কালের পুরাণ-ত্যাগের চেয়ে পদ বড় by সোহরাব হাসান
ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা আছে ‘ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি’। তার কয়েকটি লাইন এ রকম: ‘ইন্দিরা, তুমি বিমানের জানালায় বসে,/ গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না। এ বড় ভয়ংকর খেলা/...ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে/ বেরিয়ে যেতে পারে, বাহঃ কী সুন্দর!’
আমাদের সদা হাস্য যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ঢাকা-গাজীপুর সড়ক পরিদর্শনের খবর পড়তে পড়তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাটির কথা মনে পড়ল।
১৭ আগস্টের প্রথম আলোয় মন্ত্রীর সচিত্র সড়ক ভ্রমণের রিপোর্টের শুরুটা হলো: ‘যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গতকাল বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে সড়ক পরিদর্শনে যান। তাঁর গাড়িও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের কয়েকটি স্থানে কাদায় আটকে যায়। সড়কের ক্ষতবিক্ষত স্থানগুলোতে মন্ত্রী নামেননি, গাড়িতে বসেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।’ আলোকচিত্রী সাজিদ হোসেনের তোলা ছবির পরিচিতিতে বলা হয়: ‘মেঠোপথ নয়, মহাসড়ক। দুরবস্থা দেখতে মন্ত্রী গেলেন দামি গাড়িতে করে, নামলেন না। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে তোলা ছবি।’
কেবল ঢাকা-ময়মনসিংহ নয়, সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কের এই হাল কেন হলো? মন্ত্রী দুষলেন জোট সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বৃষ্টিকে। গত পনেরো বছরের মধ্যে নাকি এ রকম বৃষ্টি হয়নি। বর্ষাকালে বৃষ্টি তো আশীর্বাদ। মন্ত্রী কি জানেন, কৃষকের জন্য এই বৃষ্টি কতটা জরুরি। আর বৃষ্টি হলে রাস্তা ডুবে যেতে পারে। গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে কেন? রাস্তায় খানাখন্দ হয়েছে দীর্ঘদিন মেরামত না করার কারণে; এবং দায়িত্বটি ছিল যোগাযোগমন্ত্রীরই। তিনি দায়িত্ব পালন না করে এখন আবোল-তাবোল বলছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতেও এই ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বেহাল অবস্থা নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছিল। তখন বৃষ্টি ছিল না। মেরামতের কাজটি করলে মানুষের এত দুর্গতি-ভোগান্তি হতো না।
আসলে আমাদের যোগাযোগমন্ত্রীর চোখ সড়কে নেই। আছে আকাশে, পাতালে ও নদীতে। তিনি পাতালরেলের পরিকল্পনা করছেন, আকাশসড়ক বানাচ্ছেন এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের তোড়জোড় করছেন। এসব ভিভিআইপি সড়কে, সেতুতে যাতায়াত করবেন ভিভিআইপিরা। তাঁরা টোল দেবেন। মন্ত্রীর আয় বাড়বে (যদি মন্ত্রী সেই পর্যন্ত দায়িত্বে থাকেন)। অতএব, এবড়োখেবড়ো সড়কগুলোর দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন কী?
সড়ক মেরামত না হওয়ার জন্য যোগাযোগমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে দুষলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় নাকি সময়মতো অর্থ ছাড় করেনি। তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থনে কোনো তথ্য নেই। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরে সড়কপথের মেরামত বাবদ ৬৯০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে এক হাজার ৮২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই টাকা থেকে মেরামত বাবদ কোনো অর্থ ব্যয় করা হয়নি, এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অর্থ ছাড় করারও অনুরোধ করা হয়নি (প্রথম আলো, ১৭ আগস্ট ২০১১)।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় করার চেষ্টা করেছিলেন কি না? মন্ত্রীর জবাব ছিল, ‘বৃষ্টির মধ্যে তো কাজ করতে সমস্যা হয়। উন্নয়নকাজের জন্য রোদ ও খরা লাগে।’ যখন রোদ ছিল, তখন সংস্কারকাজ করেননি কেন? মন্ত্রীর সোজা উত্তর, ‘তখন রাস্তাঘাট এত খারাপ ছিল না।’
আসলে যোগাযোগমন্ত্রী সড়ক বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি একটি রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। গত ৪০ বছরে যা হয়নি, মন্ত্রী তা-ই করলেন: ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কটি বন্ধ করে দিলেন। সড়ক বন্ধ থাকলে তড়িঘড়ি সংস্কারকাজ করতে হবে। তা রোদ হোক আর বৃষ্টিই হোক এবং এই তড়িঘড়ি কাজে বেশি ফাঁকি হবে, বেশি চুরি হবে; কিন্তু কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
যদি মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়, সড়ক মেরামতের কাজটা গত বছর কেন করেননি? তিনি হয়তো বলবেন, গত বছর বৃষ্টি হয়নি। এ বছর কেন করেননি? এ বছর বেশি বৃষ্টি হয়েছে। সব প্রশ্নের মুখস্থ ও সোজা উত্তর। হলফ করে বলতে পারি, এই উত্তরে প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত হলেও দেশবাসী আশ্বস্ত হবেন না। চাইলে তিনি নিজস্ব লোক দিয়ে জনগণের মনোভাবটা জেনে নিতে পারেন। মানুষ কী বলে মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও সরকার সম্পর্কে।
২.
শাজাহান খান নৌপরিবহনমন্ত্রী। কিন্তু নৌপরিবহনের চেয়ে সড়ক পরিবহন ও সড়ক শ্রমিকদের নিয়েই তাঁর মাথাব্যথা বেশি। কেননা, মন্ত্রী পদটি অস্থায়ী, সড়ক পরিবহনের সভাপতির পদটি স্থায়ী। সাধারণত সমিতি বা ফেডারেশনের প্রধান বা নির্বাহী পদে যাঁরা থাকেন, তাঁরা মৃত্যুর আগে অবসর নেন না। সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী দায়িত্ব পালনকালে কারও প্রতি রাগ বা অনুরাগ দেখাতে পারেন না। তিনি কারও পক্ষে বা বিপক্ষে সুপারিশও করতে পারেন না। মন্ত্রী যখন সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সদস্যদের পরীক্ষা ছাড়া বা সহজ শর্তে লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করেন, তখন তিনি মন্ত্রিত্বের শপথ ভঙ্গ করেন। তাঁর ফেডারেশনের বাইরেও পরিবহন শ্রমিক সংগঠন আছে। কিংবা তিনি যাঁদের লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করেছেন, তাঁদের বাইরেও সদস্য আছেন।
মন্ত্রী মহোদয় কিসের ভিত্তিতে ২৮ হাজার লোককে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করলেন? তাঁরা যদি যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সুপারিশের প্রয়োজন নেই। আর যদি অযোগ্যদের ব্যাপারে সুপারিশ করে থাকেন, যোগ্যরা বঞ্চিত হবেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেছেন, ‘অশিক্ষিতদেরও সহজ শর্তে লাইসেন্স দেওয়া দরকার।’ এভাবে দেশের মানুষকে ‘শিক্ষিত ও অশিক্ষিত’ শ্রেণীতে ভাগ করা অন্যায়। যে কৃষক জমি চাষ করে শস্য ফলান, তিনি নিরক্ষর হতে পারেন, অশিক্ষিত নন। অনেক কৃষি কর্মকর্তার চেয়েও কৃষি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান অনেক বেশি। তেমনি যিনি রাস্তায় গাড়ি চালাবেন, তিনি কোন শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন, সেটি প্রধান বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হলো গাড়ি চালনার নিয়মকানুনগুলো তিনি জানেন কি না!
ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার মালিক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নন। বিআরটিএ যেসব শর্তে এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়, সেসব শর্ত মন্ত্রীর পছন্দ না হলে আইন বদলানোর জন্য সংসদে বিল আনতে পারেন। যে দল এক দিনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিতে পারে, সেই দল এই ছোট্ট কাজটি করতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। শাজাহান খানেরা চাইলে আইন করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্ব বিআরটিএর কাছ থেকে ফেডারেশনের কাছেও নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু যত দিন সেই আইন বদল না হচ্ছে, তত দিন বিআরটিএর নিয়মই মানতে হবে।
নৌপরিবহনমন্ত্রীর অনুসরণে এখন আইনমন্ত্রী যদি বলেন, এলএলবি পাস করা অনেক আইনজীবীর চেয়ে তাঁর মন্ত্রণালয়ে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা ভালো আইন বোঝেন। অতএব, এলএলবি ও বার কাউন্সিলের পরীক্ষা ছাড়াই তাঁদের আইনজীবীর সনদ দিতে হবে, তখন পরিস্থিতিটা কেমন দাঁড়াবে?
