান জ্ঞান, প্রযুক্তি, আইডিয়া।
পুঁজি গড়ে ওঠার কালে নৈরাজ্য হয়, লুটপাট হয়। কিন্তু পুঁজি গড়ে ওঠার পরে নিজের স্বার্থেই নিজেকে পাহারা দেয়, তার তখন দরকার হয় আইনের শাসন। সেটা কি কুড়ি বছর পরে পাব না?
অন্যদিকে, সর্বব্যাপী লুটপাট, তার সঙ্গে ক্ষমতায় থাকার ওতপ্রোত সম্পর্ক আমাদের রাজনীতিকে করে তুলেছে সংঘাতময়, সেটা কত ভয়াবহ পর্যায় পর্যন্ত যাবে, আমরা জানি না। আইভরি কোস্টে দুজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীই নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন, তারপর দুজনেই শপথ নিয়ে ফেলেছিলেন, তারপর শুরু হয়েছিল দুই পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই। আমরা কি সেই রকম সংঘর্ষের দিকে যাব? একটা ব্যাখ্যা হলো, আফ্রিকায় কৃষিসভ্যতাই আসেনি, আমরা কৃষিসভ্যতাটা পেয়েছিলাম। কাজেই একেবারে পুরোপুরি ব্যর্থ একটা রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কোনো আশঙ্কা আমাদের নেই।
যে জাতি যে রকম, সেই জাতি সেই রকম নেতাই তৈরি করে। কিন্তু এই জাতি তো একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা, তাজউদ্দীন আহমদের মতো সংগঠক পেয়েছিল। সময়ও তো মানুষ তৈরি করে। আমরা কি একজন যোগ্য নেতা পাব না? নাকি যোগ্য নেতা পাওয়ার মতো যোগ্যতা এই জাতির হয়নি! দুঃখে আমার প্রাণ ফেটে যায়, যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা চিকিৎসক বা প্রকৌশলীর মতো শিক্ষিত মানুষ নির্লজ্জ দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় শামিল হন! কিন্তু তারও চেয়ে অধিক দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের নেতারা এই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, কে কত বড়লোক হতে পারেন, কে কত কামিয়ে নিতে পারেন। না, বর্তমান নিয়ে শোক আর করব না!
ভবিষ্যতের স্বপ্নই দেখি। একটা নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে দুনিয়া-সেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার, তারা এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওড়ায় দেশের পতাকা। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোদ্যোগ, শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে আসছে নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে, সৃজনশীলতা নিয়ে।
তারা নিশ্চয়ই যোগ্য নেতা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়েই বেড়ে উঠছে, এগিয়ে আসছে।
আজ থেকে বিশ বছর পরে বাংলাদেশ যে একটা উন্নত আলোকিতসম্পন্ন বাংলাদেশ হবে, এটা একটা গাণিতিক বাস্তবতা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments