অবহেলা-মহাসড়কে হত্যাকাণ্ড এবং মন্ত্রণালয় by ফারুক মঈনউদ্দীন

জনসংখ্যা নিয়ে ২০০ বছরের বেশি সময় আগে টমাস ম্যালথাস যে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তাঁর সেই তত্ত্বকে বিরুদ্ধবাদীরা উড়িয়ে দিয়েছিলেন অতিনৈরাশ্যবাদী বলে। ম্যালথাস তাঁর তত্ত্বে আশঙ্কা করেছিলেন যে জনসংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেলে প্রকৃতি নিজস্ব নিয়মেই সেটা সংশোধন করার চেষ্টা করবে।


ম্যালথাসের তত্ত্বে আদৌ যদি ভ্রান্তি থেকে থাকে, তবে একটা সত্য স্বীকার করতে হবে যে আমাদের দেশে তথা সমগ্র বিশ্বে প্রতিদিন যোগ হওয়া নতুন মুখগুলোতে শুধু আহার জোগানোর জন্য প্রকৃতির কাছ থেকে আমাদের নিঃশেষে নিংড়ে নিতে হচ্ছে খাদ্য। ম্যালথাসীয় তত্ত্বে প্রকৃতির যে প্রতিশোধের কথা বলা হয়েছিল, তার কিছু আলামত কি মাঝেমধ্যে আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে না? অন্যান্য দেশে এমন আলামত মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন জনসংখ্যাবহুল দেশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশেই প্রকৃতির প্রতিশোধের বহু আলামত দৃষ্ট হচ্ছে নিত্যদিন। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সড়ক দুর্ঘটনা, মানুষের অমানবিক নির্মমতায় লোকক্ষয়, দেশান্তরি হওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা—এগুলো ম্যালথাসের জনসংখ্যাতত্ত্ব থেকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। স্মর্তব্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অপঘাতে মৃত্যু, দেশান্তরি হওয়া—এ সবই ম্যালথাসীয় তত্ত্বের প্রকৃতির প্রতিশোধ।
প্রতিবছর আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে তিন হাজারের বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও এবার দেশের দুই কৃতী সন্তানের মর্মান্তিক ও অপূরণীয় মৃত্যুর পর দেশের বিবেক জেগে উঠলেও এ বিষয়ে দায়বদ্ধ মন্ত্রীদের বিবেকের কোনো তাড়না পরিলক্ষিত হয়নি। এই তিন হাজারি হিসাবটা অবশ্য সরকারি। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও প্রায় চার গুণ বেশি। এসব সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে ট্রাফিক ও সড়ক আইন লঙ্ঘনের কারণে। অনভিজ্ঞ ও ট্রাফিক আইন-অজ্ঞ চালক; বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো; রাস্তায় চলাচলের অনুপযুক্ত ও অননুমোদিত গাড়ি চলাচল; পথচারী, রিকশা, ভ্যান ইত্যাদির যেমন খুশি চলাফেরা; সড়কের পাশে অননুমোদিত হাটবাজার, দোকানপাট ও অবৈধ পার্কিং—এসব আইন লঙ্ঘনই সড়ক দুর্ঘটনা তথা হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ। রাস্তায় নেমে চোখ-কান খোলা রেখে চললেই এই প্রবণতাগুলো বোঝা যায়, তার জন্য বিশেষজ্ঞের গবেষণার প্রয়োজন হয় না। দুর্ঘটনায় মানুষ যে কেবল মারা যায় কিংবা পঙ্গু হয় তা নয়, এর রয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষতিও। মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও গাড়ি ধ্বংসের কারণে বিরূপ প্রভাব পড়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ওপর। মোটামুটিভাবে হিসাব করে দেখা গেছে, জিডিপির ওপর এর প্রভাব ২ থেকে ৫ শতাংশের মতো। তার ওপর স্বজন হারানো এবং পারিবারিক বিপর্যয়ের করুণ পরিণতি তো রয়েছেই।
এসব সমস্যা ও প্রবণতার সমাধানের পরিবর্তে সরকারের উচ্চমহলে যেসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা রীতিমতো রোমহর্ষক। অদক্ষ ও নিয়ম-অজ্ঞ চালকের কারণে যেখানে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে, সেখানে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী পরীক্ষা ছাড়াই ২৭ হাজার চালককে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন। জানা যায়, এর আগেও সাড়ে ১০ হাজার লাইসেন্স এভাবেই দিতে বাধ্য করা হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে। এই ঘটনাকে রোমহর্ষক বললে কি অত্যুক্তি হবে? এখানে প্রত্যাশিত ছিল, বিআরটিএ যে দুর্নীতির মাধ্যমে পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেয়, তার বিরুদ্ধে মন্ত্রীর কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা। অবশ্য যোগাযোগমন্ত্রী যেন আচমকা জেগে উঠে বলছেন, বিআরটিএর পরীক্ষা ছাড়া ‘আর’ কাউকে লাইসেন্স দেওয়া হবে না। এই ‘আর’ কথাটাই প্রমাণ করে যে পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়া হয় এবং হয়েছে। তিনি এ কথাও প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন যে ভুয়া লাইসেন্স ইস্যু এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের অনুমতি দেওয়ার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মন্ত্রীর এই চৈতন্যোদয়ের জন্য অকালে প্রাণ দিতে হলো আমাদের দুই তরুণ মেধাকে!