৩.
গত বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনকে অনেকে বাধ্যবাধকতার অধিবেশন বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদের ওই দিনটিই ছিল সবচেয়ে কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক। আপনারা ভেবে দেখুন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অভিজ্ঞ ও দক্ষ সাংসদেরা উপস্থিত থাকলে সেদিন সরকারি দল কেমন বেকায়দায় পড়ত। সংসদ কারও বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার জায়গা নয়। বারবার অতীতকে টেনে এনে কিছু লোকের নিন্দাবাদ করাও সাংসদদের কাজ নয়। সংসদ হলো সরকারের, মন্ত্রীদের জবাবদিহির জায়গা। বৃহস্পতিবারে সেই জবাবদিহি নেওয়ার চেষ্টা করেছেন ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য। বিরোধী দল থাকলে সরকার বুঝত, কত ধানে কত চাল।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ‘মানুষ কষ্টে আছে’ বলে সৌদি আরবে পাড়ি না জমিয়ে দেশে থাকলে সেই কষ্টটা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারতেন। বিএনপির নেতারা সংসদের বাইরে ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও’ বলে মাতম করলেও সংসদে গিয়ে সরকারের অন্যায় ও অপকর্মগুলো তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করেন না। সরকারের কাছে ভরসা না পেলে মানুষ বিরোধী দলের কাছে অভয় খোঁজে। দুর্ভাগ্য আমাদের, সরকার বা বিরোধী দল কেউই জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অভিযোগ নিয়ে ভাবে না। না হলে এই যে এতগুলো সড়ক বন্ধ হলো, মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ল, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ল—এ নিয়ে বিরোধী দলকে একটি কর্মসূচি নিতে দেখা যায়নি। তারা আছে কার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা হলো, কার ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ারা জারি হলো—এসব নিয়ে।
বিরোধী দল নয়, খোদ সরকারি দলের প্রথম সারির সদস্যরা যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। পদত্যাগ দাবি করেছেন মহাজোটের শরিক কয়েকজন সদস্যও। তাঁরা বলেছেন, আড়াই বছরে যে যোগাযোগমন্ত্রী সড়ক উন্নয়ন ও মেরামতে কিছু করতে পারেননি, তাঁর সেই পদ আঁকড়ে থাকার কোনো অধিকার নেই। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশ হলে অনেক আগেই তিনি পদত্যাগ করতেন।
কেবল সংসদে নয়, সংসদের বাইরে অফিসে, বাড়িতে, রাস্তাঘাটে—সর্বত্র এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রী। কদিন আগে আলোচনায় ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এর আগে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে ছিলেন অর্থমন্ত্রী। দেশের সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থা এতটাই প্রকট যে মাননীয় হাইকোর্ট, গত পাঁচ বছরে এই খাতে কত টাকা বরাদ্দ এবং কত টাকা ব্যয় হয়েছে, জানতে চেয়েছেন।
সর্বশেষ খবর হলো, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ব্যর্থতার দায় নিয়ে প্রধান প্রকৌশলী সাহাবউদ্দিন পদত্যাগ করেছেন। এর আগে নাকি সড়ক ভবনে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক শ শ্রমিক-কর্মচারী বিক্ষোভ করেছেন। সেটি সাজানো নাটকও হতে পারে। মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী মন্ত্রী। অতএব ব্যর্থতার দায় তিনি কিছুতেই এড়াতে পারেন না।
জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সাংসদেরা ব্যর্থতার দায় নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে মন্ত্রীরা কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন না। ভারতে রেল দুর্ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করে লালবাহাদুর শাস্ত্রী যে মহৎ দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন, তাঁকে অনুসরণ করার একজন লোকও পাওয়া যাবে না এই দেশে। এখানে কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেয় না। গলাধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে দিতে হয়। সেই সুযোগ জনগণ পাঁচ বছরে একবারই পায়। এখানে মন্ত্রীরা ত্যাগের চেয়ে পদকেই বড় মনে করেন। সেবার চেয়ে ক্ষমতাকে। জনগণের ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে বিরক্তি বাড়াতেই তাঁরা বেশি পছন্দ করেন। অতএব, যেভাবে আড়াই বছর চলেছে, সেভাবে বাকি আড়াই বছরও চলে যাবে।
তারপর কী হবে? আমি জানি না। পাঠক, আপনারা জানেন কি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
১৭ আগস্টের প্রথম আলোয় মন্ত্রীর সচিত্র সড়ক ভ্রমণের রিপোর্টের শুরুটা হলো: ‘যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গতকাল বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে সড়ক পরিদর্শনে যান। তাঁর গাড়িও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের কয়েকটি স্থানে কাদায় আটকে যায়। সড়কের ক্ষতবিক্ষত স্থানগুলোতে মন্ত্রী নামেননি, গাড়িতে বসেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।’ আলোকচিত্রী সাজিদ হোসেনের তোলা ছবির পরিচিতিতে বলা হয়: ‘মেঠোপথ নয়, মহাসড়ক। দুরবস্থা দেখতে মন্ত্রী গেলেন দামি গাড়িতে করে, নামলেন না। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে তোলা ছবি।’
কেবল ঢাকা-ময়মনসিংহ নয়, সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কের এই হাল কেন হলো? মন্ত্রী দুষলেন জোট সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বৃষ্টিকে। গত পনেরো বছরের মধ্যে নাকি এ রকম বৃষ্টি হয়নি। বর্ষাকালে বৃষ্টি তো আশীর্বাদ। মন্ত্রী কি জানেন, কৃষকের জন্য এই বৃষ্টি কতটা জরুরি। আর বৃষ্টি হলে রাস্তা ডুবে যেতে পারে। গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে কেন? রাস্তায় খানাখন্দ হয়েছে দীর্ঘদিন মেরামত না করার কারণে; এবং দায়িত্বটি ছিল যোগাযোগমন্ত্রীরই। তিনি দায়িত্ব পালন না করে এখন আবোল-তাবোল বলছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতেও এই ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বেহাল অবস্থা নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছিল। তখন বৃষ্টি ছিল না। মেরামতের কাজটি করলে মানুষের এত দুর্গতি-ভোগান্তি হতো না।
আসলে আমাদের যোগাযোগমন্ত্রীর চোখ সড়কে নেই। আছে আকাশে, পাতালে ও নদীতে। তিনি পাতালরেলের পরিকল্পনা করছেন, আকাশসড়ক বানাচ্ছেন এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের তোড়জোড় করছেন। এসব ভিভিআইপি সড়কে, সেতুতে যাতায়াত করবেন ভিভিআইপিরা। তাঁরা টোল দেবেন। মন্ত্রীর আয় বাড়বে (যদি মন্ত্রী সেই পর্যন্ত দায়িত্বে থাকেন)। অতএব, এবড়োখেবড়ো সড়কগুলোর দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন কী?
সড়ক মেরামত না হওয়ার জন্য যোগাযোগমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে দুষলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় নাকি সময়মতো অর্থ ছাড় করেনি। তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থনে কোনো তথ্য নেই। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরে সড়কপথের মেরামত বাবদ ৬৯০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে এক হাজার ৮২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই টাকা থেকে মেরামত বাবদ কোনো অর্থ ব্যয় করা হয়নি, এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অর্থ ছাড় করারও অনুরোধ করা হয়নি (প্রথম আলো, ১৭ আগস্ট ২০১১)।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় করার চেষ্টা করেছিলেন কি না? মন্ত্রীর জবাব ছিল, ‘বৃষ্টির মধ্যে তো কাজ করতে সমস্যা হয়। উন্নয়নকাজের জন্য রোদ ও খরা লাগে।’ যখন রোদ ছিল, তখন সংস্কারকাজ করেননি কেন? মন্ত্রীর সোজা উত্তর, ‘তখন রাস্তাঘাট এত খারাপ ছিল না।’
আসলে যোগাযোগমন্ত্রী সড়ক বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি একটি রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। গত ৪০ বছরে যা হয়নি, মন্ত্রী তা-ই করলেন: ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কটি বন্ধ করে দিলেন। সড়ক বন্ধ থাকলে তড়িঘড়ি সংস্কারকাজ করতে হবে। তা রোদ হোক আর বৃষ্টিই হোক এবং এই তড়িঘড়ি কাজে বেশি ফাঁকি হবে, বেশি চুরি হবে; কিন্তু কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
যদি মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়, সড়ক মেরামতের কাজটা গত বছর কেন করেননি? তিনি হয়তো বলবেন, গত বছর বৃষ্টি হয়নি। এ বছর কেন করেননি? এ বছর বেশি বৃষ্টি হয়েছে। সব প্রশ্নের মুখস্থ ও সোজা উত্তর। হলফ করে বলতে পারি, এই উত্তরে প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত হলেও দেশবাসী আশ্বস্ত হবেন না। চাইলে তিনি নিজস্ব লোক দিয়ে জনগণের মনোভাবটা জেনে নিতে পারেন। মানুষ কী বলে মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও সরকার সম্পর্কে।
২.
