এখানে সেখানে-ওয়ারসো স্মৃতিসৌধ by শাকুর মজিদ

সমাজতান্ত্রিক দীনতা ঝেড়ে ফেলে এ শহর যেন নতুন রূপ নিয়ে ফুটে উঠছে। আমরা বেশি দূর যেতে পারি না। রাস্তার পাশে একটি সৌধের সামনে এসে আমাদের গাড়ি থেমে যায়। আমাদের তিনজনকে নিয়ে সাইফউদ্দিন ভাইও নেমে পড়েন গাড়ি থেকে। বলেন, ‘নামেন, আপনাদের পোল্যান্ডের স্মৃতিসৌধ দেখাই।’


এটি ওয়ারসো জাগরণের স্মৃতিসৌধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী যখন কয়েকবার মার খেয়ে পিছু হটতে থাকে, তখন স্বয়ং হিটলার হুকুম দেন ওয়ারসো নগরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। এর পরই ওয়ারসো নগরের ওপর বুলডোজার চালায় নাৎসি বাহিনী। প্রত্যুত্তরে পোলিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল পোলিশ সাধারণ জনগণ, আবালবৃদ্ধবনিতা। এটিই বিশ্বের ইতিহাসে ‘ওয়ারসো জাগরণ’ হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে।
ওয়ারসো জাগরণে যেসব সেনা ও সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছিলেন এবং নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে এ ক্রসিনস্কি স্কয়ারে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়ারসো নগরের ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে পোলিশ সেনাবাহিনী। ধ্বংসের মধ্যেও মাথা নত না করার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেছনের খাড়া কলামগুলো।
ওয়ারসো জাগরণ স্মৃতিসৌধের মূর্তিগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি ভাগে ইনসার্জেন্ট ইউনিট। এটি মূলত সে সময়ে পোলিশ সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর অন্য অংশটি ‘এক্সোডাস গ্রুপ’। এই অংশে মূলত যেসব সাধারণ মানুষ ওয়ারসো জাগরণের যুদ্ধে নিহত হয়েছেন বা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও এ স্মৃতিসৌধ ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অবগুণ্ঠিতই রাখা হয়েছিল। কারণ, ওয়ারসো জাগরণ যুদ্ধে সোভিয়েত রেড আর্মির ভূমিকাসংক্রান্ত হিসাব-নিকাশের বিরাট একটা সমস্যা ছিল। সে কারণে যখন ১৯৮৯ সালে সমাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয়, তখন এ স্মৃতিসৌধের অবগুণ্ঠন তুলে দিয়ে তা উন্মুক্ত করা হয় জনগণের সামনে। এখন প্রতিদিনই দেশপ্রেমিক পোলিশরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে যায় সেই বীর সেনানীদের।
ওয়ারসো নবজাগরণের স্মৃতিসৌধ দেখা শেষ। এবার আবার ছুটে চলা। সঙ্গে বাংলা গান। সাইফ ভাইকে বলি, ‘ভাই, আমরা এখন কোথায় যাব?’ সাইফ ভাই বলেন, ‘ডানে-বাঁয়ে দেখুন, পোল্যান্ড কেমন করে প্রতিদিন নতুন হয়ে উঠছে।’
আমরা ছুটতে থাকি নতুন শহরের রাস্তা ধরে। ওয়ারসোর যে অংশকে নতুন শহর বলা হচ্ছে, তার জন্মও কিন্তু অষ্টাদশ শতকে। এসব ভবনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ধ্বংস করা হয়েছিল। ওয়ারসো পুনর্জাগরণের পরে ১৯৫৪ সালের মধ্যে আবার এসব ভবন সংস্কার করা হয়।
১৯৮৯ সালে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদায় নেওয়ার পর পোল্যান্ড দ্রুত পুঁজিবাদের সংস্কৃতি রপ্ত করে ফেলে। তার প্রমাণ এসব অত্যাধুনিক দালানকোঠা। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যরীতির দালানকোঠার পাশাপাশি ওয়ারসোর আকাশসীমা দখল করে ফেলছে অত্যাধুনিক স্থাপত্যরীতির দালানকোঠা। এসব দালানকোঠায় নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ইস্পাত আর কাচ।
নতুন ওয়ারসোর এসব দৃশ্য আমাদের আর টানে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত শুকিয়ে তারা যতই ওপরের দিকে যাক না কেন, আমরা বারবার তাদের সেসব দুঃখজাগানিয়া জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য অধীর হয়ে যাই।
সাইফ ভাই আমাদের কথা বোঝেন। বলেন, ‘আপনাদের আরেকটা স্মৃতিসৌধ দেখাচ্ছি। “ঘেটো”র কথা শুনেছেন? ঘেটো জাগরণের সময় যেসব বীর যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাঁদের স্মরণে বানানো হয়েছে এ সৌধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়ারসোর সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু এলাকা ছিল এই ঘেটো। সে সময় এ এলাকায় ইহুদিদের বাস ছিল সবচেয়ে বেশি।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে এ এলাকার তিন থেকে চার লাখ লোক প্রাণ হারায়, যাদের অধিকাংশ ছিল ইহুদি। সে সময় এ এলাকার লোকজন হাতে অস্ত্র তুলে নেয় নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে। সেসব অস্ত্রের অধিকাংশই ছিল হাতে তৈরি। এ এলাকার যোদ্ধাদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল বেশি। সে সময় পুরো ওয়ারসোর সব ইহুদি এক হয়েছিল এ ঘেটো এলাকায়। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, তখন এ এলাকায় কয়েকজন ইহুদি জীবিত ছিল। পরবর্তী সময়ে তারাও ইসরায়েলে চলে যায়।
সাইফ ভাই বলেন, এ জায়গাটি শুধু পোলিশদের নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ইহুদিদের একটা বড় শ্রদ্ধার জায়গা। প্রত্যেক ইহুদিই মনে করে, জীবনে একবার এসে যদি এ স্মৃতিসৌধে একটি ফুলের পাপড়ি রেখে যেতে পারে, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ইহুদিদের প্রতি তাদের কিঞ্চিৎ সমবেদনা দেখানো সম্ভব হয়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ইহুদিকে ফুল দিতে দেখা যায়।
আমরা আমাদের দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ বা ষোলোই ডিসেম্বর এলেই শুধু স্মৃতিসৌধে ফুল দিই। এখানে ফুল দেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো দিনের অপেক্ষা কেউ করে না, সুযোগ পেলেই এসে ফুল দিয়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.