সমকালীন প্রসঙ্গ-নাগরিক আন্দোলনই দেখাতে পারে নতুন দিশা by আবু সাঈদ খান
দুর্নীতি প্রতিরোধে ও যৌক্তিক আইন প্রণয়নে আন্না হাজারের নেতৃত্বে সারা ভারতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে অস্থির সহিংস দুর্নীতি নিমগ্ন পরিস্থিতিতে একটি নাগরিক আন্দোলন নতুন আশার আলো জ্বালাতে পারে। হতাশা-অস্থিরতা-সহিংসতাকে পরাস্ত করতে, দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে,
রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করে আদর্শবাদী ধারা তৈরিতে নাগরিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। তবে মনে করার কোনো কারণ নেই যে, নাগরিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের একমাত্র বিকল্প। আসলে রাজনীতিই সামগ্রিক পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি
দেশে অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা, সহিংসতা, হানাহানি, খুনোখুনি ইত্যাদি যেভাবে বেড়েছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, তা আর লুকানোর সুযোগ নেই। যখন এ কথা বলি, তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সমর্থকরা বলেন, অবনতি ঘটলেও বিগত বিএনপি বা জোট সরকারের আমলের পরিস্থিতি এর চেয়ে খারাপ ছিল। আসলে তখন আর এখনের মধ্যকার খারাপের মাত্রা মেপে দেখার কোনো বৈজ্ঞানিক নিক্তি আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা দেশের সব শাসক দলের আমলেই রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতি লক্ষ্য করেছি, ক্ষমতাবাজি-দলবাজির কাছে সব আশা-ভরসা জলাঞ্জলি দিয়েছি। কোন শাসক দলের আমলে কতখানি খারাপ ছিল; সে বিতর্কে আমি যাব না। বর্তমান সরকারের আমলের প্রায় তিন বছরকে দু'ভাগে বিভক্ত করে বলতে চাই যে, দ্বিতীয় ভাগে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে। আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতাদের মুখেও সেই সতর্কবার্তা শুনছি। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ওবায়দুল কাদের ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে নানা মন্তব্য করেছেন, সরকারের মন্ত্রীদের সতর্ক করেও দিয়েছেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকগুলোতে তৃণমূলের নেতাদের ক্ষোভ ও বিষোদ্গারের কথা শুনেছি। ৬ আগস্ট রাজধানীর এফবিসিসিআইর সেমিনারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতির ওপর কালো ছায়া ফেলছে। অস্থিরতা কেবল রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই। সমাজে, প্রশাসনে_ সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। যা রূপ নিচ্ছে সংঘর্ষ, হানাহানি, খুনোখুনি, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে। পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাই শেষ কথা নয়, একশ্রেণীর পুলিশ আমলা আজ দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অপরাধ সংঘটনে সক্রিয়। ঝালকাঠির একজন লিমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কাদেরের ঘটনা আমরা জানি। প্রতিদিন কত যে লিমন-কাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হচ্ছে তার খবর কে রাখে? পুলিশের গ্রেফতার-বাণিজ্যের ঘটনা আগের চেয়ে কমেনি। সমানে চলছে চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ-দখলবাজদের দৌরাত্ম্যও। ঐতিহ্যগত কারণেই আওয়ামী লীগের হাতে সংখ্যালঘুরা খানিকটা নিরাপদ ছিল। এখন দেখছি, সে ভরসাও নেই। তাদের থাবা থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে গোপালগঞ্জের বাবলু বিশ্বাস তার বাড়ি ফেরত পেয়েছেন। তবে অপরাধী আওয়ামী লীগ নেতা ডিগল মিয়া বহাল তবিয়তে আছেন। তার বিরুদ্ধে পুলিশি বা দলীয় কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না। এটি স্পষ্ট যে, সমাজে যে জুলুম-নিপীড়ন, নির্যাতন চলছে, সেসবের সঙ্গে কেবল ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জড়িত তা নয়, এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা আছেন, আছে প্রভাবশালী মহল। শুনেছি, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, সিটি করপোরেশন-পৌরসভার কাজ ভাগাভাগিতে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন দলের মধ্যে ৮০ পারসেন্ট বনাম ২০ পারসেন্ট অনুপাত প্রচলিত।
যখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, লুটপাটের মচ্ছব চলে, তখন সেখানে দুর্জন-লুটেরাদের ঐক্য হয়, আবার প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও দলমত নির্বিশেষে প্রতিবাদী মানুষের ঐক্য হয়। তাই আজকের দখলবাজি, লুটপাট, সামাজিক অপকর্মে সব অপশক্তি একাকার। এর নির্মম শিকার হচ্ছে সাধারণত ক্ষমতাহীন, গরিব, মধ্যবিত্ত, নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ।
রাজধানীর অদূরে আমিনবাজারে ৬ তরুণের হত্যাকে আমরা কীভাবে দেখব? পিটিয়ে মারার ঘটনা আরও ঘটছে। যখন ডাকাত বলে মানুষ কারও ওপর চড়াও হয়, তখন বুঝতে হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনাস্থা বেড়েছে এবং মানুষের মধ্যে নৃশংসতা ও নির্মমতা দানা বেঁধেছে। কিংবা এর পেছনে কাজ করেছে অপরাধী চক্রের শক্তি প্রদর্শনের অভিসন্ধি জাতীয় ব্যাপার।
আশঙ্কাজনকভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে তৃণমূলের নারীরা। মোল্লা, ফতোয়াবাজরা সক্রিয়। স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার, গ্রাম্য মোড়ল-মাতব্বর ও রাজনৈতিক কর্মীদের যোগসাজশে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে দাগি খুনি, এমনকি দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরাও।
এখন প্রশ্ন, এ পরিস্থিতির দায় কি সরকার এড়াতে পারে? আজকের অবনতিশীল পরিস্থিতির পেছনে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে জনমনের ব্যাপক হতাশা। যার কাছে মানুষ যত আশা করে, তার বৈরী আচরণে মানুষ তত হতাশ হয়।
অনেক আশায় শহর-গ্রামের গরিব মানুষ, মধ্যবিত্ত, সংখ্যালঘু, নারী, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মহাজোটকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে। ফলে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির যোগটি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে সৃষ্ট হতাশাও সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা বলাই বাহুল্য।
এই অস্থির, হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কী ভাবে সম্ভব? কেউ বলতে পারেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঠিক হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কথাটি সত্য। তার চেয়ে সত্য, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঠিক হচ্ছে না, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটছে না। দুই নেত্রী এখনও পরস্পরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে শাসক জোটের দায়িত্বই বেশি। দেশের মধ্যে যে হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটির দায় তাদের নিতে হবে। একইভাবে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব ঘোচানোর দায়ও প্রধানত তাদের ওপর বর্তাবে। সরকার প্রমাণ করতে পারেনি যে, বিরোধী দলকে কাছে টানার প্রশ্নে তারা আন্তরিক। বিরোধী দলও যুক্তিহীনভাবে সংসদে যাবে না বলে গোঁ ধরে আছে। রাজপথে সরকারকে মোকাবেলা করতে চাইছে। কিন্তু জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তাদের নেই। সবাই জানেন, সংসদের প্রথম সারিতে বসা, নেত্রীর বাড়ি রক্ষা, তার পুত্রদের দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য তারা আন্দোলনে নেমেছে। মন্ত্রীদের দুর্নীতি-ব্যর্থতা নিয়ে তাদের খুব বেশি বলার নেই। কারণ, একই কলঙ্ক তাদের অনেক নেতার গায়ে লেগে আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি যৌক্তিক হলেও আগাম ইস্যু। এটির পালে বাতাস পাচ্ছে না। সরকার ও বিরোধী দলের উভয়ের কর্মকাণ্ড গদি রক্ষা আর গদি দখলের লক্ষ্যেই পরিচালিত। বলা যায়, ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণীর নেতাকর্মী আখের গোছাচ্ছে, আরেক দলের নেতাকর্মীরা আছে আখের গোছানোর স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ক্ষমতাবাজি-দলবাজির কাছে জনস্বার্থ আজ ভূলুণ্ঠিত, সুবিধাবাদের দাপটে আদর্শবাদ কোণঠাসা, কৌশলের কাছে নীতি পরাজিত। দলতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, সুবিধাতন্ত্রই আজ রাজনীতির মন্ত্র। দলবাজি আজ আদালতকে বিভক্ত করেছে। প্রশাসন, পুলিশ সবাই দলবাজি-সুবিধাবাদিতায় আক্রান্ত। তাই দেশের সামগ্রিক কল্যাণে এর বিপরীতে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট আদর্শবাদী, নীতিবাদী, মানবতাবাদী ধারা প্রয়োজন।
এমন ধারা কখনও গড়ে উঠবে না_ যদি জনগণের মধ্যে জাগরণ তৈরি না হয়। রাজনীতির এই সুবিধাবাদী ধারার বিপরীতে আদর্শবাদী ধারা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নাগরিক আন্দোলনের গুরুত্ব সমধিক। পাকিস্তান আমলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন আমাদের চেতনার শিখা প্রজ্বলিত করেছিল, রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও প্রভাবিত করেছিল। স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে সংগঠিত হয়েছিল শ্রেণী-পেশার শক্তিশালী আন্দোলন।
অতীতে আমরা জাতীয় সংকটে, উত্থানে, জাগরণে সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, ড. আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফাসহ অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীদের নির্ভীক কণ্ঠ শুনেছি। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও ফয়েজ আহ্মদকে আন্দোলনের অগ্রভাগে দেখেছি। সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, আহমদ শরীফ, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ বেঁচে নেই। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ফয়েজ আহ্মদ প্রমুখ সম্ভবত বয়সের কারণে আগের মতো ভূমিকা রাখতে অসমর্থ। তাদের বাইরে তরুণ-প্রবীণ মিলিয়ে দেশে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা অনেক। দুর্ভাগ্য, বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ আজ দলীয় রাজনীতির বৃত্তে বন্দি। তবে কেউ কেউ সত্য উচ্চারণে দ্বিধাহীন।
বাংলাদেশে ভারতের আন্না হাজারের মতো সত্য ভাষণে, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার মতো লোকের অভাব আমরা বোধ করি। ৭৪ বছর বয়স্ক আন্না হাজারের নেতৃত্বে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের চাপে সরকার লোকপাল বিল আনতে বাধ্য হয়েছে। সিএনএন-আইবিএনসহ বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আন্নার সৃষ্ট আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছে। অথচ এই লোকটি অতি সাধারণ এক নাগরিক, তার কোনো সম্পদ নেই, ব্যাংক ব্যালান্স নেই। তবে তার রয়েছে জনস্বার্থে আন্দোলন করার অভিজ্ঞতা ও সাহস। সেই সাহসে বলীয়ান হয়ে তিনি মহারাষ্ট্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন শুরু করেন। চলতি বছর ৫ এপ্রিল তিনি অনশন শুরু করেন দুর্নীতি রোধের দাবিতে। ৯ এপ্রিল দুর্নীতি রোধে সরকার নাগরিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে লোকপাল বিলের খসড়া গঠন করে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ও যৌক্তিক আইন প্রণয়নে আন্না হাজারের নেতৃত্বে সারা ভারতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে অস্থির সহিংস দুর্নীতি নিমগ্ন পরিস্থিতিতে একটি নাগরিক আন্দোলন নতুন আশার আলো জ্বালাতে পারে। হতাশা-অস্থিরতা-সহিংসতাকে পরাস্ত করতে, দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে, রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করে আদর্শবাদী ধারা তৈরিতে নাগরিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। তবে মনে করার কোনো কারণ নেই যে, নাগরিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের একমাত্র বিকল্প। আসলে রাজনীতিই সামগ্রিক পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ধংশথনধহমষধ৭১@ুধযড়ড়.পড়স
িি.িধনঁংধুববফশযধহ.পড়স
No comments