খাবারে ভেজাল-‘কম খাওয়া’ মানে কম বিষ খাওয়া by এ কে এম জাকারিয়া
বাজারে নাকি ফরমালিন ছাড়া কোনো খেজুর নেই! রোজার একদম শুরুর দিকে ৪ আগস্ট মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে অভিযান চালিয়েছিলেন বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখানকার ফলের দোকানগুলোতে যত ধরনের খেজুর ছিল সবগুলোতেই ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ফরমালিন পাওয়া গেছে সেই বাজারে বিক্রির জন্য রাখা আঙুরেও।
শুধু মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট থেকেই দেড় হাজার কেজি খেজুর ও ৮০ কেজি আঙুর জব্দ করেছেন আদালত। পত্রপত্রিকা এই খবর ছেপেছে, দেখানো হয়েছে টিভি চ্যানেলগুলোতে। এই অভিযান চলেছে সকালের দিকে, বিকেলে কৃষি মার্কেটে গিয়েছিলেন এমন এক ক্রেতা জানিয়েছেন, বাজারের কোনো দোকানে খেজুর পাননি তিনি। এই অভিযানের সপ্তাহ খানেক পরে কৌতূহল হলো সেখানকার ‘খেজুর-পরিস্থিতি’ জানার। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে খেজুর বিক্রি হচ্ছে আগের মতোই, লোকজন কিনছেও। অভিযানের পর এখন যে খেজুর বিক্রি হচ্ছে তা কি ফরমালিনমুক্ত?
সেদিন কৃষি মার্কেটে অভিযান পরিচালনা করেছেন যে ম্যাজিস্ট্রেট, তাঁর বক্তব্য ছাপা হয়েছে সমকাল পত্রিকায় (৫ আগস্ট)। ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল আমীন বলেছেন, বাজারের সব খেজুরে ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এমনকি সৌদি আরব থেকে হাজিরা যে ‘ইনট্যাক্ট’ খেজুর নিয়ে এসেছেন, তাতেও ফরমালিন পাওয়া গেছে বিএসটিআই ল্যাবে পরীক্ষার পর। বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ জানিয়েছেন, খেজুরের ৩০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, সব পরীক্ষায় ফরমালিনের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। এসব তথ্য মেলালে যে সিদ্ধান্তে আসতে হয় তা হচ্ছে ফরমালিন ছাড়া বাজারে কোনো খেজুর নেই। দেশের ব্যবসায়ীরা যদি খেজুরে ফরমালিন মেশান তবে ব্যবস্থা এক রকম; আর যদি বিদেশেই তা করা হয়ে থাকে তবে ব্যবস্থা অন্য রকম। মোবাইল কোর্টের অভিযান হচ্ছে, পরীক্ষা হচ্ছে, খেজুর জব্দ হচ্ছে, শাস্তি-জরিমানা সব হচ্ছে কিন্তু কারা এ কাজটি করছেন বা কোথায় করা হচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করার মতো জরুরি কাজটিই হচ্ছে না। আমদানির পর ফরমালিন মেশানো হয়ে থাকলে আমদানিকারকদের ধরা দরকার, খুচরা ব্যবসায়ীরা মেশালে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি ফরমালিন মেশানো অবস্থায় আমদানি করা হয়ে থাকে, তবে বাধ্যতামূলক করতে হবে আমদানির আগে নমুনা পরীক্ষা। আর পরীক্ষায় ফরমালিনের উপস্থিতি ধরা পড়লে আমদানি বন্ধ করে দেওয়াই তো একমাত্র পথ।
সৌদি আরব থেকে হাজিদের নিয়ে আসা খেজুরেও যদি ফরমালিন মেশানো থাকে, তবে ‘ফরমালিন’ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা দরকার। সৌদি আরবের মতো দেশেও কি তবে আমাদের দেশের মতো এত সহজেই খাবারে বিষ মেশানো যায়? তা না হলে ফরমালিন এল কোথা থেকে? ফরমালিন দিয়ে খাদ্য সংরক্ষণের বিষয়টি কি তবে স্বীকৃত? ফরমালিনের ‘গ্রহণযোগ্য মাত্রার’ একটি তত্ত্বও ইদানীং বাজারে চালু হয়েছে। আদৌ কি তেমন কিছু আছে? বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (ডেইলি স্টার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেছেন, খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ফরমালিনের ব্যবহারের গ্রহণযোগ্য মাত্রা বলে কিছু নেই। এটা একধরনের বিষ, এর বেশি মাত্রা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ফরমালিনের ‘গ্রহণযোগ্য মাত্রার’ খোঁজখবর নিতে গিয়ে বিশ্বের কোথাও খাবারের ক্ষেত্রে এর কোনো গ্রহণযোগ্য মাত্রার খোঁজ পাওয়া গেল না।