ট্রাফিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন এবং কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় অজস্র লেখা ছাপা হয়েছে, কিন্তু আইন প্রয়োগকারী এই কর্তৃপক্ষের তাতে কখনোই কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। উন্নত বিশ্বে যাঁরা ভ্রমণ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, সেই সব দেশে চালকেরা ট্রাফিক পুলিশকে যতখানি ভয় পান, ততখানি বোধ করি ঈশ্বরকেও পান না। কারণ, গণপরিবহন নেই এমন শহরে ড্রাইভিং লাইসেন্সটি বাতিল হয়ে গেলে চালকের জীবনে নেমে আসবে ঘোর বিপর্যয়। অথচ আমাদের দেশে পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে আইন লঙ্ঘন, পুলিশ কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে উদাসীন, কখনো বা চালকদের বেপরোয়া আচরণের কারণে অসহায় কিংবা পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে জিম্মি। তাই বলে শ্রমিকদের কাছে মন্ত্রীও কি জিম্মি? একটি পত্রিকার খবরে জানা যায়, উত্তরবঙ্গগামী পরিবহন ধর্মঘটের পেছনের মূল কারণ সুপারিশকৃত ২৭ হাজার পরীক্ষাবিহীন লাইসেন্সের জন্য মন্ত্রীর ওপর চাপ প্রয়োগ করা।
দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ২০ বছর বয়সী কাউকে পেশাদার ‘হালকা’ যানবাহনের লাইসেন্স দেওয়া হলে তিন বছর গাড়ি চালানোর পর তাঁকে দেওয়া হয় তিন টনি ট্রাক বা লরিজাতীয় ‘মধ্যম’ শ্রেণীর গাড়ির লাইসেন্স। মধ্যম শ্রেণীর চালক ছয় বছর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর বিআরটিএর পরীক্ষা পাস সাপেক্ষে তাঁকে দেওয়া যায় ‘ভারী’ গাড়ির লাইসেন্স। মন্ত্রীর রোমহর্ষক সুপারিশের কারণে এসব নিয়মের কোনোটিই পরিপালন না করে শ্রমিক সংগঠনের সদস্যদের দিয়ে দিতে হবে ভারী গাড়ির লাইসেন্স। এই ২৭ হাজার অনভিজ্ঞ আইন-অজ্ঞ বাস-ট্রাকের ড্রাইভার রাস্তায় নামলে দুর্ঘটনার মাত্রা কী পরিমাণ বাড়বে, সেটা সহজেই অনুমেয়। এ রকম অন্যায্য সুপারিশের পক্ষে সাফাই গেয়ে আবার বলা হয়েছে, তাঁরা ‘দক্ষ চালক’, কিন্তু বিআরটিএর ‘জটিল’ পরীক্ষায় পাস করতে পারেন না। গাড়ি চালাতে জানলেই যে তাঁরা ‘দক্ষ’, এ কথা বলা কতখানি সমীচীন? ট্রাফিক আইন না জানলে, রোড সাইন না বুঝলে তাঁকে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামতে দিলে যা ঘটবে, তার দায়ভার কি মন্ত্রী বহন করবেন?
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে চালু হতে যাচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ে। সেই মহাসড়কে চলার জন্য কেবল গাড়ি চালাতে জানাই যথেষ্ট নয়, বিভিন্ন ধরনের রোড সাইন, নির্দেশিকা বুঝতে হবে, আর তার জন্য দরকার প্রশিক্ষণ এবং যথাযথ পরীক্ষায় পাস করে পাওয়া লাইসেন্স। অথচ আমাদের ট্রাফিক পুলিশের বড় কর্তারা বোধ করি জানেন না যে সঠিক লেন মেনে রাস্তায় চলা, সঠিকভাবে মোড় ঘোরা—এসব মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান বেশির ভাগ চালকের তো নেই-ই, কর্তব্যরত অনেক ট্রাফিক পুলিশেরও নেই। এ কথা হলফ করে বলা যায়, আমাদের লাইসেন্সধারী চালকদের ৯৯ শতাংশ ডানে মোড় ঘোরার নিয়ম জানেন না, যেমন জানেন না রিকশাচালকেরা। লাল বাতির কারণে রাস্তার এক পাশে যখন গাড়ির দীর্ঘ সারি দেখা যায়, তখন যাত্রীবোঝাই বাসগুলো অবলীলায় ডিভাইডারের ডান পাশ দিয়ে সামনে চলে যায়। এই মারাত্মক লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কখনো একটিও মামলা হয়নি। এসব আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে কখনো কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, হলেও এ রকম শাস্তি চালকদের কাছে এখন ডাল-ভাতের মতো, তাই আইন ভাঙতে দ্বিধা করে না কেউ।
আর আমাদের দেশে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা মানে একটা মামলা এবং নির্দিষ্ট দিনে কয়েক শ টাকা দিয়ে লাইসেন্সটি ছাড়িয়ে আনা। ট্রাফিক আইনের যে ধারাগুলো আছে, সেগুলো ঠিকভাবে প্রয়োগ করলে হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি আশা করা যেত। প্রতিবেশী দেশ ভারতে আইনের প্রয়োগ তো আছেই, এর সঙ্গে আছে আইন মেনে চলার জন্য চালকদের সচেতনতা। মুম্বাইয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করার কথা তো কল্পনাও করা যায় না; তার সঙ্গে কঠোরভাবে মানতে হয় লেন শৃঙ্খলা, যা আমাদের দেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, যেটি সম্পর্কে চালকেরা অজ্ঞ এবং ট্রাফিক পুলিশ উদাসীন। আমাদের জাতীয় চরিত্রের ভেতর আইন না মানার একটা প্রবণতা আছে, সে কথা মেনে নিলেও কথাটি মেলে না অন্য জায়গায়। ঢাকার রাস্তায় যতখানি ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা, ঠিক ততখানি শৃঙ্খলা সেনানিবাসের ভেতর—এই সত্যটির গূঢ় রহস্য আমরা জানি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অযোগ্যতা যে কেবল সাম্প্রতিক ভেঙে পড়া সড়কব্যবস্থার মধ্যে প্রকটিত তা নয়, তার অধীন প্রতিষ্ঠান বিআরটিএর সর্বজনবিদিত দুর্নীতি ও অদক্ষতার মধ্যেও প্রতিফলিত। এই প্রতিষ্ঠান দিয়ে ট্রাফিক-ব্যবস্থার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা আদৌ সম্ভব হবে কি না, জানি না। সে ক্ষেত্রে একটা বিকল্প পন্থা ভাবা যেতে পারে। ভোটার পরিচয়পত্র কিংবা মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট প্রকল্পের মতো প্রশিক্ষণসহ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস পরীক্ষার দুটি প্রকল্প সেনাবাহিনীর কাছে ন্যস্ত করা যেতে পারে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। তার সঙ্গে পুলিশের জনবল বাড়িয়ে ট্রাফিক আইনের যথার্থ প্রয়োগ, মহাসড়কে গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, মোবাইল কোর্ট প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বাস্তবায়ন খুব সময়সাপেক্ষ নয়। জাতিকে নাড়া দেওয়া দুটি প্রতিভার মৃত্যু সরকারের বিবেককে কতখানি জাগ্রত করে, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব আমরা।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.