সরকার ও বিরোধী দল-রাজনীতিতে দুর্যোগের ঘনঘটা by মোহীত উল আলম
রাজনীতিতে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দিয়েছে। প্রকৃতিতে বসন্ত জাগরুক, পুরোনো পাতা খসছে, নতুন পাতা আসছে, আর রাজনীতিতে ঝড়ের আলামত। ১২ মার্চ বিএনপি ও তার সমর্থিত জামায়াতে ইসলামীসহ ১৪টি দল ‘ঢাকা চলো’ সমাবেশের অনুষ্ঠানে সাত থেকে আট লাখ লোকের সমাবেশ ঘটানোর আয়োজন করছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এ সমাবেশ হবে সংক্ষুব্ধ। ইত্তেফাক-এর একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জঙ্গিবাদী দলগুলো ওই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালানোর সুযোগ নেবে। অনেকের ধারণা, প্রধান বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন চালালেও তাদের মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম পণ্ড করা।
১২ মার্চ সোমবার। রাজধানীতে একটি পরিপূর্ণ কার্যকালীন দিবস। কিন্তু লাখ লাখ লোক অতিরিক্ত জমা হলে ঢাকার জনজীবন ও কর্মজীবন চাপের মুখে পড়বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। শোনা যাচ্ছে, দেশের সব জেলা থেকে বিএনপির মোট ৪৫টি কমিটি লোক জড়ো করা আর নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করবে। ঢাকায় ৯ মার্চ থেকে লোক আনা হবে। বিরোধী জোটের অন্য শরিক দলগুলোও অনুরূপভাবে লোক জমায়েত করবে।
সরকারি দলও বসে নেই। প্রথমে তাদের ইচ্ছা ছিল সমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে বিরোধী দলের মুখোমুখি হওয়া। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কায় সেটা বাদ দিয়ে তারা সমাবেশের আগে-পিছে কর্মসূচি দিয়েছে, যার প্রথমটি হচ্ছে ৭ মার্চ উদ্যাপন করা, যে দিন ১৯৭১ সালে রেস কোর্সের সেই বিখ্যাত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটিকে উপলক্ষ করে সরকারি দল নিজেদের পক্ষেও একটি জনস্রোত তৈরি করতে চায়, যা বিরোধী দলের কাছে একটি বার্তা পৌঁছাবে।
তাহলে আগামী সপ্তাহ একটি সাংঘর্ষিক সময় পার করবে। কিন্তু জনগণের উদ্বেগের কারণগুলো নির্ণয় করা দরকার। সকালে প্রাতর্ভ্রমণে বের হয়ে রাস্তায় দুই ভিক্ষুকের মধ্যে ঝগড়া দেখলাম। একজন সম্পূর্ণ নুলো, আরেকজন সম্পূর্ণ অন্ধ। অন্ধ ভিক্ষুকটি রেগে নুলো ভিক্ষুককে বলছে, ‘আমি কি কখনো তোমার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম? অর্থাৎ, এক জায়গায় দাঁড়ালে তাদের পরস্পরের ভিক্ষার স্বার্থে আঘাত লাগে। জবাবে নুলো ভিক্ষুকটি কী বলেছিল, হাঁটার গতির কারণে শুনতে পাইনি। কিন্তু স্বার্থের হানাহানি যেমন ভিক্ষুকদের মধ্যে বিরোধের কারণ, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোও স্বার্থের হানাহানির কারণে দাঙ্গা বাধায়। কিন্তু সমস্যাটা হলো, ক্ষমতায় তো একটি দলই থাকবে, আর আরেকটি বা একাধিক দল ক্ষমতায় আসতে চাইবে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে উপাচার্য হবেন তো একজনই, যদিও অনেক অধ্যাপকের ওই পদটির জন্য খায়েশ থাকতে পারে। ক্ষমতাসীন দল এবং ক্ষমতায় যেতে চায় দলটির মধ্যে দড়িটানাটানির রেওয়াজ সব দেশেই আছে। এটি আমেরিকায় যেমন সত্য, বাংলাদেশেও। ভিক্ষুকবচসাসম ক্ষমতা নিয়ে এ কামড়াকামড়ির প্রেক্ষাপট তৈরি হয় বলে বহু আগে থেকে এ দার্শনিকতালব্ধ রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে প্রতি চার বা পাঁচ বছর মেয়াদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির একটা সুযোগ তৈরি হয়। এবং ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে পুনরাগমনের পর দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতার ভাগাভাগির ছকটি স্পষ্টতই ৫০-৫০ হয়েছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, আওয়ামী লীগ—এভাবে হয়েছে, মাঝখানে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অতি অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের কথা বাদ দিলে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে বেকায়দাভাবে পরাজিত হওয়ার পর, প্রধান বিরোধী দলের রাজনীতির অতিক্রমণ লক্ষ করলে বোঝা যাবে, আর যাই হোক সেখানে যুক্তির প্রাবল্য ছিল খুব কম। যদি ধরি সংসদ বর্জনের কথা, তাহলে এটির অনৈতিক দিকটি হচ্ছে, এক, বিরোধী দলের সাংসদেরা সব রকম পার্থিব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে, শুধু ৯০ কার্যদিবসের আইনি ক্ষীণসুতোর মতো শর্তটির সঙ্গে ঝুলে থেকে দিনের পর দিন সংসদ বর্জন করে চলেছেন। দুই. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তির আইনটি মহাজোট সরকার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাস করিয়ে নিলেও সেখানে যদি বিরোধী দল আলোচনায় অংশ নিত এবং তারপর হেরে যেত তাহলে নীতিগতভাবে এবং আইনিভাবে তাদের অবস্থান জাতির কাছে পরিষ্কার থাকত। যেমন ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনী পাস হওয়ার সময় সাংসদ জেনারেল ওসমানী এবং মইনুল হোসেন ভোট দানে বিরত ছিলেন। এর ফলে তাঁদের নীতিগত অবস্থান—সেটা যাই হোক না কেন, জাতির কাছে পরিষ্কার ছিল। সংসদের এ ধরনের রেওয়াজগুলো না মেনে রাস্তায় লোক জড়ো করানোর রাজনীতি বলা যাবে না যে সুবিবেচেনাকর কর্মসূচি হয়েছে। একবার তাঁরা ক্ষেপে উঠলেন বিরোধী দলের নেত্রীর আবাসন উচ্ছেদ প্রশ্নে। আরেকবার ক্ষেপে উঠলেন বিরোধী দলের নেত্রীর পুত্র দুজনের মুক্তি চেয়ে যাঁদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা বিচারাধীন আছে। ঠিক জাতীয় সংকট বলতে যেটা বোঝায়, যেমন দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিনা বিচারে হত্যা, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাধিক্য, ছাত্ররাজনীতিতে সন্ত্রাসনির্ভরতা, ভারতের সঙ্গে তিস্তা, টিপাইমুখসহ বহুবিধ সমস্যা, এগুলোর কোনোটাকে ইস্যু করে বিএনপি সংসদে কথা বলেনি। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথায় আসি। যদিও এটি বাংলাদেশে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং কারচুপিবিহীন ভোট প্রদানের একটি বাতাবরণ তৈরি করেছে, কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিছু অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, যেমন বয়সসীমা বাড়িয়ে নেওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে না পারা, এবং অপ্রতিষ্ঠিত অভিযোগের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের কারাগারে আটক করা। তার চেয়েও স্পষ্ট থাকে যে চাপা আশঙ্কাটি, সেটি হলো এটি অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখলের জন্য একটি দরজা খোলা রাখার ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়া।
অন্যদিকে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করার কৌশল বিএনপি নিতে চায় মনে হয়। যেমন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে সব দলের সঙ্গে আলোচনার একটি ব্যবস্থা করা হয়। এ ব্যাপারেও বিএনপির নেতিবাচক অবস্থান হতাশা তৈরি করেছে তাঁদের মধ্যে যাঁরা বিএনপির কাছে আরও যুক্তিনির্ভর রাজনীতি আশা করেন। শেষ পর্যন্ত নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিলে বিএনপি সঙ্গে সঙ্গে জানাল যে তারা এ নিয়োগ মানে না। এখন কথা হলো, আওয়ামী লীগ আর বিএনপি বাংলাদেশের জন্য শেষ কথা নয়, কোটি কোটি মানুষ আছেন যাঁরা দলমত-নির্বিশেষে ভালো যুক্তিশীল সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেবেন। শুধু দলীয় আবেগনির্ভর যুক্তিকে গোটা জাতির যুক্তি মনে করলে বেশ বড় রকমের ভুল হবে। আবার ইভিএম বা কম্পিউটারের মাধ্যমে ভোট প্রয়োগ একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৌশল। যে কটি নির্বাচনে এ পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে, সব জায়গায় এটি শতকরা শতভাগ সফল এবং কোনো পরাজিত প্রার্থীর কাছ থেকে এটার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। এ ইভিএমের ব্যাপারেও বিএনপির আপত্তি আছে দেখলাম। হয়তো বলা হবে, আমেরিকায় তো ইভিএম প্রচলিত নেই। তাহলে বলব, আমেরিকায় তো এভাবে সংসদ বর্জনের রেওয়াজ নেই, নেই লোক জড়ো করানোর হুমকি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেও আমেরিকায় কিছু নেই। আর কম্পিউটারপ্রযুক্তিকে অস্বীকার করলে ব্যাংক, বিমা, শিল্প, বিপণন, প্রচার কিছুই চলবে না।
এখন হয়তো উত্তেজনাবশত এ রকম ধারণা হতে পারে যে ১২ মার্চ ’ঢাকা চলো’ সমাবেশের আয়োজন করার অধিকার বিরোধী দলের শাসনতান্ত্রিক অধিকার, কিন্তু এর ফলে যদি অনিয়ন্ত্রণজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, শুরু হয় অবাঞ্ছিত গোলযোগ, হয় রক্তপাত, যা আইনশৃঙ্ক্ষলারক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নাও হতে পারে, সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অধিকার কিন্তু শাসনতন্ত্র ব্যক্তি, সমষ্টি, কিংবা রাজনৈতিক দল কাউকেই দেয়নি।
আমেরিকার শাসনতন্ত্রের প্রথম সংশোধনী, যেটাতে ‘বাক্-স্বাধীনতা’র আইনটি পাস হয় (১৭৯১), পরবর্তীকালে একটি মামলায় সে বাক্-স্বাধীনতার সীমানির্ধারণপূর্বক একটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়লে, তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস জুনিয়র বললেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো পরিস্থিতি ‘ক্লিয়ার অ্যান্ড প্রেজেন্ট ডেঞ্জার’ বা সুনিশ্চিতভাবে তাৎক্ষণিক বিপদের সৃষ্টি না করে ততক্ষণ পর্যন্ত বাক্-স্বাধীনতার প্রয়োগ চলবে। এখন বিরোধী দলকেই বুঝতে হবে, ১২ মার্চের ঢাকা চলো সমাবেশটি কোনো সুনিশ্চিতভাবে তাৎক্ষণিক বিপদের সৃষ্টি করছে কি না। যে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া শেষ পর্যন্ত বিরাধী দলের নেতাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে!
১২ মার্চের সমাবেশের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আমার উদ্বেগ খুব সামান্য। পত্রপত্রিকায় ছবি দেখলাম ১২ মার্চের সমাবেশের প্রস্তুতিপর্ব অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের বিরোধী দলের এক দল যুবক ছেলে আরেক দলকে লাঠিসোঁটা, দা-কিরিচ নিয়ে আক্রমণ করছে। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনগুলোরও এ ধরনের অনেক ছবি পত্রিকায় আসে আর আমরা হতাশায় নিমজ্জিত হই। এই যুবশক্তিই একদিন ক্ষমতায় আসবে, দেশ চালাবে, এদের যদি আমরা সুস্থ দায়িত্বশীল কর্মপরিচালনার মধ্যে না রাখি, তাহলে আমরা তো থাকব না, কিন্তু দেশটার যে লন্ডভন্ড অবস্থা হবে।
আমার মনে ছোট্ট একটা প্রশ্ন, যেটার উত্তর আমি প্রায়ই পাই না, সেটা হলো সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সামাজিক দায়িত্বশীলতার কি কোনো সম্পর্ক নেই? থাকলে সেটি কোথায়? নির্বাচিত হয়ে সংসদে অনুপস্থিত থাকার মধ্যে, লোকজনের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে লোক সমাবেশের মাধ্যমে, যুব সমাজের মধ্যে ‘ধাওয়া দেওয়া’ চেতনা সৃষ্টি করার মধ্যে?
যুদ্ধাপরাধীর প্রশ্নে বিরোধী দলের অবস্থান নিয়ে একটি সংশয়কে উপড়ানোর জন্য এ যুক্তি দেওয়া যায় যে পাকিস্তান ভাঙার মূল কারণ ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাভিত্তিক আদর্শের ওপর রাজনৈতিক রাষ্ট্র যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না সেটা নিশ্চিত করা, এবং সে ভ্রষ্ট আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার তাগিদই ফুটে ওঠে, যদি যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে একটি বিনম্র অবস্থান নেওয়া হয়।
মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
১২ মার্চ সোমবার। রাজধানীতে একটি পরিপূর্ণ কার্যকালীন দিবস। কিন্তু লাখ লাখ লোক অতিরিক্ত জমা হলে ঢাকার জনজীবন ও কর্মজীবন চাপের মুখে পড়বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। শোনা যাচ্ছে, দেশের সব জেলা থেকে বিএনপির মোট ৪৫টি কমিটি লোক জড়ো করা আর নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করবে। ঢাকায় ৯ মার্চ থেকে লোক আনা হবে। বিরোধী জোটের অন্য শরিক দলগুলোও অনুরূপভাবে লোক জমায়েত করবে।
সরকারি দলও বসে নেই। প্রথমে তাদের ইচ্ছা ছিল সমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে বিরোধী দলের মুখোমুখি হওয়া। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কায় সেটা বাদ দিয়ে তারা সমাবেশের আগে-পিছে কর্মসূচি দিয়েছে, যার প্রথমটি হচ্ছে ৭ মার্চ উদ্যাপন করা, যে দিন ১৯৭১ সালে রেস কোর্সের সেই বিখ্যাত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটিকে উপলক্ষ করে সরকারি দল নিজেদের পক্ষেও একটি জনস্রোত তৈরি করতে চায়, যা বিরোধী দলের কাছে একটি বার্তা পৌঁছাবে।
তাহলে আগামী সপ্তাহ একটি সাংঘর্ষিক সময় পার করবে। কিন্তু জনগণের উদ্বেগের কারণগুলো নির্ণয় করা দরকার। সকালে প্রাতর্ভ্রমণে বের হয়ে রাস্তায় দুই ভিক্ষুকের মধ্যে ঝগড়া দেখলাম। একজন সম্পূর্ণ নুলো, আরেকজন সম্পূর্ণ অন্ধ। অন্ধ ভিক্ষুকটি রেগে নুলো ভিক্ষুককে বলছে, ‘আমি কি কখনো তোমার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম? অর্থাৎ, এক জায়গায় দাঁড়ালে তাদের পরস্পরের ভিক্ষার স্বার্থে আঘাত লাগে। জবাবে নুলো ভিক্ষুকটি কী বলেছিল, হাঁটার গতির কারণে শুনতে পাইনি। কিন্তু স্বার্থের হানাহানি যেমন ভিক্ষুকদের মধ্যে বিরোধের কারণ, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোও স্বার্থের হানাহানির কারণে দাঙ্গা বাধায়। কিন্তু সমস্যাটা হলো, ক্ষমতায় তো একটি দলই থাকবে, আর আরেকটি বা একাধিক দল ক্ষমতায় আসতে চাইবে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে উপাচার্য হবেন তো একজনই, যদিও অনেক অধ্যাপকের ওই পদটির জন্য খায়েশ থাকতে পারে। ক্ষমতাসীন দল এবং ক্ষমতায় যেতে চায় দলটির মধ্যে দড়িটানাটানির রেওয়াজ সব দেশেই আছে। এটি আমেরিকায় যেমন সত্য, বাংলাদেশেও। ভিক্ষুকবচসাসম ক্ষমতা নিয়ে এ কামড়াকামড়ির প্রেক্ষাপট তৈরি হয় বলে বহু আগে থেকে এ দার্শনিকতালব্ধ রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে প্রতি চার বা পাঁচ বছর মেয়াদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির একটা সুযোগ তৈরি হয়। এবং ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে পুনরাগমনের পর দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতার ভাগাভাগির ছকটি স্পষ্টতই ৫০-৫০ হয়েছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, আওয়ামী লীগ—এভাবে হয়েছে, মাঝখানে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অতি অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের কথা বাদ দিলে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে বেকায়দাভাবে পরাজিত হওয়ার পর, প্রধান বিরোধী দলের রাজনীতির অতিক্রমণ লক্ষ করলে বোঝা যাবে, আর যাই হোক সেখানে যুক্তির প্রাবল্য ছিল খুব কম। যদি ধরি সংসদ বর্জনের কথা, তাহলে এটির অনৈতিক দিকটি হচ্ছে, এক, বিরোধী দলের সাংসদেরা সব রকম পার্থিব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে, শুধু ৯০ কার্যদিবসের আইনি ক্ষীণসুতোর মতো শর্তটির সঙ্গে ঝুলে থেকে দিনের পর দিন সংসদ বর্জন করে চলেছেন। দুই. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তির আইনটি মহাজোট সরকার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাস করিয়ে নিলেও সেখানে যদি বিরোধী দল আলোচনায় অংশ নিত এবং তারপর হেরে যেত তাহলে নীতিগতভাবে এবং আইনিভাবে তাদের অবস্থান জাতির কাছে পরিষ্কার থাকত। যেমন ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনী পাস হওয়ার সময় সাংসদ জেনারেল ওসমানী এবং মইনুল হোসেন ভোট দানে বিরত ছিলেন। এর ফলে তাঁদের নীতিগত অবস্থান—সেটা যাই হোক না কেন, জাতির কাছে পরিষ্কার ছিল। সংসদের এ ধরনের রেওয়াজগুলো না মেনে রাস্তায় লোক জড়ো করানোর রাজনীতি বলা যাবে না যে সুবিবেচেনাকর কর্মসূচি হয়েছে। একবার তাঁরা ক্ষেপে উঠলেন বিরোধী দলের নেত্রীর আবাসন উচ্ছেদ প্রশ্নে। আরেকবার ক্ষেপে উঠলেন বিরোধী দলের নেত্রীর পুত্র দুজনের মুক্তি চেয়ে যাঁদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা বিচারাধীন আছে। ঠিক জাতীয় সংকট বলতে যেটা বোঝায়, যেমন দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিনা বিচারে হত্যা, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাধিক্য, ছাত্ররাজনীতিতে সন্ত্রাসনির্ভরতা, ভারতের সঙ্গে তিস্তা, টিপাইমুখসহ বহুবিধ সমস্যা, এগুলোর কোনোটাকে ইস্যু করে বিএনপি সংসদে কথা বলেনি। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথায় আসি। যদিও এটি বাংলাদেশে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং কারচুপিবিহীন ভোট প্রদানের একটি বাতাবরণ তৈরি করেছে, কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিছু অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, যেমন বয়সসীমা বাড়িয়ে নেওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে না পারা, এবং অপ্রতিষ্ঠিত অভিযোগের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের কারাগারে আটক করা। তার চেয়েও স্পষ্ট থাকে যে চাপা আশঙ্কাটি, সেটি হলো এটি অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখলের জন্য একটি দরজা খোলা রাখার ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়া।
অন্যদিকে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করার কৌশল বিএনপি নিতে চায় মনে হয়। যেমন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে সব দলের সঙ্গে আলোচনার একটি ব্যবস্থা করা হয়। এ ব্যাপারেও বিএনপির নেতিবাচক অবস্থান হতাশা তৈরি করেছে তাঁদের মধ্যে যাঁরা বিএনপির কাছে আরও যুক্তিনির্ভর রাজনীতি আশা করেন। শেষ পর্যন্ত নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিলে বিএনপি সঙ্গে সঙ্গে জানাল যে তারা এ নিয়োগ মানে না। এখন কথা হলো, আওয়ামী লীগ আর বিএনপি বাংলাদেশের জন্য শেষ কথা নয়, কোটি কোটি মানুষ আছেন যাঁরা দলমত-নির্বিশেষে ভালো যুক্তিশীল সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেবেন। শুধু দলীয় আবেগনির্ভর যুক্তিকে গোটা জাতির যুক্তি মনে করলে বেশ বড় রকমের ভুল হবে। আবার ইভিএম বা কম্পিউটারের মাধ্যমে ভোট প্রয়োগ একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৌশল। যে কটি নির্বাচনে এ পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে, সব জায়গায় এটি শতকরা শতভাগ সফল এবং কোনো পরাজিত প্রার্থীর কাছ থেকে এটার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। এ ইভিএমের ব্যাপারেও বিএনপির আপত্তি আছে দেখলাম। হয়তো বলা হবে, আমেরিকায় তো ইভিএম প্রচলিত নেই। তাহলে বলব, আমেরিকায় তো এভাবে সংসদ বর্জনের রেওয়াজ নেই, নেই লোক জড়ো করানোর হুমকি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেও আমেরিকায় কিছু নেই। আর কম্পিউটারপ্রযুক্তিকে অস্বীকার করলে ব্যাংক, বিমা, শিল্প, বিপণন, প্রচার কিছুই চলবে না।
এখন হয়তো উত্তেজনাবশত এ রকম ধারণা হতে পারে যে ১২ মার্চ ’ঢাকা চলো’ সমাবেশের আয়োজন করার অধিকার বিরোধী দলের শাসনতান্ত্রিক অধিকার, কিন্তু এর ফলে যদি অনিয়ন্ত্রণজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, শুরু হয় অবাঞ্ছিত গোলযোগ, হয় রক্তপাত, যা আইনশৃঙ্ক্ষলারক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নাও হতে পারে, সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অধিকার কিন্তু শাসনতন্ত্র ব্যক্তি, সমষ্টি, কিংবা রাজনৈতিক দল কাউকেই দেয়নি।
আমেরিকার শাসনতন্ত্রের প্রথম সংশোধনী, যেটাতে ‘বাক্-স্বাধীনতা’র আইনটি পাস হয় (১৭৯১), পরবর্তীকালে একটি মামলায় সে বাক্-স্বাধীনতার সীমানির্ধারণপূর্বক একটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়লে, তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস জুনিয়র বললেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো পরিস্থিতি ‘ক্লিয়ার অ্যান্ড প্রেজেন্ট ডেঞ্জার’ বা সুনিশ্চিতভাবে তাৎক্ষণিক বিপদের সৃষ্টি না করে ততক্ষণ পর্যন্ত বাক্-স্বাধীনতার প্রয়োগ চলবে। এখন বিরোধী দলকেই বুঝতে হবে, ১২ মার্চের ঢাকা চলো সমাবেশটি কোনো সুনিশ্চিতভাবে তাৎক্ষণিক বিপদের সৃষ্টি করছে কি না। যে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া শেষ পর্যন্ত বিরাধী দলের নেতাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে!
১২ মার্চের সমাবেশের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আমার উদ্বেগ খুব সামান্য। পত্রপত্রিকায় ছবি দেখলাম ১২ মার্চের সমাবেশের প্রস্তুতিপর্ব অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের বিরোধী দলের এক দল যুবক ছেলে আরেক দলকে লাঠিসোঁটা, দা-কিরিচ নিয়ে আক্রমণ করছে। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনগুলোরও এ ধরনের অনেক ছবি পত্রিকায় আসে আর আমরা হতাশায় নিমজ্জিত হই। এই যুবশক্তিই একদিন ক্ষমতায় আসবে, দেশ চালাবে, এদের যদি আমরা সুস্থ দায়িত্বশীল কর্মপরিচালনার মধ্যে না রাখি, তাহলে আমরা তো থাকব না, কিন্তু দেশটার যে লন্ডভন্ড অবস্থা হবে।
আমার মনে ছোট্ট একটা প্রশ্ন, যেটার উত্তর আমি প্রায়ই পাই না, সেটা হলো সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সামাজিক দায়িত্বশীলতার কি কোনো সম্পর্ক নেই? থাকলে সেটি কোথায়? নির্বাচিত হয়ে সংসদে অনুপস্থিত থাকার মধ্যে, লোকজনের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে লোক সমাবেশের মাধ্যমে, যুব সমাজের মধ্যে ‘ধাওয়া দেওয়া’ চেতনা সৃষ্টি করার মধ্যে?
যুদ্ধাপরাধীর প্রশ্নে বিরোধী দলের অবস্থান নিয়ে একটি সংশয়কে উপড়ানোর জন্য এ যুক্তি দেওয়া যায় যে পাকিস্তান ভাঙার মূল কারণ ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাভিত্তিক আদর্শের ওপর রাজনৈতিক রাষ্ট্র যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না সেটা নিশ্চিত করা, এবং সে ভ্রষ্ট আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার তাগিদই ফুটে ওঠে, যদি যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে একটি বিনম্র অবস্থান নেওয়া হয়।
মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
No comments