শাজাহান খান নৌপরিবহনমন্ত্রী। কিন্তু নৌপরিবহনের চেয়ে সড়ক পরিবহন ও সড়ক শ্রমিকদের নিয়েই তাঁর মাথাব্যথা বেশি। কেননা, মন্ত্রী পদটি অস্থায়ী, সড়ক পরিবহনের সভাপতির পদটি স্থায়ী। সাধারণত সমিতি বা ফেডারেশনের প্রধান বা নির্বাহী পদে যাঁরা থাকেন, তাঁরা মৃত্যুর আগে অবসর নেন না। সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী দায়িত্ব পালনকালে কারও প্রতি রাগ বা অনুরাগ দেখাতে পারেন না। তিনি কারও পক্ষে বা বিপক্ষে সুপারিশও করতে পারেন না। মন্ত্রী যখন সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সদস্যদের পরীক্ষা ছাড়া বা সহজ শর্তে লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করেন, তখন তিনি মন্ত্রিত্বের শপথ ভঙ্গ করেন। তাঁর ফেডারেশনের বাইরেও পরিবহন শ্রমিক সংগঠন আছে। কিংবা তিনি যাঁদের লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করেছেন, তাঁদের বাইরেও সদস্য আছেন।
মন্ত্রী মহোদয় কিসের ভিত্তিতে ২৮ হাজার লোককে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করলেন? তাঁরা যদি যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সুপারিশের প্রয়োজন নেই। আর যদি অযোগ্যদের ব্যাপারে সুপারিশ করে থাকেন, যোগ্যরা বঞ্চিত হবেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেছেন, ‘অশিক্ষিতদেরও সহজ শর্তে লাইসেন্স দেওয়া দরকার।’ এভাবে দেশের মানুষকে ‘শিক্ষিত ও অশিক্ষিত’ শ্রেণীতে ভাগ করা অন্যায়। যে কৃষক জমি চাষ করে শস্য ফলান, তিনি নিরক্ষর হতে পারেন, অশিক্ষিত নন। অনেক কৃষি কর্মকর্তার চেয়েও কৃষি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান অনেক বেশি। তেমনি যিনি রাস্তায় গাড়ি চালাবেন, তিনি কোন শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন, সেটি প্রধান বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হলো গাড়ি চালনার নিয়মকানুনগুলো তিনি জানেন কি না!
ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার মালিক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নন। বিআরটিএ যেসব শর্তে এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়, সেসব শর্ত মন্ত্রীর পছন্দ না হলে আইন বদলানোর জন্য সংসদে বিল আনতে পারেন। যে দল এক দিনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিতে পারে, সেই দল এই ছোট্ট কাজটি করতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। শাজাহান খানেরা চাইলে আইন করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্ব বিআরটিএর কাছ থেকে ফেডারেশনের কাছেও নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু যত দিন সেই আইন বদল না হচ্ছে, তত দিন বিআরটিএর নিয়মই মানতে হবে।
নৌপরিবহনমন্ত্রীর অনুসরণে এখন আইনমন্ত্রী যদি বলেন, এলএলবি পাস করা অনেক আইনজীবীর চেয়ে তাঁর মন্ত্রণালয়ে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা ভালো আইন বোঝেন। অতএব, এলএলবি ও বার কাউন্সিলের পরীক্ষা ছাড়াই তাঁদের আইনজীবীর সনদ দিতে হবে, তখন পরিস্থিতিটা কেমন দাঁড়াবে?
৩.
গত বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনকে অনেকে বাধ্যবাধকতার অধিবেশন বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদের ওই দিনটিই ছিল সবচেয়ে কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক। আপনারা ভেবে দেখুন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অভিজ্ঞ ও দক্ষ সাংসদেরা উপস্থিত থাকলে সেদিন সরকারি দল কেমন বেকায়দায় পড়ত। সংসদ কারও বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার জায়গা নয়। বারবার অতীতকে টেনে এনে কিছু লোকের নিন্দাবাদ করাও সাংসদদের কাজ নয়। সংসদ হলো সরকারের, মন্ত্রীদের জবাবদিহির জায়গা। বৃহস্পতিবারে সেই জবাবদিহি নেওয়ার চেষ্টা করেছেন ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য। বিরোধী দল থাকলে সরকার বুঝত, কত ধানে কত চাল।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ‘মানুষ কষ্টে আছে’ বলে সৌদি আরবে পাড়ি না জমিয়ে দেশে থাকলে সেই কষ্টটা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারতেন। বিএনপির নেতারা সংসদের বাইরে ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও’ বলে মাতম করলেও সংসদে গিয়ে সরকারের অন্যায় ও অপকর্মগুলো তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করেন না। সরকারের কাছে ভরসা না পেলে মানুষ বিরোধী দলের কাছে অভয় খোঁজে। দুর্ভাগ্য আমাদের, সরকার বা বিরোধী দল কেউই জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অভিযোগ নিয়ে ভাবে না। না হলে এই যে এতগুলো সড়ক বন্ধ হলো, মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ল, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ল—এ নিয়ে বিরোধী দলকে একটি কর্মসূচি নিতে দেখা যায়নি। তারা আছে কার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা হলো, কার ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ারা জারি হলো—এসব নিয়ে।
বিরোধী দল নয়, খোদ সরকারি দলের প্রথম সারির সদস্যরা যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। পদত্যাগ দাবি করেছেন মহাজোটের শরিক কয়েকজন সদস্যও। তাঁরা বলেছেন, আড়াই বছরে যে যোগাযোগমন্ত্রী সড়ক উন্নয়ন ও মেরামতে কিছু করতে পারেননি, তাঁর সেই পদ আঁকড়ে থাকার কোনো অধিকার নেই। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশ হলে অনেক আগেই তিনি পদত্যাগ করতেন।
কেবল সংসদে নয়, সংসদের বাইরে অফিসে, বাড়িতে, রাস্তাঘাটে—সর্বত্র এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রী। কদিন আগে আলোচনায় ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এর আগে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে ছিলেন অর্থমন্ত্রী। দেশের সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থা এতটাই প্রকট যে মাননীয় হাইকোর্ট, গত পাঁচ বছরে এই খাতে কত টাকা বরাদ্দ এবং কত টাকা ব্যয় হয়েছে, জানতে চেয়েছেন।
সর্বশেষ খবর হলো, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ব্যর্থতার দায় নিয়ে প্রধান প্রকৌশলী সাহাবউদ্দিন পদত্যাগ করেছেন। এর আগে নাকি সড়ক ভবনে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক শ শ্রমিক-কর্মচারী বিক্ষোভ করেছেন। সেটি সাজানো নাটকও হতে পারে। মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী মন্ত্রী। অতএব ব্যর্থতার দায় তিনি কিছুতেই এড়াতে পারেন না।
জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সাংসদেরা ব্যর্থতার দায় নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে মন্ত্রীরা কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন না। ভারতে রেল দুর্ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করে লালবাহাদুর শাস্ত্রী যে মহৎ দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন, তাঁকে অনুসরণ করার একজন লোকও পাওয়া যাবে না এই দেশে। এখানে কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেয় না। গলাধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে দিতে হয়। সেই সুযোগ জনগণ পাঁচ বছরে একবারই পায়। এখানে মন্ত্রীরা ত্যাগের চেয়ে পদকেই বড় মনে করেন। সেবার চেয়ে ক্ষমতাকে। জনগণের ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে বিরক্তি বাড়াতেই তাঁরা বেশি পছন্দ করেন। অতএব, যেভাবে আড়াই বছর চলেছে, সেভাবে বাকি আড়াই বছরও চলে যাবে।
তারপর কী হবে? আমি জানি না। পাঠক, আপনারা জানেন কি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments