পণ্যবাজার-বড় গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ মানেই সিন্ডিকেট নয় by মোহাম্মদ হেলাল

রমজান মাস এলেই নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। কারণ একটাই। বাজারে এসবের দাম চড়া। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে—এ কথা বোধ হয় কেউ মানতে চায় না। বরং সবার বক্তব্য, চাহিদা বাড়বে, তা তো ব্যবসায়ীদের অজানা নয়। তাহলে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরবরাহ বাড়ছে না কেন?


এটা ঠিক যে রমজান মাস উপলক্ষে প্রচুর পণ্য আমদানি হয়েছে। এতে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। তার পরও দাম বাড়তে থাকায় এটাকে বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব বলে চিহ্নিত করছে কেউ কেউ। যেমন, প্রথম আলোর ১ আগস্ট সংখ্যায় ‘নিত্যপণ্যের বাজার পাঁচ শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এর মূল বক্তব্য ছিল এ রকম—দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার পাঁচ বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে চলে গেছে। তারাই সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বাজারে প্রতিযোগিতাও কমে গেছে।
বাজারের চাহিদার সিংহভাগ এই পাঁচ গ্রুপ মেটাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ কারণে বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাওয়ার উপসংহারটা মেনে নেওয়া কঠিন। বরং প্রতিযোগিতা বাড়ার ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট ও কম দক্ষতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছেন। আর তাই বাজারের সিংহভাগ চাহিদা এই গ্রুপগুলো মেটাচ্ছে বা মেটাতে পারছে, এটাই বেশি যুক্তিসংগত মনে হয়।
একসময় অর্থনীতির শাস্ত্রে অল্প কয়েকজনের হাতে বাজারের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হওয়াকে প্রতিযোগিতার অভাব হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এখন কিন্তু প্রতিযোগিতার অভাব উপসংহারে এত সহজে পৌঁছানো যায় না। বরং বাজারের নিয়ন্ত্রণ অল্প সংখ্যা হাতে যাওয়ার কারণকে প্রথমে অনুসন্ধান করা হয়। অল্প কজনের শক্তিশালী উপস্থিতি যখন খরচ সাশ্রয়ের কারণে হয়, তখন কিন্তু প্রতিযোগিতার অভাব হিসেবে একে দেখা হয় না। সরকারের কোনো নীতিনির্ধারণী বাধা কিংবা শক্তিশালী কোনো ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়ী গ্রুপের কৌশলী বাধার কারণে অল্প কজন থাকলে তাকে প্রতিযোগিতার অভাব হিসেবে দেখা হয়।
তবে বাজারে অল্প কজনের উপস্থিতি এবং খরচ সাশ্রয় নির্ভর করে প্রযুক্তির ধরনের ওপর। অনেক সময় বড় আকারের উৎপাদন কিংবা বাণিজ্যিক কার্যক্রমে গড় খরচ অপেক্ষাকৃত কম পড়ে। ফলে অপেক্ষাকৃত ছোটরা ঝরে যায়। আবার মোট দেশজ চাহিদার পরিমাণ কম হলে অল্পসংখ্যক উৎপাদনকারীই বড় আকারের কার্যক্রম নিয়ে টিকে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আসলে তা-ই ঘটেছে। আমরা যদি বিষয়টি বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের ব্যবসায়ী/ পরিশোধনকারী/আমদানিকারকদের দিয়ে ব্যাখ্যা করি, তাহলে বুঝতে অনেক সহজ হবে।
আশির দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে ৬০-৭০টি ভোজ্যতেল শোধনাগার ছিল ২০-২৫ জন ব্যবসায়ীর মালিকানায়। এই শোধনাগারগুলোর প্রতিটির দৈনিক পরিশোধনক্ষমতা ছিল ৩০ থেকে ৫০ টন। বর্তমানে এগুলো প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বড় আকারের নতুন নতুন শোধনাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে ২০টির মতো শোধনাগার রয়েছে ৮-১০ জনের বা গ্রুপের মালিকানায়। এগুলোর দৈনিক পরিশোধনক্ষমতা ১৫০ থেকে এক হাজার টন। এই যে পরিবর্তন, তা এসেছে প্রযুক্তির ধরন পাল্টানোর কারণে। আর প্রযুক্তির ধরন পাল্টেছে খরচ সাশ্রয়ের জন্য।
অপরিশোধিত ভোজ্যতেল পরিশোধন করার সময় সাধারণত ৩ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত অপচয় হয়। এই অপচয় বা বিনষ্ট হওয়ার পরিমাণ কমে আসে যদি ভালো বড় শোধনাগারে তা পরিশোধন করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের খরচেরও সাশ্রয় হয় বড় শোধনাগারে।
অন্যদিকে বড় শোধনাগারের জন্য অনেক বেশি পরিমাণে অপরিশোধিত তেল আমদানির ক্ষেত্রেও খরচ সাশ্রয় হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে দৈনিক হাজার টনের ক্ষমতাসম্পন্ন শোধনাগার রয়েছে অন্তত দুটি। দেশে বর্তমানে ১২ থেকে ১৪ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের এ রকম বড় আকারের চার-পাঁচটি শোধনাগার থাকলেই চলে। এখন যদি বড় আকারের অনেকগুলো শোধনাগার থাকে, তাহলে প্রতিটিই তার ক্ষমতার চেয়ে অনেক কম ব্যবহূত হবে। এতে করে প্রতিটি শোধনাগারে পরিশোধন ব্যয় বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ৮-১০টি ব্যবসায়ী গ্রুপও ভবিষ্যতে সক্রিয় না-ও থাকতে পারে।
ফলে এ কথাই আসলে মানা উচিত যে অল্প কয়েকটি শিল্প গ্রুপের হাতে ভোজ্যতেলের আমদানি-পরিশোধন চলে যাওয়াটা কোনো কারসাজির ব্যাপার নয়, বরং নেহাতই দক্ষতাপ্রসূত ভারসাম্যের ফল। শুধু ভোজ্যতেল নয়; চিনিসহ অন্যান্য অনেক নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে এ দক্ষতার বিষয়টি সত্য।
আরেকটি প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি, তা হলো, এই পাঁচ গ্রুপের প্রতিটিই মোটামুটিভাবে সব নিত্যপণ্যের সঙ্গে জড়িত। সেটা কেন? এ ক্ষেত্রেও খরচ সাশ্রয়ই মূল কারণ। নিত্যপণ্যের উৎপাদন কিংবা পরিশোধনের ক্ষেত্রে কিছু উপকরণের একই সঙ্গে বিভিন্ন পণ্যের ব্যবহারের ফলে খরচ কমে আসে। অনেকগুলো পণ্য একসঙ্গে বিপণনের ক্ষেত্রেও খরচ সাশ্রয় হয়। কিছুদিন আগে আমার একটা গ্রুপের শিল্প স্থাপনা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। দেখলাম, ওই গ্রুপ একসঙ্গে অনেক পণ্য উৎপাদন করার জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট বসিয়েছে। আর এই পাওয়ার প্ল্যান্টের স্টিম ব্যবহার করছে ভোজ্যতেল পরিশোধনের জন্য। এ ব্যবস্থাপনা অবশ্যই খরচ-সাশ্রয়ী।
এখন কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, এই খরচ সাশ্রয়ের ফল আমরা পাচ্ছি কি না। নাকি তারা একত্র হয়ে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। এর উত্তর পেতে আমাদের বিশ্ববাজারের গতিবিধির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারের পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তাদের দাম-নির্ধারণী প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করতে হবে। অপ্রতুল তথ্য-উপাত্ত হাতে নিয়ে চট করে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। তবে এটুকু বলা যায়, প্রযুক্তির ধরন, উৎপাদন-দক্ষতা এবং সময়ের দাবিতেই এই পাঁচ গ্রুপের হাতে নিত্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ এসেছে।
কিন্তু এ সুবিধা ব্যবহার করে নিজেরা যোগসাজশের মাধ্যমে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে কি না, তা জানতে হলে আরও নিবিড় পর্যালোচনা প্রয়োজন, প্রয়োজন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ। সরকার যদি কম দামে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে কম খরচে উৎপাদন উৎসাহিত করতে হবে। অর্থাৎ প্রযুক্তির ধরনের কারণে অল্পসংখ্যক উৎপাদককে দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে হবে। তারপর প্রয়োজন হলে খরচের কাছাকাছি দাম রাখার জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক বা রেগুলেটরি পদক্ষেপ নিতে পারে। তাই কোনো ধরনের বিচার-বিবেচনা ছাড়া বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করার আরোপিত চেষ্টা দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনবে না।
মোহাম্মদ হেলাল: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
helalum@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.