পানির সঙ্গে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইডের মিশ্রণ হচ্ছে ফরমালিন। কসমেটিকসে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর গ্রহণযোগ্য মাত্রার বাধ্যবাধকতা আছে। খাবার তো দূরে থাক, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে গত বছর ৭ জুলাই কাঠজাত পণ্যে ফরমালডিহাইড ব্যবহারের মাত্রা নিয়ে একটি বিল পাস হয়েছে। বিলে পলিউড, পার্টিকেল বোর্ড বা এ ধরনের কাঠজাতীয় পণ্য থেকে ফরমালডিহাইড নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সেই মাত্রা হচ্ছে দশমিক ০৯ পিপিএম। আমাদের দেশে নানা কোম্পানির এ ধরনের বোর্ড আমরা ব্যবহার করে আসছি অফিসে ও বাসায়, এগুলো দিয়ে করছি অফিস-সজ্জা, বানাচ্ছি আসবাব। এগুলো থেকে ফরমালডিহাইড নিঃসরণের মাত্রা কত, তা কি আমার কেউ জানি! নাকি মাছ, খেজুর আর আঙুরের সঙ্গে ফরমালিন পেটে পোরার পাশাপাশি বাসায় ও অফিসে বসে নিঃশ্বাসেও আমরা ফরমালডিহাইড নিচ্ছি? আমাদের দেশে এ ধরনের কাঠজাত সামগ্রীতে ফরমালডিহাইড ব্যবহারের কোনো গ্রহণযোগ্য মাত্রা ঠিক করা আছে কি? অথবা কসমেটিকসের ক্ষেত্রে? কানাডার এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন অ্যাক্ট ১৯৯৯ সালে ফরমালডিহাইডকে বিষাক্ত পদার্থ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
খাবারে ফরমালিন মেশানোর এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়ার অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় এ সমস্যা বেশ জোরালো। সেখানে মাছ, ফল থেকে শুরু করে নুডলস ও টফুর মতো খাদ্যপণ্যেও ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে পরীক্ষায়। সেখানকার খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান (বিপিওএম) ফরমালিন মেশানো খাদ্য ফরমালিনমুক্ত করা যায় কি না সে চেষ্টাও করে দেখেছে। যেসব পণ্যে ফরমালিন পাওয়া গেছে, সেগুলো ভালো করে ধুয়ে ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট ফুটিয়ে তারা দেখেছে যে তাতে ফরমালিনের মাত্রা কিছুটা কমেছে ঠিকই কিন্তু পুরো ফরমালিনমুক্ত করা যায়নি। এ থেকে সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যদি খাবারে একবার ফরমালিন মেশানো হয়, তবে তা ফরমালিনমুক্ত করার সুযোগ নেই।
এক ফরমালিন নিয়েই এত সমস্যা, ১০ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত এক গোলটেবিলে বিশেষজ্ঞদের তথ্য হচ্ছে বাংলাদেশে খাবারে অন্তত ২০০ ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এই গোলটেবিল আলোচনায় আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এস কে রয় যে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন, সেখানে বলা হয়েছে মিষ্টি, সন্দেশ, দই, ঘি, ছানা, সস, ডালডা, সয়াবিন ও আইসক্রিমের মতো পণ্য ডিসিসির গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৭৬ শতাংশের বেশি খাবারেই ভেজাল রয়েছে। খাবারে ভেজাল দেওয়া ঠেকাতে ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অর্ডিন্যান্স সংশোধন করে করা ‘বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ (সংশোধিত) ২০০৫’-এ এ ধরনের অপরাধের শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। এরপর প্রায় বছর ছয়েক কেটে গেছে, আমরা দেখছি খাবারে ভেজাল ও বিষাক্ত দ্রব্য মেশানোর ঘটনা বেড়েই চলছে। বোঝা যাচ্ছে, এই সংশোধন বা শাস্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি তেমন কাজে দেয়নি। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মতো অপরাধের মাত্রা যত বড়, সে তুলনায় সংশোধিত আইনে শাস্তির মাত্রা খুবই সামান্য। আমাদের আইনে খুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, যাঁরা খাবারে ভেজাল মেশান তাঁরা তো নীরবে খুন করে চলেছেন একটি জাতিকে। ফরমালিন মেশানো খেজুর, আঙুর বা মাছ খাওয়ানো মানে তো শিশুর মুখে বিষ তুলে দেওয়া। এ ধরনের কাজ কয়েকবার করে ধরা পড়লে সর্বোচ্চ শাস্তির যে মাত্রা তা হচ্ছে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও তিন লাখ টাকা জরিমানা।
বর্তমান বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, বিএসটিআই বা সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠান, তাদের বর্তমান লোকবল বা কারিগরি ও গবেষণাগার-সুবিধা—এসব দিয়ে সব খাদ্যের ওপর জেঁকে বসা এই ভেজাল-সন্ত্রাসকে ঠেকানো যাবে না। খাদ্যে ভেজাল যাঁরা মেশান, তাঁদের ‘সৃজনশীলতার’ ঘাটতি নেই। ফরমালিনের কথা আমরা সাধারণ জনগণ জেনে গেছি, মাছ কিনে অনেকে এখন পরীক্ষাও করান (যদিও শুধু ঢাকার কারওয়ান বাজারে একমাত্র এই সুবিধা রয়েছে)। ফরমালিন ঠেকাতে বেশি তৎপরতা চললে নিশ্চয়ই শুরু হবে নতুন কিছুর ব্যবহার। সেটা টের পেতে পেতে দেখা যাবে আরও সময় পার হয়ে যাবে। খাদ্য ও ওষুধের ব্যাপারে সবচেয়ে সচেতন দেশ হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র তার জনগণের জন্য ভোজালমুক্ত খাবার নিশ্চিত করতে আইন করেছিল সেই ১৯০৬ সালে। সে বছর ৩০ জুন পাস হওয়া এই ‘বিশুদ্ধ খাদ্য ও ওষুধ অ্যাক্ট’ কেন্দ্রীয় সরকারকে মাংসজাত খাদ্য তদারকি ও ভেজাল ও দূষিত খাবার এবং বিষাক্ত ওষুধ উৎপাদন, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দেয়। এই আইনকে কেন্দ্র করে বিশুদ্ধ খাদ্য ও ওষুধ নিশ্চিত করার ধারাবাহিক ও অব্যাহত চেষ্টার ফল হচ্ছে আজকের শক্তিশালী ফুড অ্যান্ড ড্রাগ আডমিনিস্ট্রেশন বা সংক্ষেপে এফডিএ। বাংলাদেশের খাদ্যে ভেজাল সমস্যা যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, তাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে এফডিএর আদলে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়া কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। বিষয়টি সার্বক্ষণিক তদারকি, নজরদারি ও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান এবং এর পরপরই আবার সেই পণ্য বিক্রি—এই চোর-পুলিশ খেলায় কোনো কাজ হবে না।
কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে কী বিপদেই না পড়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী! কথাটি তিনি বলেছিলেন খাদ্যে ভেজাল প্রসঙ্গে। খুব কি অযৌক্তিক পরামর্শ দিয়েছেন তিনি? সব খাবারেই যেহেতু বিষ, আপনি যত কম খাবেন ততই তো মঙ্গল! শুধু খেজুরে ফরমালিন থাকলে না হয় খেজুর খাওয়া বাদ দিলে হতো। মাছ, ফল বা শাকসবজি—সবকিছুতেই তো বিষ। সাদা, সুন্দর ও ঝরঝরে রাখতে চালেও মেশানো হচ্ছে বিষ। ঈদ সামনে, ভেজাল ছাড়া সেমাই বা ঘি খুঁজে পাওয়ার কোনো পথ ক্রেতাদের জানা আছে কি? বাজারের বিক্রি হয় এমন খাদ্যপণ্যের মধ্যে ৭৬ শতাংশই তো ভেজাল বা বিষ মেশানো। কম খাওয়া মানে হচ্ছে বিষ কম খাওয়া। এখন কম খাওয়ার পরামর্শ এসেছে, সরকার যদি খাবারে বিষ মেশানো বন্ধ করতে না পারে, তবে ভবিষ্যতে তো অন্য কোনো মন্ত্রীকে একেবারে না খাওয়ারই পরামর্শ দিতে হবে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
সেদিন কৃষি মার্কেটে অভিযান পরিচালনা করেছেন যে ম্যাজিস্ট্রেট, তাঁর বক্তব্য ছাপা হয়েছে সমকাল পত্রিকায় (৫ আগস্ট)। ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল আমীন বলেছেন, বাজারের সব খেজুরে ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এমনকি সৌদি আরব থেকে হাজিরা যে ‘ইনট্যাক্ট’ খেজুর নিয়ে এসেছেন, তাতেও ফরমালিন পাওয়া গেছে বিএসটিআই ল্যাবে পরীক্ষার পর। বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ জানিয়েছেন, খেজুরের ৩০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, সব পরীক্ষায় ফরমালিনের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। এসব তথ্য মেলালে যে সিদ্ধান্তে আসতে হয় তা হচ্ছে ফরমালিন ছাড়া বাজারে কোনো খেজুর নেই। দেশের ব্যবসায়ীরা যদি খেজুরে ফরমালিন মেশান তবে ব্যবস্থা এক রকম; আর যদি বিদেশেই তা করা হয়ে থাকে তবে ব্যবস্থা অন্য রকম। মোবাইল কোর্টের অভিযান হচ্ছে, পরীক্ষা হচ্ছে, খেজুর জব্দ হচ্ছে, শাস্তি-জরিমানা সব হচ্ছে কিন্তু কারা এ কাজটি করছেন বা কোথায় করা হচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করার মতো জরুরি কাজটিই হচ্ছে না। আমদানির পর ফরমালিন মেশানো হয়ে থাকলে আমদানিকারকদের ধরা দরকার, খুচরা ব্যবসায়ীরা মেশালে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি ফরমালিন মেশানো অবস্থায় আমদানি করা হয়ে থাকে, তবে বাধ্যতামূলক করতে হবে আমদানির আগে নমুনা পরীক্ষা। আর পরীক্ষায় ফরমালিনের উপস্থিতি ধরা পড়লে আমদানি বন্ধ করে দেওয়াই তো একমাত্র পথ।
সৌদি আরব থেকে হাজিদের নিয়ে আসা খেজুরেও যদি ফরমালিন মেশানো থাকে, তবে ‘ফরমালিন’ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা দরকার। সৌদি আরবের মতো দেশেও কি তবে আমাদের দেশের মতো এত সহজেই খাবারে বিষ মেশানো যায়? তা না হলে ফরমালিন এল কোথা থেকে? ফরমালিন দিয়ে খাদ্য সংরক্ষণের বিষয়টি কি তবে স্বীকৃত? ফরমালিনের ‘গ্রহণযোগ্য মাত্রার’ একটি তত্ত্বও ইদানীং বাজারে চালু হয়েছে। আদৌ কি তেমন কিছু আছে? বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (ডেইলি স্টার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেছেন, খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ফরমালিনের ব্যবহারের গ্রহণযোগ্য মাত্রা বলে কিছু নেই। এটা একধরনের বিষ, এর বেশি মাত্রা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ফরমালিনের ‘গ্রহণযোগ্য মাত্রার’ খোঁজখবর নিতে গিয়ে বিশ্বের কোথাও খাবারের ক্ষেত্রে এর কোনো গ্রহণযোগ্য মাত্রার খোঁজ পাওয়া গেল না।
