ধর্ম-পরিমিত পানাহার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রোজা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের তৃতীয় হচ্ছে সিয়াম সাধনা বা রোজা তথা নির্ধারিত সময়ের জন্য খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থেকে উপবাস যাপন। মানবজাতি এ রোজার মাধ্যমে মানসিকভাবে আত্মসংযমে অভ্যস্ত হয়। দেহের বেশির ভাগ রোগের সৃষ্টির কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ। পক্ষান্তরে পরিমিত পানাহার ও আত্মসংযমের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘সুস্বাস্থ্যের জন্য রোজা রাখো।’
উপবাস কিডনি ও লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে নতুন জীবনীশক্তি সৃষ্টি করে রোজাদারের মনে সজীব অনুভূতি এনে দেয়। সিয়াম সাধনায় দেহের পরিপাকযন্ত্র একপ্রকার পরিশুদ্ধি লাভের অবকাশ পায়। ফলে দেহের অপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সারাংশ ও সঞ্চিত বিষাক্ত রস নিঃশেষ হয়ে যায়। দেহের বাড়তি ওজন, রস, চর্বি ইত্যাদি হ্রাস পায়। পাকস্থলীসংক্রান্ত রোগসমূহ যেমন—ক্ষুধামান্দ্য, পেট ফাঁপা, টক ঢেঁকুর, লিভারের দুর্বলতা, বমি বমি ভাব সিয়াম সাধনার ফলে স্বাভাবিকভাবেই উপশম হওয়ার সুযোগ পায়।
মানবদেহে গৃহীত খাদ্যদ্রব্যের শতকরা ২৫ ভাগ বা এর অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়। দেহযন্ত্রে খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে টকসিন নামক একপ্রকার রসজাতীয় বিষ সঞ্চিত হয়ে থাকে। বাড়তি খাদ্যদ্রব্যাদি ক্ষেত্রবিশেষে স্বাস্থ্যরক্ষায় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একনাগাড়ে কিছুদিন রোজার মাধ্যমে পরিপাকযন্ত্র খালি রাখলে দেহের ভেতর সঞ্চিত বিষাক্ত রস নিঃশেষ হয়ে যায় এবং উত্তম রস দেহের মধ্যে কোনো প্রকার ক্ষতিসাধনের অবকাশ রাখে না। পরিমিত পানাহার সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা আহার করবে ও পান করবে, কিন্তু অপচয় করবে না; নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত-৩১)
রোজা মানবস্ব্বাস্থ্যের বিরাট উপকার সাধন করে। সারা বছর অনিয়মিত বা অতিরিক্ত পানাহার বা অধিক চর্বিযুক্ত খাদ্য খেয়ে রক্তে যখন প্রচুর কোলেস্টেরল জমে প্রেশার বা অন্য যেকোনো হূৎপীড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন রোজার উপবাস রক্তের কোলেস্টেরল ও হূৎপীড়ার আশঙ্কামুক্ত করে। অতিভোজনের অত্যাচারে পাকস্থলী যখন হতোদ্যম ও দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন এক মাসের দিবাভাগের রোজা পাকস্থলীকে সবল করে নতুন জীবন দান করে, ফলে রক্ত ও রক্তনালিগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়।
স্বাস্থ্থ্যবিদদের কথা, ‘শরীরটাকে ভালো রাখতে চাও তো রোজা করো।’ নীরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম সুস্ব্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরের কতিপয় দিন উপবাসের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উপবাসকালে শরীরের মধ্যস্থিত, প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করাজাতীয় পদার্থসমূহ স্বয়ং পাচিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোতে পুষ্টি বিধান হয়। ফলে শরীরে উৎপন্ন উৎসেচকগুলো বিভিন্ন কোষে ছড়িয়ে পড়ে। এটি হচ্ছে শরীর বিক্রিয়ার এক স্বাভাবিক পদ্ধতি। রোজা এ পদ্ধতিকে সহজ, সাবলীল ও গতিময় করে।
রোজার উপবাসের মাধ্যমে লিভার রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়। ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশির প্রোটিন, গ্রন্থিসমূহ এবং লিভারে কোষসমূহ আন্দোলিত হয়। অভ্যন্তরীণ দেহযন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং হূৎপিণ্ডের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহাংশগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। খাদ্যাভাব বা আরাম-আয়েশের জন্য মানুষের শরীরের যে ক্ষতি হয়, রোজা তা পূরণ করে দেয়। আধ্যাত্মিক সুফি-সাধকদের মতে, হূদয়ের স্বচ্ছতা হাসিলে পরিমিত পানাহার ও স্বল্প খাদ্য গ্রহণের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
মাহে রমজানে অনেকে চিন্তিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে রোজা রাখলে নাকি শরীর-স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু রোজায় কারও স্বাস্থ্য বিনষ্ট হয়ে গেছে বা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কোনো রোজাদারের মৃত্যু হয়েছে, এমন ঘটনা ঘটেনি। রোজা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং মঙ্গলজনক। তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাবার হতে হবে পুষ্টিকর ও পরিমিত। রোজার সময় মানুষের শরীরের বিপাকক্রিয়া বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা পরিবর্তিত নয় বলে সহজপাচ্য অর্থাৎ সহজে হজম হয়, এজাতীয় খাবার গ্রহণ করা উচিত। রোজা একই সঙ্গে দেহে রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। রোজাদারের শরীরে পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার দরুন চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না। রোজার সামগ্রিক প্রভাব মানবস্বাস্থ্যের ওপর ধীরভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে এবং রোজার মাধ্যমে শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
সূর্যাস্তের পর রাত্রি শুরুর প্রাক্কালে গোধূলিলগ্নে রোজা শেষ করার মধ্যে মানসিক, আধ্যাত্মিক এমনকি শারীরিক নিগূঢ় রহস্য ও তাৎপর্য রয়েছে। সেহির থেকে ইফতার পর্যন্ত বেশ অনেকটা সময় পরে খাদ্য গ্রহণে সতর্ক থাকলে শারীরিকভাবে সুস্থ থেকে রোজা পালন সম্ভব। রোজার মাসে খাবার সাধারণত তিনবার খাওয়া হয়—ইফতার, কিছুক্ষণ পরে সন্ধ্যা রাতের খাবার এবং সেহির। স্বাস্থ্য খাবারের ওপর নির্ভরশীল, খাদ্য গ্রহণের সময়ে পরিবর্তনের দরুন স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, তাই রমজান মাসে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। ডায়াবেটিস, পেপটিক আলসার, উচ্চ রক্তচাপ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীরা নিয়মিত ওষুধ সেবন করে রোজা রাখতে পারেন। দেহ সুস্থ থাকলে মন ভালো থাকে, মন ভালো থাকলে ইচ্ছামাফিক আল্লাহর ইবাদত করতে পারবেন। সুতরাং পরিমিত পানাহার ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে রোজাদারদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
মানবদেহে গৃহীত খাদ্যদ্রব্যের শতকরা ২৫ ভাগ বা এর অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়। দেহযন্ত্রে খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে টকসিন নামক একপ্রকার রসজাতীয় বিষ সঞ্চিত হয়ে থাকে। বাড়তি খাদ্যদ্রব্যাদি ক্ষেত্রবিশেষে স্বাস্থ্যরক্ষায় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একনাগাড়ে কিছুদিন রোজার মাধ্যমে পরিপাকযন্ত্র খালি রাখলে দেহের ভেতর সঞ্চিত বিষাক্ত রস নিঃশেষ হয়ে যায় এবং উত্তম রস দেহের মধ্যে কোনো প্রকার ক্ষতিসাধনের অবকাশ রাখে না। পরিমিত পানাহার সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা আহার করবে ও পান করবে, কিন্তু অপচয় করবে না; নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত-৩১)
রোজা মানবস্ব্বাস্থ্যের বিরাট উপকার সাধন করে। সারা বছর অনিয়মিত বা অতিরিক্ত পানাহার বা অধিক চর্বিযুক্ত খাদ্য খেয়ে রক্তে যখন প্রচুর কোলেস্টেরল জমে প্রেশার বা অন্য যেকোনো হূৎপীড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন রোজার উপবাস রক্তের কোলেস্টেরল ও হূৎপীড়ার আশঙ্কামুক্ত করে। অতিভোজনের অত্যাচারে পাকস্থলী যখন হতোদ্যম ও দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন এক মাসের দিবাভাগের রোজা পাকস্থলীকে সবল করে নতুন জীবন দান করে, ফলে রক্ত ও রক্তনালিগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়।
স্বাস্থ্থ্যবিদদের কথা, ‘শরীরটাকে ভালো রাখতে চাও তো রোজা করো।’ নীরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম সুস্ব্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরের কতিপয় দিন উপবাসের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উপবাসকালে শরীরের মধ্যস্থিত, প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করাজাতীয় পদার্থসমূহ স্বয়ং পাচিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোতে পুষ্টি বিধান হয়। ফলে শরীরে উৎপন্ন উৎসেচকগুলো বিভিন্ন কোষে ছড়িয়ে পড়ে। এটি হচ্ছে শরীর বিক্রিয়ার এক স্বাভাবিক পদ্ধতি। রোজা এ পদ্ধতিকে সহজ, সাবলীল ও গতিময় করে।
রোজার উপবাসের মাধ্যমে লিভার রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়। ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশির প্রোটিন, গ্রন্থিসমূহ এবং লিভারে কোষসমূহ আন্দোলিত হয়। অভ্যন্তরীণ দেহযন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং হূৎপিণ্ডের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহাংশগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। খাদ্যাভাব বা আরাম-আয়েশের জন্য মানুষের শরীরের যে ক্ষতি হয়, রোজা তা পূরণ করে দেয়। আধ্যাত্মিক সুফি-সাধকদের মতে, হূদয়ের স্বচ্ছতা হাসিলে পরিমিত পানাহার ও স্বল্প খাদ্য গ্রহণের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
মাহে রমজানে অনেকে চিন্তিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে রোজা রাখলে নাকি শরীর-স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু রোজায় কারও স্বাস্থ্য বিনষ্ট হয়ে গেছে বা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কোনো রোজাদারের মৃত্যু হয়েছে, এমন ঘটনা ঘটেনি। রোজা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং মঙ্গলজনক। তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাবার হতে হবে পুষ্টিকর ও পরিমিত। রোজার সময় মানুষের শরীরের বিপাকক্রিয়া বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা পরিবর্তিত নয় বলে সহজপাচ্য অর্থাৎ সহজে হজম হয়, এজাতীয় খাবার গ্রহণ করা উচিত। রোজা একই সঙ্গে দেহে রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। রোজাদারের শরীরে পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার দরুন চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না। রোজার সামগ্রিক প্রভাব মানবস্বাস্থ্যের ওপর ধীরভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে এবং রোজার মাধ্যমে শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
সূর্যাস্তের পর রাত্রি শুরুর প্রাক্কালে গোধূলিলগ্নে রোজা শেষ করার মধ্যে মানসিক, আধ্যাত্মিক এমনকি শারীরিক নিগূঢ় রহস্য ও তাৎপর্য রয়েছে। সেহির থেকে ইফতার পর্যন্ত বেশ অনেকটা সময় পরে খাদ্য গ্রহণে সতর্ক থাকলে শারীরিকভাবে সুস্থ থেকে রোজা পালন সম্ভব। রোজার মাসে খাবার সাধারণত তিনবার খাওয়া হয়—ইফতার, কিছুক্ষণ পরে সন্ধ্যা রাতের খাবার এবং সেহির। স্বাস্থ্য খাবারের ওপর নির্ভরশীল, খাদ্য গ্রহণের সময়ে পরিবর্তনের দরুন স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, তাই রমজান মাসে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। ডায়াবেটিস, পেপটিক আলসার, উচ্চ রক্তচাপ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীরা নিয়মিত ওষুধ সেবন করে রোজা রাখতে পারেন। দেহ সুস্থ থাকলে মন ভালো থাকে, মন ভালো থাকলে ইচ্ছামাফিক আল্লাহর ইবাদত করতে পারবেন। সুতরাং পরিমিত পানাহার ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে রোজাদারদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments