চারদিক-মন ভালো নেই কবির by কাজল রশীদ
ভালো থেকো’—কথাটা খুব জোর দিয়ে বললেন কবি। জন্মদিনে নিজের নয়, অন্যের ভাবনায়, শুভ কামনায় উন্মুখ তিনি। অথচ একা একা চলতে পারেন না। সব কথা সব সময় বুঝে উঠতে পারেন না। ঘড়ির কাঁটা ধরে ঘুমোতে যান, ওঠেন।
সবকিছুই নিয়মের সুতায় বাঁধা। এমনকি খাবার গ্রহণ পর্যন্ত মেপে মেপে। কবি আবুল হোসেনের ধানমন্ডির ‘সাহানা’ বাসায় আমরা যখন পৌঁছাই, তখন ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছুঁইছুঁই। আমাদের জানানো হলো, কবি ছয়টায় ঘুম থেকে উঠবেন।
আবুল হোসেন, আমাদের প্রিয় এই ভূখণ্ডের জ্যেষ্ঠ কবি। ৭০ বছর ধরে লিখছেন। জীবনে নানা বাঁক বদল হয়েছে, কিন্তু কখনো কবিতা থেকে দূরে সরে থাকেননি। মেধা ও মনন, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতায় তিনি মহীরুহ, ঋষিতুল্য এক আলোকিত মানুষ।
আবুল হোসেনের বসার ঘরের দেয়াল যশস্বী সব চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্মে ঠাসা। মোহাম্মদ কিবরিয়া, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন প্রমুখ শিল্পীর রং ও রেখার কাজ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বদ্বীপ ভূমির মানুষকে কবিতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, আবুল হোসেন তাঁদের অন্যতম। শুধু মৌলিক লেখালেখি নয়, অনুবাদকর্মও করেছেন। পেশাজীবন কেটেছে সরকারি চাকরিতে বড় কর্মকর্তা হিসেবে। কবিতা, গল্প, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনিসহ ছোটদের জন্যও তাঁর লেখালেখির জগৎ বিস্তৃত। দীর্ঘ সময় লেখালেখি করলেও অতিপ্রজ লেখকের তকমা লাগাননি। পরিমিতির সৌন্দর্যে ও ব্যক্তিত্বের রুচিতে নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্র এক কাব্যভাষা ও আঙ্গিক; যা ভাবালুতায় আক্রান্ত নয়, আবেগের সাহসে দীপ্যমান। আবুল হোসেন প্রাতিস্বিক না হয়েও নিজস্বতায় অনন্য। বহু বিপ্রতীপ পথের পর্যটন অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছে স্বর্ণশস্য ফলানোর মৌল উপাদান ও উপকরণ।
দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় সফেদ পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে মাথাভর্তি শিমুল তুলার মতো চুল নিয়ে কবি এলেন। তাঁর আগমনে মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের অমৃতমোহন সংগীত: ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো। ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো\’ কবি জাফর আহমদ রাশেদ হাত বাড়িয়ে জানালেন জন্মদিনের শুভেচ্ছা। প্রথমে ঠিক বুঝলেন না, তারপর সামলে নিয়ে শিশুর মতো সরল এক হাসি দিলেন। সে হাসির হয়তো অর্থ আছে, কিংবা নেই। কথা হলো আলীম ভাই ও আমার সঙ্গে। আমরা বললাম, ‘আপনার আগামী জন্মদিন ঘটা করে পালন করতে চাই।’ বললাম, ‘কখনো ভাব এলে লিখে ফেলবেন। না হলে মুখে মুখে বলবেন, অন্যরা লিখবে। এক লাইন, দুই লাইন, যা হবে তা-ই অনেক বেশি মূল্যবান।’ সব শুনে সেই একই হাসি হাসেন, যেন ৯০ বছরের এক শিশু হাসছে।
অফিসে ফিরতে হবে। তাই বিদায়। দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমরা যাব, আপনি ভালো থাকুন।’ হাত ধরে তিনি বললেন, ‘ভালো থাকো।’ একবার নয়, বারবার। এবার যেন শিশুটি হয়ে উঠল পরিণত এক মানুষ। তিনি ভালো থাকো কথাটা এমনভাবে বললেন, যেন ভালো থাকাটা অসম্ভব দুরূহ এক বিষয়; যার জন্য লড়াই করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে প্রতিক্ষণ। কবিরা অন্তর্যামী হন, আবুল হোসেনের কথায় এই সত্যই উচ্চারিত হলো। জন্মদিনে ভালো থাকার জন্য, দেশের মঙ্গল কামনায় করুণ আর্তি ঝরল কবির কণ্ঠ থেকে।
৯০-এ পা দিয়ে এভাবেই বেদনার্ত হলেন কবি আবুল হোসেন। ১৫ আগস্ট ছিল তাঁর জন্মদিন। ১৯২১ সালে জন্ম নেওয়া এই কবি নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন ত্রিকাল। ব্যক্তিগতভাবে জেনেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ দাশকে। আমাদের প্রথম আধুনিক কবি তিনি। আমাদের প্রথম আধুনিক কবিতার বই তাঁর নববসন্ত (১৯৪০)। তারপর প্রকাশিত হয় ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৫) ও আহসান হাবীবের রাত্রিশেষ (১৯৪৭)। কবিতার ঘর-গেরস্থালিতে তিনি সফল কৃষকের প্রতিভূ। ব্যক্তিজীবনও একই সমান্তরালে অঙ্কিত।
কবির জন্মদিনের মাত্র এক দিন আগে নির্মম এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীর। আমাদের এই শহর, এই দেশ দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ক্রমেই লুপ্ত হচ্ছে ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে সবকিছু। সোনার পাথর বাটির ন্যায় অসম্ভব পাথেয় হচ্ছে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশা।
কবির কণ্ঠে রূঢ় এই বাস্তবতার প্রতিধ্বনি। জন্মদিনে তিনি জানালেন, গত এক বছর কিছুই লেখেননি। তাঁর ভাষায় লেখা আসেনি। দৃষ্টিক্ষমতা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। শ্রবণও তা-ই। তার পরও চেতনশক্তি, অন্তর্গত অনুভব এখনো প্রখর। ফিরতে ফিরতে মনে হলো, কবির মন ভালো নেই। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নেই যে দেশে, সে দেশে একজন কবির মন ভালো থাকে কী করে?
কাজল রশীদ
kazalrashid@yahoo.com
আবুল হোসেন, আমাদের প্রিয় এই ভূখণ্ডের জ্যেষ্ঠ কবি। ৭০ বছর ধরে লিখছেন। জীবনে নানা বাঁক বদল হয়েছে, কিন্তু কখনো কবিতা থেকে দূরে সরে থাকেননি। মেধা ও মনন, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতায় তিনি মহীরুহ, ঋষিতুল্য এক আলোকিত মানুষ।
আবুল হোসেনের বসার ঘরের দেয়াল যশস্বী সব চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্মে ঠাসা। মোহাম্মদ কিবরিয়া, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন প্রমুখ শিল্পীর রং ও রেখার কাজ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বদ্বীপ ভূমির মানুষকে কবিতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, আবুল হোসেন তাঁদের অন্যতম। শুধু মৌলিক লেখালেখি নয়, অনুবাদকর্মও করেছেন। পেশাজীবন কেটেছে সরকারি চাকরিতে বড় কর্মকর্তা হিসেবে। কবিতা, গল্প, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনিসহ ছোটদের জন্যও তাঁর লেখালেখির জগৎ বিস্তৃত। দীর্ঘ সময় লেখালেখি করলেও অতিপ্রজ লেখকের তকমা লাগাননি। পরিমিতির সৌন্দর্যে ও ব্যক্তিত্বের রুচিতে নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্র এক কাব্যভাষা ও আঙ্গিক; যা ভাবালুতায় আক্রান্ত নয়, আবেগের সাহসে দীপ্যমান। আবুল হোসেন প্রাতিস্বিক না হয়েও নিজস্বতায় অনন্য। বহু বিপ্রতীপ পথের পর্যটন অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছে স্বর্ণশস্য ফলানোর মৌল উপাদান ও উপকরণ।
দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় সফেদ পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে মাথাভর্তি শিমুল তুলার মতো চুল নিয়ে কবি এলেন। তাঁর আগমনে মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের অমৃতমোহন সংগীত: ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো। ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো\’ কবি জাফর আহমদ রাশেদ হাত বাড়িয়ে জানালেন জন্মদিনের শুভেচ্ছা। প্রথমে ঠিক বুঝলেন না, তারপর সামলে নিয়ে শিশুর মতো সরল এক হাসি দিলেন। সে হাসির হয়তো অর্থ আছে, কিংবা নেই। কথা হলো আলীম ভাই ও আমার সঙ্গে। আমরা বললাম, ‘আপনার আগামী জন্মদিন ঘটা করে পালন করতে চাই।’ বললাম, ‘কখনো ভাব এলে লিখে ফেলবেন। না হলে মুখে মুখে বলবেন, অন্যরা লিখবে। এক লাইন, দুই লাইন, যা হবে তা-ই অনেক বেশি মূল্যবান।’ সব শুনে সেই একই হাসি হাসেন, যেন ৯০ বছরের এক শিশু হাসছে।
অফিসে ফিরতে হবে। তাই বিদায়। দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমরা যাব, আপনি ভালো থাকুন।’ হাত ধরে তিনি বললেন, ‘ভালো থাকো।’ একবার নয়, বারবার। এবার যেন শিশুটি হয়ে উঠল পরিণত এক মানুষ। তিনি ভালো থাকো কথাটা এমনভাবে বললেন, যেন ভালো থাকাটা অসম্ভব দুরূহ এক বিষয়; যার জন্য লড়াই করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে প্রতিক্ষণ। কবিরা অন্তর্যামী হন, আবুল হোসেনের কথায় এই সত্যই উচ্চারিত হলো। জন্মদিনে ভালো থাকার জন্য, দেশের মঙ্গল কামনায় করুণ আর্তি ঝরল কবির কণ্ঠ থেকে।
৯০-এ পা দিয়ে এভাবেই বেদনার্ত হলেন কবি আবুল হোসেন। ১৫ আগস্ট ছিল তাঁর জন্মদিন। ১৯২১ সালে জন্ম নেওয়া এই কবি নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন ত্রিকাল। ব্যক্তিগতভাবে জেনেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ দাশকে। আমাদের প্রথম আধুনিক কবি তিনি। আমাদের প্রথম আধুনিক কবিতার বই তাঁর নববসন্ত (১৯৪০)। তারপর প্রকাশিত হয় ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৫) ও আহসান হাবীবের রাত্রিশেষ (১৯৪৭)। কবিতার ঘর-গেরস্থালিতে তিনি সফল কৃষকের প্রতিভূ। ব্যক্তিজীবনও একই সমান্তরালে অঙ্কিত।
কবির জন্মদিনের মাত্র এক দিন আগে নির্মম এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীর। আমাদের এই শহর, এই দেশ দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ক্রমেই লুপ্ত হচ্ছে ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে সবকিছু। সোনার পাথর বাটির ন্যায় অসম্ভব পাথেয় হচ্ছে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশা।
কবির কণ্ঠে রূঢ় এই বাস্তবতার প্রতিধ্বনি। জন্মদিনে তিনি জানালেন, গত এক বছর কিছুই লেখেননি। তাঁর ভাষায় লেখা আসেনি। দৃষ্টিক্ষমতা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। শ্রবণও তা-ই। তার পরও চেতনশক্তি, অন্তর্গত অনুভব এখনো প্রখর। ফিরতে ফিরতে মনে হলো, কবির মন ভালো নেই। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নেই যে দেশে, সে দেশে একজন কবির মন ভালো থাকে কী করে?
কাজল রশীদ
kazalrashid@yahoo.com
No comments