পানির সঙ্গে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইডের মিশ্রণ হচ্ছে ফরমালিন। কসমেটিকসে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর গ্রহণযোগ্য মাত্রার বাধ্যবাধকতা আছে। খাবার তো দূরে থাক, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে গত বছর ৭ জুলাই কাঠজাত পণ্যে ফরমালডিহাইড ব্যবহারের মাত্রা নিয়ে একটি বিল পাস হয়েছে। বিলে পলিউড, পার্টিকেল বোর্ড বা এ ধরনের কাঠজাতীয় পণ্য থেকে ফরমালডিহাইড নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সেই মাত্রা হচ্ছে দশমিক ০৯ পিপিএম। আমাদের দেশে নানা কোম্পানির এ ধরনের বোর্ড আমরা ব্যবহার করে আসছি অফিসে ও বাসায়, এগুলো দিয়ে করছি অফিস-সজ্জা, বানাচ্ছি আসবাব। এগুলো থেকে ফরমালডিহাইড নিঃসরণের মাত্রা কত, তা কি আমার কেউ জানি! নাকি মাছ, খেজুর আর আঙুরের সঙ্গে ফরমালিন পেটে পোরার পাশাপাশি বাসায় ও অফিসে বসে নিঃশ্বাসেও আমরা ফরমালডিহাইড নিচ্ছি? আমাদের দেশে এ ধরনের কাঠজাত সামগ্রীতে ফরমালডিহাইড ব্যবহারের কোনো গ্রহণযোগ্য মাত্রা ঠিক করা আছে কি? অথবা কসমেটিকসের ক্ষেত্রে? কানাডার এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন অ্যাক্ট ১৯৯৯ সালে ফরমালডিহাইডকে বিষাক্ত পদার্থ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
খাবারে ফরমালিন মেশানোর এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়ার অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় এ সমস্যা বেশ জোরালো। সেখানে মাছ, ফল থেকে শুরু করে নুডলস ও টফুর মতো খাদ্যপণ্যেও ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে পরীক্ষায়। সেখানকার খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান (বিপিওএম) ফরমালিন মেশানো খাদ্য ফরমালিনমুক্ত করা যায় কি না সে চেষ্টাও করে দেখেছে। যেসব পণ্যে ফরমালিন পাওয়া গেছে, সেগুলো ভালো করে ধুয়ে ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট ফুটিয়ে তারা দেখেছে যে তাতে ফরমালিনের মাত্রা কিছুটা কমেছে ঠিকই কিন্তু পুরো ফরমালিনমুক্ত করা যায়নি। এ থেকে সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যদি খাবারে একবার ফরমালিন মেশানো হয়, তবে তা ফরমালিনমুক্ত করার সুযোগ নেই।
এক ফরমালিন নিয়েই এত সমস্যা, ১০ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত এক গোলটেবিলে বিশেষজ্ঞদের তথ্য হচ্ছে বাংলাদেশে খাবারে অন্তত ২০০ ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এই গোলটেবিল আলোচনায় আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এস কে রয় যে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন, সেখানে বলা হয়েছে মিষ্টি, সন্দেশ, দই, ঘি, ছানা, সস, ডালডা, সয়াবিন ও আইসক্রিমের মতো পণ্য ডিসিসির গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৭৬ শতাংশের বেশি খাবারেই ভেজাল রয়েছে। খাবারে ভেজাল দেওয়া ঠেকাতে ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অর্ডিন্যান্স সংশোধন করে করা ‘বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ (সংশোধিত) ২০০৫’-এ এ ধরনের অপরাধের শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। এরপর প্রায় বছর ছয়েক কেটে গেছে, আমরা দেখছি খাবারে ভেজাল ও বিষাক্ত দ্রব্য মেশানোর ঘটনা বেড়েই চলছে। বোঝা যাচ্ছে, এই সংশোধন বা শাস্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি তেমন কাজে দেয়নি। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মতো অপরাধের মাত্রা যত বড়, সে তুলনায় সংশোধিত আইনে শাস্তির মাত্রা খুবই সামান্য। আমাদের আইনে খুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, যাঁরা খাবারে ভেজাল মেশান তাঁরা তো নীরবে খুন করে চলেছেন একটি জাতিকে। ফরমালিন মেশানো খেজুর, আঙুর বা মাছ খাওয়ানো মানে তো শিশুর মুখে বিষ তুলে দেওয়া। এ ধরনের কাজ কয়েকবার করে ধরা পড়লে সর্বোচ্চ শাস্তির যে মাত্রা তা হচ্ছে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও তিন লাখ টাকা জরিমানা।
বর্তমান বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, বিএসটিআই বা সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠান, তাদের বর্তমান লোকবল বা কারিগরি ও গবেষণাগার-সুবিধা—এসব দিয়ে সব খাদ্যের ওপর জেঁকে বসা এই ভেজাল-সন্ত্রাসকে ঠেকানো যাবে না। খাদ্যে ভেজাল যাঁরা মেশান, তাঁদের ‘সৃজনশীলতার’ ঘাটতি নেই। ফরমালিনের কথা আমরা সাধারণ জনগণ জেনে গেছি, মাছ কিনে অনেকে এখন পরীক্ষাও করান (যদিও শুধু ঢাকার কারওয়ান বাজারে একমাত্র এই সুবিধা রয়েছে)। ফরমালিন ঠেকাতে বেশি তৎপরতা চললে নিশ্চয়ই শুরু হবে নতুন কিছুর ব্যবহার। সেটা টের পেতে পেতে দেখা যাবে আরও সময় পার হয়ে যাবে। খাদ্য ও ওষুধের ব্যাপারে সবচেয়ে সচেতন দেশ হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র তার জনগণের জন্য ভোজালমুক্ত খাবার নিশ্চিত করতে আইন করেছিল সেই ১৯০৬ সালে। সে বছর ৩০ জুন পাস হওয়া এই ‘বিশুদ্ধ খাদ্য ও ওষুধ অ্যাক্ট’ কেন্দ্রীয় সরকারকে মাংসজাত খাদ্য তদারকি ও ভেজাল ও দূষিত খাবার এবং বিষাক্ত ওষুধ উৎপাদন, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দেয়। এই আইনকে কেন্দ্র করে বিশুদ্ধ খাদ্য ও ওষুধ নিশ্চিত করার ধারাবাহিক ও অব্যাহত চেষ্টার ফল হচ্ছে আজকের শক্তিশালী ফুড অ্যান্ড ড্রাগ আডমিনিস্ট্রেশন বা সংক্ষেপে এফডিএ। বাংলাদেশের খাদ্যে ভেজাল সমস্যা যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, তাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে এফডিএর আদলে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়া কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। বিষয়টি সার্বক্ষণিক তদারকি, নজরদারি ও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান এবং এর পরপরই আবার সেই পণ্য বিক্রি—এই চোর-পুলিশ খেলায় কোনো কাজ হবে না।
কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে কী বিপদেই না পড়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী! কথাটি তিনি বলেছিলেন খাদ্যে ভেজাল প্রসঙ্গে। খুব কি অযৌক্তিক পরামর্শ দিয়েছেন তিনি? সব খাবারেই যেহেতু বিষ, আপনি যত কম খাবেন ততই তো মঙ্গল! শুধু খেজুরে ফরমালিন থাকলে না হয় খেজুর খাওয়া বাদ দিলে হতো। মাছ, ফল বা শাকসবজি—সবকিছুতেই তো বিষ। সাদা, সুন্দর ও ঝরঝরে রাখতে চালেও মেশানো হচ্ছে বিষ। ঈদ সামনে, ভেজাল ছাড়া সেমাই বা ঘি খুঁজে পাওয়ার কোনো পথ ক্রেতাদের জানা আছে কি? বাজারের বিক্রি হয় এমন খাদ্যপণ্যের মধ্যে ৭৬ শতাংশই তো ভেজাল বা বিষ মেশানো। কম খাওয়া মানে হচ্ছে বিষ কম খাওয়া। এখন কম খাওয়ার পরামর্শ এসেছে, সরকার যদি খাবারে বিষ মেশানো বন্ধ করতে না পারে, তবে ভবিষ্যতে তো অন্য কোনো মন্ত্রীকে একেবারে না খাওয়ারই পরামর্শ দিতে হবে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments