সমাজ-নারী আন্দোলন ও নতুন প্রজন্ম by চ

দু'দশক ধরে দুই নারীর নেতৃত্বে আমাদের দেশ শাসিত হচ্ছে এবং রাজনীতিতে সামান্য পরিমাণে হলেও নারীদের উপস্থিতি বেড়েছে। তবে বিদ্যমান শোষণ ও অপশাসন নির্মূলে তারা আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন কি-না সেটাই বিবেচ্য।
জনগণের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের কোনো বিকল্প অন্বেষণের চেষ্টা এ নারী রাজনীতিবিদদের মাঝে আছে কি-না সেটা প্রকৃতই অস্পষ্ট


১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। সে সূত্রে এ বছর তার জন্মশতবর্ষ। প্রীতিলতা বাংলাদেশের প্রথম নারী শহীদ। এ দেশের নারী আন্দোলনের অনন্য এক প্রেরণার উৎস তিনি। কিন্তু প্রীতিলতার জন্মশতবর্ষে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম ছাড়া প্রধান কোনো নারী সংগঠন গুরুত্বের সঙ্গে তাকে স্মরণ করছে বলে দেখা যায়নি।
নারী আন্দোলন কর্মী ও নারী রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য প্রীতিলতার জীবন বহুভাবে শিক্ষণীয়। মাত্র ২১ বছরের জীবনে পেশাগত কর্মপ্রয়াস ও দেশ-ভাবনার অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন তিনি। সেকালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। পরবর্তী অধ্যায়ে ইডেন কলেজ এবং কলকাতার বেথুন কলেজেও ছাত্রী হিসেবে ছিলেন মেধাবী ও অনন্য। সচেতন মানুষের কাছে সমাজ ও দেশের যে চাহিদা থাকে তা থেকেও মুখ ফিরিয়ে রাখেননি তিনি।
প্রীতিলতার সময়ে পুরো দেশ ছিল উপনিবেশ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যে মানুষের ব্যক্তিত্ব, মানবিক গুণাবলি এবং মনুষ্যত্ব বিকশিত হয় সে সত্য জানতেন তিনি। ফলে শিক্ষাবিদ জীবনের মধ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত কর্তব্য বোধের সঙ্গে স্বাধীনতা বোধ এবং একই সঙ্গে নারী হিসেবে সমমর্যাদার বোধ প্রীতিলতাকে বাংলার অনন্য এক সংগ্রামী ঐতিহ্যে পরিণত করে।
ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রীতিলতার আগ্রহ ও অন্তর্ভুক্তি বিপল্গবীদের কাছে ছিল বিস্ময়, ব্রিটিশদের কাছে ছিল হতবাক করার মতো। তখন 'পিছিয়ে থাকা' পূর্ববঙ্গে নারী অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে নামবে এমনটি ছিল অভাবনীয়। কিন্তু প্রীতিলতা মনে করতেন, নারী কোনোভাবে দেশ ভাবনায় পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে থাকতে পারে না, এমনকি দেশের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামেও নয়।
যে কোনো তুলনাই হাস্যকর। কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রশ্নে প্রীতিলতার অভিজ্ঞতা ও অবস্থান তাকে বেগম রোকেয়াসহ অন্য সব প্রধান বাঙালি নারী চরিত্রের মধ্যেও অগ্রসর করে তোলে। প্রীতিলতা স্পষ্টতই মনে করতেন, সমাজে নারীর ভূমিকা পুরুষদের মতোই প্রধানত রাজনৈতিক, বিশেষত দেশ যখন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও লুণ্ঠনের শিকার। তার মতে, 'নারীর উচিত এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া যে, সে আর পিছিয়ে থাকবে না এবং সংগ্রাম যত কঠিনই হোক, ভাইদের পাশাপাশি তাতে শামিল হবে সেও।'
প্রীতিলতার সময়ে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল বিপল্গবী সংগঠনগুলোর তরফ থেকেও। কিন্তু তার দৃঢ়তা সেই নিষেধের দেয়াল ভেঙেছে। শুধু তাই নয়, ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে তাকেই নেতত্বদানের জন্য নির্বাচিত করা হয়। দুঃসাহসিক এ অভিযানে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে ফিরে আসার পথে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। আহত অবস্থায় তাকে যাতে ব্রিটিশ বাহিনী জীবিত ধরতে না পারে সে জন্য তিনি সায়ানাইড বিষ পানে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ যখন প্রীতিলতার দেহ খুঁজে পায়, একজন নারীকে আক্রমণকারী হিসেবে শনাক্ত করে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল তারা।
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এরূপ এক কিংবদন্তি ব্যক্তির জীবন ও কর্মের প্রচার নিশ্চিতভাবে আজকের বাংলাদেশে বৈষম্যতাড়িত জীবন-যাপনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে নারীদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করবে। কিন্তু কোথায় নারী আন্দোলনের সেই উপলব্ধি?
সরকারেরও এ ক্ষেত্রে করণীয় রয়েছে। চট্টগ্রামে প্রীতিলতার স্মৃতিচিহ্নগুলো রক্ষায় স্থানীয়ভাবে হাজার হাজার মানুষ যে যৌক্তিক দাবি তুলেছে সরকারের উচিত তাতে সহযোগিতার হাত বাড়ানো। বিশেষ করে সেদিনকার ইউরোপীয় ক্লাব, যা আজকে রেলওয়ের বিভাগীয় অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তাকে প্রীতিলতা জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা এবং সেখানে ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামীদের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে পারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। চট্টগ্রামের নতুন মেয়রও এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে পারেন বৈকি। এ ধরনের জাদুঘর ও প্রীতিলতার ভাস্কর্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিচয়কে আরও দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলবে। চট্টগ্রামের মর্যাদা বাড়াবে।
তবে এও বিবেচনায় রাখতে হবে, শাসক শ্রেণী বরাবর প্রীতিলতার মতো সংগ্রামী চরিত্রকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে_ নিদেনপক্ষে পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে আড়াল করতে চেষ্টা করে। সচেতন মানুষের কাজ নীরবতার সেই ষড়যন্ত্র ভেঙে ইতিহাস থেকে ভাবসম্পদ ও নেতৃত্বকে খুঁজে নেওয়া। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন সে ক্ষেত্রে ব্যর্থ বলা যায়। প্রীতিলতার জন্মশতবর্ষকে কাজে লাগানো উচিত ছিল নতুন প্রজন্মের তরুণীদের কাছে তাকে ব্যাপকভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।
দু'দশক ধরে দুই নারীর নেতৃত্বে আমাদের দেশ শাসিত হচ্ছে এবং রাজনীতিতেও সামান্য পরিমাণে হলেও নারীদের উপস্থিতি বেড়েছে। তবে বিদ্যমান শোষণ ও অপশাসন নির্মূলে তারা আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন কি-না সেটাই বিবেচ্য। জনগণের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের কোনো বিকল্প অন্বেষণের চেষ্টা এ নারী রাজনীতিবিদদের মাঝে আছে কি-না সেটা প্রকৃতই অস্পষ্ট।
অন্যদিকে নারী সংগঠনগুলোও গতানুগতিকায় আবদ্ধ। স্বাভাবিকভাবে এরূপ নারী নেতৃত্ব এবং নারী সংগঠনগুলো শিক্ষিত তরুণীদের এখন আর আকর্ষণ করতে পারছে না। এমনকি নারী কেন রাজনীতি করবে কিংবা দেশের জন্য কাজ করবে, তারও কোনো স্পষ্ট দিশা দেখাতে পারে না বিদ্যমান নারী সংগঠনগুলো। আমাদের নারী আন্দোলনের ইতিহাসেও এরূপ চরিত্র খুবই অল্প যারা নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম। প্রীতিলতা এ ক্ষেত্রে অনন্য এক ব্যতিক্রম। সে সঙ্গে রাজনীতিতাড়িত এবং প্রচণ্ড গতিময় তার জীবনের ভঙ্গি। আজকের বাংলাদেশে তরুণীদের বিজ্ঞাপনী ভোগ-বিলাসের চক্কর থেকে সুস্থ ভবিষ্যতের দিকে চালিত করতে পারে প্রীতিলতার ইতিহাস। নানাভাবে এখনও বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি সংগ্রামে নিপতিত। সেখানে প্রীতিলতার মতো ব্যক্তিরা হতে পারেন তরুণ প্রজন্মের মডেল। কীভাবে ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্বময় এক জীবন দখল করা যায় এবং একই সঙ্গে তা সবার মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া যায় তারই নজির রেখে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের এই অগি্নকন্যা।
জন্মশতবর্ষে প্রীতিলতাকে অভিবাদন। প্রীতিলতা জাদুঘরের দাবিতে সোচ্চার চট্টগ্রামবাসীকেও অভিবাদন।

আলতাফ পারভেজ : লেখক ও গবেষক
altafparvez@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.