মধুপুর বন-'দাও ফিরে সে অরণ্য'
এককালে যেখানে ছিল ঘন অরণ্য, আজ সেখানে কৃষিভূমি, শিল্প-কারখানা কিংবা মানব বসতির অবাধ বিস্তার। সভ্যতার শুরু থেকে আজ অবধি প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের এ নির্মম অভিযান চলছে। অবাধে বনভূমি উজাড় করার এই তৎপরতায় কিছুটা প্রয়োজন আছে বটে, কিন্তু ভূমি ও সম্পদ আহরণের লোভই এর পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একের পর এক বন উজাড় করার ফল হিসেবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ঝড়-ঝঞ্ঝা, অনাবৃষ্টি, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে একদা যে অরণ্য মানুষকে আগলে রাখত, সে অরণ্য আর নেই। বিস্তৃত ও গহিন যে বন একদা সহস্র প্রাণসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল_ প্রাণবৈচিত্র্যের অভাবে তা এখন বিরান। অরণ্য মানুষকে দিত আশ্রয়, খাবার আর নিরাপদে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। কিন্তু এখন সে অরণ্যই মরণাপন্ন। শুক্রবারের সমকালে মধুপুরের বনভূমি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি শুনিয়েছে এক বিশাল অরণ্যের মৃত্যুসংবাদই। আদিতে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর ও মুক্তাগাছার ৬০ হাজার একর জমিতে বিস্তৃত ছিল এ অরণ্য। ১৯৭১ পর্যন্ত এ অরণ্যের আয়তন কমে ৪৫ হাজার ৫শ'একরে ঠেকেছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ আর অরণ্যের অধিকার রক্ষা করতে সক্ষম হয়নি। কাঠ ও ভূমিলোলুপ মানুষের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে এখন মাত্র ৯ হাজার একর ভূমিই অরণ্য হিসেবে গণ্য হতে পারছে। অরণ্য ধ্বংসের প্রক্রিয়াটি মূলত বিগত দুই দশকেই সম্পন্ন হয়েছে। প্রথমত, কাঠের লোভে একের পর এক গাছ কেটে উজাড় করা হয়েছে বন। দ্বিতীয়ত, নতুন করে বনায়নের নামে গাছ কেটে কৃষিজমি বানানো হয়েছে। তৃতীয়ত, কারও তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে বনের জমি জবরদখল করা হয়েছে। আর এ কাজগুলো করেছেন এ দুই দশকে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। যাদের বন রক্ষার দায়িত্ব ছিল সেই বন বিভাগের কর্মকর্তারা উৎকোচ নিয়েছেন। আর্থিক সুবিধা নিয়ে এই অন্যায় আয়োজনে সমর্থন দিয়েছেন। বন দখলের আয়োজন এতটাই আগ্রাসী ছিল যে, যে অরণ্যজীবী জনগোষ্ঠীর জমি হস্তান্তরযোগ্য নয়, তাদের জমিও হস্তান্তর হয়ে গেছে। মধুপুর-মুক্তাগাছা বন ক্রমে পরিণত হয়েছে লুটপাট আর মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে। রাজনীতির মাঠে যতই বিরোধিতা থাকুক, বন লুটের ব্যাপারে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ঐক্য অনড়। বন দখলের ব্যাপারে দ্বিমত নেই। যখন যার সুবিধা হয়েছে তখন তিনি বন দখল করেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে বনের মতো মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুুক্ষিগত হয়েছে দুষ্টদের। যে বনের জন্য বাংলাদেশের গর্ব ছিল আকাশছোঁয়া, সেই বন নেই। প্রাকৃতিক সম্পদের এমন অপচয় তুলনাহীন। বন ধ্বংসের এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ পরিবেশগতভাবে নাজুক অবস্থানে পড়েছে। প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে। এই বিপর্যয় ইতিমধ্যেই বিরূপ করে তুলেছে প্রকৃতিকে। ভবিষ্যতে আরও গুরুতর বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন হলো, অরণ্যের এই ধ্বংসসাধন কি নিরাময় অযোগ্য ব্যাধি? নানা সময়ে এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু বন পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ আসেনি। বরং বন উজাড় প্রক্রিয়া সমানেই চলেছে। আমরা মনে করি, বন উজাড়ের এ প্রক্রিয়া এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। আর একে একে জবরদখল ও অপদখলে চলে যাওয়া বনভূমি উদ্ধার করার উদ্যোগ প্রয়োজন। যারা বেআইনিভাবে বন দখল করেছে তাদের কাছ থেকে বন ফিরিয়ে নিয়ে নতুন বনায়ন শুরু করতে হবে। আর দলমতের পরিচয় ভুলে জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে হবে।
No comments