স্বাধীনতার সূর্যরথে আলোর যাত্রা by পাপড়ি রহমান
স্বাধীনতা যার আছে তার তো যাবতীয় কিছুই আছে। তার স্বপ্ন আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, সাধ আছে, আহ্লাদ আছে। আছে নিজের মতো করে বেঁচে থাকা। স্বাধীনতা আছে মানে বাতাস বেশি পরিমাণ অক্সিজেনে ভরপুর। আর আছে নিজের করতলে আপন ভূমি।
যত সংকটই থাকুক তা অতিক্রম করা এমন কী আর অসাধ্য কাজ! সংকট যত অতিক্রম করে বাংলাদেশ একদিন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে উঠবে_ আমি সেই স্বপ্ন দেখার দলে। কারণ এই দেশ আমার দেশ। এই জল-পলি-হাওয়া আমার নিজের। আমার গৃহটি আমার নিজের। আমার অন্ন আমার নিজের। ফলে আমরা তো
স্বপ্নাতুর হবোই
তোমরা যথার্থ স্বাধীন তখনই/ যখন এইসব সুখ-দুঃখের ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে/ তোমরা মেলে দিয়েছ তোমাদের ডানা/ সবকিছু ছাড়িয়ে, নগ্ন, সীমাহীনতার দিকে... (দ্য প্রফেট, কাহলিল জিব্রান)
স্বাধীনতা মানে উড়াল। অবিশ্রান্ত উড়াল। উড়াল, উড়াল আর উড়াল। এই উন্নয়নশীলতা কোথায় গিয়ে থামবে বলা মুশকিল।
আজকে যে তরুণ, তার কাছে এই উড়াল হলো আকাঙ্ক্ষা। তার স্বপ্ন, প্রাপ্তি। এই উড্ডীনতা তার কাছে পরম আরাধ্য। যক্ষের ধন। হয়তোবা তারও রয়েছে নিজস্ব গোপন কোনো খর্বতা। রয়েছে প্রায় পালক খসানো ডানা। উড়ালডানার এই পঙ্গুত্ব হলো দারিদ্র্য, বঞ্চনা, রোগ ও শোকের ঘূর্ণাবরণ। অথবা জ্বরাগ্রস্ত অনিশ্চিত বেঁচে থাকা। তবুও সে তার স্বাধীনতাকে ধরে থাকে জোয়ালের মতো করে। হাতকড়ার মতো সে পরে থাকে এই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আমার বা আপনার। তরুণ বা বৃদ্ধের। পর বা অপরের। সর্বোপরি দেশের এবং জনগণের। এই জনগণ হলো রাষ্ট্র। অর্থাৎ স্বাধীনতা আমার রাষ্ট্রের। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমি যুদ্ধ দেখেছি, কিন্তু বুঝতে শিখিনি স্বাধীনতা কী? আজ যুদ্ধ নেই, আছে স্বাধীনতা_ আমার উড়ালের আকাশ।
এখন যে সদ্য তরুণ সে যুদ্ধ দেখেনি। অথচ স্বাধীনতার স্পর্শে সে টগবগে। উষ্ণ। কারণ স্বাধীনতা আছে তার করপুটে। জন্মেই সে পেয়েছে স্বাধীনতা। রাষ্ট্রের, জনগণের_ সর্বোপরি তার নিজের। সে কি জানে স্বাধীনতা অর্জন কতটা রক্তক্ষয়ী? হয়তো জানে, হয়তো জানে না। না জানলে তাকে জানানোর দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। মানুষ জন্মেই জানতে শেখে পরিবার থেকে। পরিবার থেকে বিদ্যালয়ে। ক্রমে মহা ও বিশ্ববিদ্যালয়। সবাইকে জানতে হবে স্বাধীনতার সেই রক্তক্ষয়ের ইতিহাস। তা জানা অধিকার ও দায়িত্ব।
তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা_ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
স্বাধীনতার ৪০ বছর_ অনেক অনেক নতুন দিনের মরণ আমরা দেখেছি। অনেক রাতের সূর্যোদয়। ফলে ৪০ বছর বড় বেশি পরিপকস্ফ সময়। আর চলি্লশের পরই নাকি সবকিছু হয়। ফলে আমরাও বড় বেশি আশাবাদী। বড় বেশি স্বপ্নাতুর। স্বপ্নহীন জীবন মানে জীবনের সমাধি। আমরা স্বপ্ন দেখার দল বেঁচেবর্তে আছি।
এই পরিপকস্ফ সময়ে আমাদের আছে ম্যালা কিছু। আবার হয়তো নেই অনেক কিছুই।
কী আছে আমাদের? আছে ভোট ও ভাতের অধিকার, নিশ্চয়তা। আছে নিজেদের আলাদা ভাষা আর সেই ভাষায় কথা কইবার আনন্দ, স্বাধীনতা। আমাদের আছে সবুজ আর লালের ভেতর নিজস্ব এক মানচিত্র এবং আমরা অর্জন করেছি গণতন্ত্র। কোনো স্বৈরতন্ত্র কি টিকতে পেরেছে আমাদের গণতন্ত্রের কাছে? পারেনি। ফলে আজ আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
আমাদের যেমন আছে অনেক কিছুই, আবার নেই কত কিছুই! আমাদের পরে স্বাধীনতা পেয়ে কত দেশ আমাদের চাইতে অগ্রগামী। তারা নিজেদের জাতিকে দিয়েছে অন্ন-বস্ত্রের নিরুদ্বিগ্ন সংস্থান। দিয়েছে উন্নত বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আমরা তো এখনও প্রতিটি শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারিনি। দিতে পারিনি সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা। এখনও পূরণ করতে পারিনি বিদ্যুতের ঘাটতি। জ্বালানি সংকটের সমাধান দিতে পারিনি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেঁৗছাতে পারিনি।
আমরা আসলে কিঞ্চিৎ এগোলেই সামান্য পিছিয়ে পড়ছি। আর এই আগ-পিছ করেই আমরা চলছি। থেমে কিন্তু নেই। আমরা থেমে নেই। কারণ আমরা জানি, থামলেই পতন অনিবার্য। থামলেই সমাধিস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা। ফলে আমরা এগোচ্ছি ধীরে-সুস্থে। রয়ে-সয়ে। ধাতস্থ হয়ে। অঙ্কুরেই ইঁদুরে খেয়ে ফেলা বীজটির মহীরুহ হতে সময় তো লাগবে, নাকি? সময় লাগছে কিন্তু বৃক্ষটির শাখা-প্রশাখা-পত্রের বিন্যাসে ঘাটতি নেই। ফলে যারা আমাদের চাইতে এগিয়ে আছে তাদের প্রতি আছে আমাদের অনুরাগ। আমাদের দৃষ্টি তাদের প্রতিই নিবদ্ধ। তারা পেরেছে, আমরাও পারতে চাই, পারব। আমাদের সঙ্গে যতই গরমিল থাক, মিল আছে এক জায়গায়_ তারাও স্বাধীন এবং আমরাও। তারা পেরেছে, আমরা আজ পারিনি কাল পারব_ এ বিশ্বাসে এগিয়ে চলেছি। শুধু তাদের হয়েছে আগেভাগেই। আমাদেরও হবে। হবে না_ আমি এমন ভাবি না। হবে, আমাদের সবই হবে। হচ্ছে। হচ্ছে শুধু রয়ে-সয়ে এই আর কি! আমাদের এই পিছিয়ে পড়ার জন্য আমি দুর্নীতিবাজদের দায়ী করি। আমাদের এই শম্বুুক গতির পেছনে তাদের দায়ই অধিক। কেন তারা শুধুই দেখে নিজের স্বার্থ? তারা কেন এভাবে ভাবে না যে, কীভাবে চলবে একটা শকট, যদি তার দুটি চাকাই খুলে নেওয়া হয়? যদি ভেজাল দেওয়া হয় শকটের জ্বালানিতে? ইঞ্জিনের নাড়িভুঁঁড়িতে তস্কর ঢুকে পড়ে? আর কিছু না হোক, আমার দেশের জনগণের যেন নীতিবোধের ঘাটতি না হয়। সব মানুষের মাঝে যেন এই মনোভাব বিরাজ করে_ এই দেশ আমার। এই স্বদেশের জনগণ আমারই অংশবিশেষ। আমি কেন তস্কর হয়ে শোষণ করব আমার দেশের বিশুদ্ধ বাতাস? নিজের উদরপূর্তিতেই কেবল আহ্লাদিত হবো? এমন ভাবনা না থাকলে সে কিসের মানুষ?
আর মানুষের হাতেই তো সবকিছু। মানুষই রাষ্ট্র। মানুষই জনগণ। ফলে এই মানুষেরাই যদি মন্দির বা মসজিদের গাছের তলায় হাঁটতে হাঁটতে, দূরের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে, রাজপথে মিছিল করতে করতে বা স্লোগান দিতে দিতে উপলব্ধি করে_ স্বাধীনতা মানে নিজের বা নিজের দেশের মানুষের স্বাধীনতা, তখন সে এই স্বাধীনতাকেই হাতে ধরে রাখবে জোয়ালের মতো। হাতে পরে থাকবে হাতকড়ার মতো। সর্বাগ্রে এই উপলব্ধি জরুরি। স্বাধীনতা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী শৃঙ্খল, যা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের ভেতরের ঈশ্বরকে। আর এই ঈশ্বর হলো মানুষের অন্তর। মানুষের ভেতরের এই ঈশ্বর হলো সমুদ্রের মতো। সূর্যের মতো। আকাশের মতো। অথবা কোনো বৃক্ষের মতো। সমুদ্রে জলের ঘাটতি সমুদ্রই টের পায়। আর বৃক্ষের পত্র হলুদ, বিবর্ণ হতে শুরু করলে বৃক্ষ তা নীরবে জেনে যায়। তাই মানুষও জেনে যায় তার ভেতরের অবস্থান। নিজের ভেতরে অধঃপতনের বীজ রোপিত হওয়ামাত্রই মানুষ জেনে যায় নিজের বিষাক্ত হওয়ার কথা। ফলে মানুষকেই সচেতন থাকতে হবে সর্বাগ্রে। যাতে সে নিজে কোনোভাবেই বিষভাণ্ড না হয়ে ওঠে।
আজ যে তরুণ, তার হাতেই আছে সেই বাঁশিটি। কারণ সে তরুণ, সে নবীন, সে আধুনিক এবং সে কর্মরত। যে কোনো তরুণের হাত মানেই ইস্পাতকঠিন হাত, যে হাতে সে তুলে আনে রাশি রাশি শস্য। যার পরিশ্রম আর নোনতা ঘামে মিশে আছে স্বপ্ন পূরণের স্পৃহা। স্বপ্ন যাকে ক্লান্ত করে না কখনোই। সে সেই বাঁশিওয়ালা, যার হৃদয়ের মধ্য দিয়ে সময়ের চুপিসার কথা গান হয়ে ওঠে। জীবনের যত স্পন্দন সব একযোগে বেজে ওঠে সুমধুর সুরে। সে তার হৃদয়জাত তন্তু দিয়ে বস্ত্র বুনে চলে। কারণ তার আছে তারুণ্য। আছে কাজের প্রতি ভালোবাসা। যদি কোনো তরুণ পরিশ্রমবিমুখ হয়, তাহলে সে দিনের বা রাত্তিরের খাঁটি সুর থেকে বঞ্চিত করছে মানুষের কান।
স্বাধীনতা যার আছে তার তো যাবতীয় কিছুই আছে। তার স্বপ্ন আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, সাধ আছে, আহ্লাদ আছে। আছে নিজের মতো করে বেঁচে থাকা। স্বাধীনতা আছে মানে বাতাস বেশি পরিমাণ অক্সিজেনে ভরপুর। আর আছে নিজের করতলে আপন ভূমি। যত সংকটই থাকুক তা অতিক্রম করা এমন কী আর অসাধ্য কাজ! সংকট যত অতিক্রম করে বাংলাদেশ একদিন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে উঠবে_ আমি সেই স্বপ্ন দেখার দলে। কারণ এই দেশ আমার দেশ। এই জল-পলি-হাওয়া আমার নিজের। আমার গৃহটি আমার নিজের। আমার অন্ন আমার নিজের। ফলে আমরা তো স্বপ্নাতুর হবোই। আমি বিশ্বাস করি, এত সব নিজের নিয়েই আমরা সমৃদ্ধিতে পেঁৗছতে পারব। আমরা যেমন নিঃশ্বাস নিই বলে বেঁচে থাকি, তেমনই এই বিশ্বাসই আমাদের পেঁৗছে দেবে আমাদের লক্ষ্যে।
স পাপড়ি রহমান :কথাসাহিত্যিক
স্বপ্নাতুর হবোই
তোমরা যথার্থ স্বাধীন তখনই/ যখন এইসব সুখ-দুঃখের ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে/ তোমরা মেলে দিয়েছ তোমাদের ডানা/ সবকিছু ছাড়িয়ে, নগ্ন, সীমাহীনতার দিকে... (দ্য প্রফেট, কাহলিল জিব্রান)
স্বাধীনতা মানে উড়াল। অবিশ্রান্ত উড়াল। উড়াল, উড়াল আর উড়াল। এই উন্নয়নশীলতা কোথায় গিয়ে থামবে বলা মুশকিল।
আজকে যে তরুণ, তার কাছে এই উড়াল হলো আকাঙ্ক্ষা। তার স্বপ্ন, প্রাপ্তি। এই উড্ডীনতা তার কাছে পরম আরাধ্য। যক্ষের ধন। হয়তোবা তারও রয়েছে নিজস্ব গোপন কোনো খর্বতা। রয়েছে প্রায় পালক খসানো ডানা। উড়ালডানার এই পঙ্গুত্ব হলো দারিদ্র্য, বঞ্চনা, রোগ ও শোকের ঘূর্ণাবরণ। অথবা জ্বরাগ্রস্ত অনিশ্চিত বেঁচে থাকা। তবুও সে তার স্বাধীনতাকে ধরে থাকে জোয়ালের মতো করে। হাতকড়ার মতো সে পরে থাকে এই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আমার বা আপনার। তরুণ বা বৃদ্ধের। পর বা অপরের। সর্বোপরি দেশের এবং জনগণের। এই জনগণ হলো রাষ্ট্র। অর্থাৎ স্বাধীনতা আমার রাষ্ট্রের। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমি যুদ্ধ দেখেছি, কিন্তু বুঝতে শিখিনি স্বাধীনতা কী? আজ যুদ্ধ নেই, আছে স্বাধীনতা_ আমার উড়ালের আকাশ।
এখন যে সদ্য তরুণ সে যুদ্ধ দেখেনি। অথচ স্বাধীনতার স্পর্শে সে টগবগে। উষ্ণ। কারণ স্বাধীনতা আছে তার করপুটে। জন্মেই সে পেয়েছে স্বাধীনতা। রাষ্ট্রের, জনগণের_ সর্বোপরি তার নিজের। সে কি জানে স্বাধীনতা অর্জন কতটা রক্তক্ষয়ী? হয়তো জানে, হয়তো জানে না। না জানলে তাকে জানানোর দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। মানুষ জন্মেই জানতে শেখে পরিবার থেকে। পরিবার থেকে বিদ্যালয়ে। ক্রমে মহা ও বিশ্ববিদ্যালয়। সবাইকে জানতে হবে স্বাধীনতার সেই রক্তক্ষয়ের ইতিহাস। তা জানা অধিকার ও দায়িত্ব।
তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা_ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
স্বাধীনতার ৪০ বছর_ অনেক অনেক নতুন দিনের মরণ আমরা দেখেছি। অনেক রাতের সূর্যোদয়। ফলে ৪০ বছর বড় বেশি পরিপকস্ফ সময়। আর চলি্লশের পরই নাকি সবকিছু হয়। ফলে আমরাও বড় বেশি আশাবাদী। বড় বেশি স্বপ্নাতুর। স্বপ্নহীন জীবন মানে জীবনের সমাধি। আমরা স্বপ্ন দেখার দল বেঁচেবর্তে আছি।
এই পরিপকস্ফ সময়ে আমাদের আছে ম্যালা কিছু। আবার হয়তো নেই অনেক কিছুই।
কী আছে আমাদের? আছে ভোট ও ভাতের অধিকার, নিশ্চয়তা। আছে নিজেদের আলাদা ভাষা আর সেই ভাষায় কথা কইবার আনন্দ, স্বাধীনতা। আমাদের আছে সবুজ আর লালের ভেতর নিজস্ব এক মানচিত্র এবং আমরা অর্জন করেছি গণতন্ত্র। কোনো স্বৈরতন্ত্র কি টিকতে পেরেছে আমাদের গণতন্ত্রের কাছে? পারেনি। ফলে আজ আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
আমাদের যেমন আছে অনেক কিছুই, আবার নেই কত কিছুই! আমাদের পরে স্বাধীনতা পেয়ে কত দেশ আমাদের চাইতে অগ্রগামী। তারা নিজেদের জাতিকে দিয়েছে অন্ন-বস্ত্রের নিরুদ্বিগ্ন সংস্থান। দিয়েছে উন্নত বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আমরা তো এখনও প্রতিটি শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারিনি। দিতে পারিনি সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা। এখনও পূরণ করতে পারিনি বিদ্যুতের ঘাটতি। জ্বালানি সংকটের সমাধান দিতে পারিনি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেঁৗছাতে পারিনি।
আমরা আসলে কিঞ্চিৎ এগোলেই সামান্য পিছিয়ে পড়ছি। আর এই আগ-পিছ করেই আমরা চলছি। থেমে কিন্তু নেই। আমরা থেমে নেই। কারণ আমরা জানি, থামলেই পতন অনিবার্য। থামলেই সমাধিস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা। ফলে আমরা এগোচ্ছি ধীরে-সুস্থে। রয়ে-সয়ে। ধাতস্থ হয়ে। অঙ্কুরেই ইঁদুরে খেয়ে ফেলা বীজটির মহীরুহ হতে সময় তো লাগবে, নাকি? সময় লাগছে কিন্তু বৃক্ষটির শাখা-প্রশাখা-পত্রের বিন্যাসে ঘাটতি নেই। ফলে যারা আমাদের চাইতে এগিয়ে আছে তাদের প্রতি আছে আমাদের অনুরাগ। আমাদের দৃষ্টি তাদের প্রতিই নিবদ্ধ। তারা পেরেছে, আমরাও পারতে চাই, পারব। আমাদের সঙ্গে যতই গরমিল থাক, মিল আছে এক জায়গায়_ তারাও স্বাধীন এবং আমরাও। তারা পেরেছে, আমরা আজ পারিনি কাল পারব_ এ বিশ্বাসে এগিয়ে চলেছি। শুধু তাদের হয়েছে আগেভাগেই। আমাদেরও হবে। হবে না_ আমি এমন ভাবি না। হবে, আমাদের সবই হবে। হচ্ছে। হচ্ছে শুধু রয়ে-সয়ে এই আর কি! আমাদের এই পিছিয়ে পড়ার জন্য আমি দুর্নীতিবাজদের দায়ী করি। আমাদের এই শম্বুুক গতির পেছনে তাদের দায়ই অধিক। কেন তারা শুধুই দেখে নিজের স্বার্থ? তারা কেন এভাবে ভাবে না যে, কীভাবে চলবে একটা শকট, যদি তার দুটি চাকাই খুলে নেওয়া হয়? যদি ভেজাল দেওয়া হয় শকটের জ্বালানিতে? ইঞ্জিনের নাড়িভুঁঁড়িতে তস্কর ঢুকে পড়ে? আর কিছু না হোক, আমার দেশের জনগণের যেন নীতিবোধের ঘাটতি না হয়। সব মানুষের মাঝে যেন এই মনোভাব বিরাজ করে_ এই দেশ আমার। এই স্বদেশের জনগণ আমারই অংশবিশেষ। আমি কেন তস্কর হয়ে শোষণ করব আমার দেশের বিশুদ্ধ বাতাস? নিজের উদরপূর্তিতেই কেবল আহ্লাদিত হবো? এমন ভাবনা না থাকলে সে কিসের মানুষ?
আর মানুষের হাতেই তো সবকিছু। মানুষই রাষ্ট্র। মানুষই জনগণ। ফলে এই মানুষেরাই যদি মন্দির বা মসজিদের গাছের তলায় হাঁটতে হাঁটতে, দূরের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে, রাজপথে মিছিল করতে করতে বা স্লোগান দিতে দিতে উপলব্ধি করে_ স্বাধীনতা মানে নিজের বা নিজের দেশের মানুষের স্বাধীনতা, তখন সে এই স্বাধীনতাকেই হাতে ধরে রাখবে জোয়ালের মতো। হাতে পরে থাকবে হাতকড়ার মতো। সর্বাগ্রে এই উপলব্ধি জরুরি। স্বাধীনতা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী শৃঙ্খল, যা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের ভেতরের ঈশ্বরকে। আর এই ঈশ্বর হলো মানুষের অন্তর। মানুষের ভেতরের এই ঈশ্বর হলো সমুদ্রের মতো। সূর্যের মতো। আকাশের মতো। অথবা কোনো বৃক্ষের মতো। সমুদ্রে জলের ঘাটতি সমুদ্রই টের পায়। আর বৃক্ষের পত্র হলুদ, বিবর্ণ হতে শুরু করলে বৃক্ষ তা নীরবে জেনে যায়। তাই মানুষও জেনে যায় তার ভেতরের অবস্থান। নিজের ভেতরে অধঃপতনের বীজ রোপিত হওয়ামাত্রই মানুষ জেনে যায় নিজের বিষাক্ত হওয়ার কথা। ফলে মানুষকেই সচেতন থাকতে হবে সর্বাগ্রে। যাতে সে নিজে কোনোভাবেই বিষভাণ্ড না হয়ে ওঠে।
আজ যে তরুণ, তার হাতেই আছে সেই বাঁশিটি। কারণ সে তরুণ, সে নবীন, সে আধুনিক এবং সে কর্মরত। যে কোনো তরুণের হাত মানেই ইস্পাতকঠিন হাত, যে হাতে সে তুলে আনে রাশি রাশি শস্য। যার পরিশ্রম আর নোনতা ঘামে মিশে আছে স্বপ্ন পূরণের স্পৃহা। স্বপ্ন যাকে ক্লান্ত করে না কখনোই। সে সেই বাঁশিওয়ালা, যার হৃদয়ের মধ্য দিয়ে সময়ের চুপিসার কথা গান হয়ে ওঠে। জীবনের যত স্পন্দন সব একযোগে বেজে ওঠে সুমধুর সুরে। সে তার হৃদয়জাত তন্তু দিয়ে বস্ত্র বুনে চলে। কারণ তার আছে তারুণ্য। আছে কাজের প্রতি ভালোবাসা। যদি কোনো তরুণ পরিশ্রমবিমুখ হয়, তাহলে সে দিনের বা রাত্তিরের খাঁটি সুর থেকে বঞ্চিত করছে মানুষের কান।
স্বাধীনতা যার আছে তার তো যাবতীয় কিছুই আছে। তার স্বপ্ন আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, সাধ আছে, আহ্লাদ আছে। আছে নিজের মতো করে বেঁচে থাকা। স্বাধীনতা আছে মানে বাতাস বেশি পরিমাণ অক্সিজেনে ভরপুর। আর আছে নিজের করতলে আপন ভূমি। যত সংকটই থাকুক তা অতিক্রম করা এমন কী আর অসাধ্য কাজ! সংকট যত অতিক্রম করে বাংলাদেশ একদিন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে উঠবে_ আমি সেই স্বপ্ন দেখার দলে। কারণ এই দেশ আমার দেশ। এই জল-পলি-হাওয়া আমার নিজের। আমার গৃহটি আমার নিজের। আমার অন্ন আমার নিজের। ফলে আমরা তো স্বপ্নাতুর হবোই। আমি বিশ্বাস করি, এত সব নিজের নিয়েই আমরা সমৃদ্ধিতে পেঁৗছতে পারব। আমরা যেমন নিঃশ্বাস নিই বলে বেঁচে থাকি, তেমনই এই বিশ্বাসই আমাদের পেঁৗছে দেবে আমাদের লক্ষ্যে।
স পাপড়ি রহমান :কথাসাহিত্যিক
No comments