বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪২৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. আবদুস শুকুর, বীর বিক্রম দক্ষ এক মুক্তিযোদ্ধা কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত আর প্রচণ্ড শীত। তার মধ্যে মো. আবদুস শুকুরসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা নিঃশব্দে অবস্থান নিলেন শত্রু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে।
বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধার পিঠে ও মাথায় কেমোফ্লেজ হিসেবে বাঁধা ধানের খড় ও পাতাসহ ছোট ছোট ডাল। তাঁরা কয়েকটি দল। মো. আবদুস শুকুর একটি ছোট দলের নেতৃত্বে। তাঁদের কাছে আছে মর্টার।
মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার তিন দিক ঘিরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছেন। মো. আবদুস শুকুরের দল অগ্রবর্তী দল। তাঁরা মর্টার ছোড়ার পর পেছনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। সময় গড়াতে থাকল। আক্রমণের নির্ধারিত সময় ঘনিয়ে আসতে থাকল।
নির্ধারিত সময়েই সেই সংকেত এল। যুদ্ধক্ষেত্রের অধিনায়কের সংকেত পাওয়ামাত্র মো. আবদুস শুকুরের দলের মর্টারগুলো গর্জে উঠল। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে একের পর এক মর্টারের গোলা ছুড়লেন। নিখুঁত নিশানায় সেগুলো পাকিস্তানি অবস্থানে পড়ল। বেশির ভাগই আঘাত হানল সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে। একই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান থেকে গুলি শুরু হয়েছে। মর্টার, মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রের গোলাগুলিতে সেখানকার আকাশ আলোকিত।
পাকিস্তানিদের দিক থেকে তেমন প্রতিউত্তর এল না। মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না, মর্টারের আঘাতে ওদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়েছে। এরপর তাঁরা জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন। পাকিস্তানিরা অবস্থা বেগতিক দেখে পেছনে হটতে থাকল। এ ঘটনা সিলেট জেলার গোবিন্দগঞ্জে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর।
মো. আবদুস শুকুর চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের অধীন ৮ নম্বর উইংয়ে। এই উইংয়ের একটি কোম্পানির অবস্থান ছিল বাসুদেবপুরে। তখন তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। তিনি ওই কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মো. আবদুস শুকুর ২৮ মার্চ সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিদ্রোহ করে পরদিন রাতে ফুলবাড়ী-দিনাজপুর সড়কে অবস্থান নেন। এর আগেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল ফুলবাড়ীতে আক্রমণ করে। আক্রমণ শেষে সেনাদের পার্বতীপুর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পথ ভুলে তারা দিনাজপুরের দিকেই রওনা হয়। তখন তিনি তাদের আক্রমণ করেন। রাত ১০টা থেকে সকাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মো. আবদুস শুকুর প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে তিনি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাঁকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি (সি) কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ, দেওয়ানগঞ্জ, সিলেট জেলার ছাতক, সালুটিকর, টেংরাটিলাসহ আরও কয়েক স্থানে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুস শুকুরকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৭।
মো. আবদুস শুকুর স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে এডি পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ভারতে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। বর্তমানে বাস করেন রংপুর জেলা শহরের কামালকাছনায়। তাঁর বাবার নাম শেখ আনোয়ার আলী। মা আমেনা খাতুন। স্ত্রী রবেদা খাতুন। তাঁদের দুই মেয়ে, তিন ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর রংপুর প্রতিনিধি আরিফুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী, সুকুমার বিশ্বাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার তিন দিক ঘিরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছেন। মো. আবদুস শুকুরের দল অগ্রবর্তী দল। তাঁরা মর্টার ছোড়ার পর পেছনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। সময় গড়াতে থাকল। আক্রমণের নির্ধারিত সময় ঘনিয়ে আসতে থাকল।
নির্ধারিত সময়েই সেই সংকেত এল। যুদ্ধক্ষেত্রের অধিনায়কের সংকেত পাওয়ামাত্র মো. আবদুস শুকুরের দলের মর্টারগুলো গর্জে উঠল। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে একের পর এক মর্টারের গোলা ছুড়লেন। নিখুঁত নিশানায় সেগুলো পাকিস্তানি অবস্থানে পড়ল। বেশির ভাগই আঘাত হানল সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে। একই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান থেকে গুলি শুরু হয়েছে। মর্টার, মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রের গোলাগুলিতে সেখানকার আকাশ আলোকিত।
পাকিস্তানিদের দিক থেকে তেমন প্রতিউত্তর এল না। মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না, মর্টারের আঘাতে ওদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়েছে। এরপর তাঁরা জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন। পাকিস্তানিরা অবস্থা বেগতিক দেখে পেছনে হটতে থাকল। এ ঘটনা সিলেট জেলার গোবিন্দগঞ্জে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর।
মো. আবদুস শুকুর চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের অধীন ৮ নম্বর উইংয়ে। এই উইংয়ের একটি কোম্পানির অবস্থান ছিল বাসুদেবপুরে। তখন তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। তিনি ওই কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মো. আবদুস শুকুর ২৮ মার্চ সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিদ্রোহ করে পরদিন রাতে ফুলবাড়ী-দিনাজপুর সড়কে অবস্থান নেন। এর আগেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল ফুলবাড়ীতে আক্রমণ করে। আক্রমণ শেষে সেনাদের পার্বতীপুর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পথ ভুলে তারা দিনাজপুরের দিকেই রওনা হয়। তখন তিনি তাদের আক্রমণ করেন। রাত ১০টা থেকে সকাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মো. আবদুস শুকুর প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে তিনি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাঁকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি (সি) কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ, দেওয়ানগঞ্জ, সিলেট জেলার ছাতক, সালুটিকর, টেংরাটিলাসহ আরও কয়েক স্থানে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. আবদুস শুকুরকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৭।
মো. আবদুস শুকুর স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে এডি পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ভারতে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। বর্তমানে বাস করেন রংপুর জেলা শহরের কামালকাছনায়। তাঁর বাবার নাম শেখ আনোয়ার আলী। মা আমেনা খাতুন। স্ত্রী রবেদা খাতুন। তাঁদের দুই মেয়ে, তিন ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর রংপুর প্রতিনিধি আরিফুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী, সুকুমার বিশ্বাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments