চারদিক-শিশুদের রঙিন ভুবনে এক দিন by জাহিদ মুস্তাফা

‘আজ যে শিশু/ পৃথিবীর আলোয় এসেছে/ তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।’ বেশ কয়েক বছর আগে সম্ভবত নকীব খানের বাণী ও সুরে বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী কলিম শরাফীর ভরাট কণ্ঠে শুনেছিলাম অপূর্ব এ গানটি। অসামান্য এক গায়নভঙ্গিতে তিনি গেয়েছিলেন আগামী প্রজন্মের প্রতি অগ্রজ প্রজন্মের কর্তব্য পালনের অঙ্গীকারযুক্ত এ গান।


শিশুর প্রতি এ অঙ্গীকারের ছোঁয়া পাওয়া গেল ঢাকার উত্তরায় রঙিন ভুবনে। শিশুর ভুবনে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে এক বছর আগে যাত্রা শুরু করেছে শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠানটি।
আগামী প্রজন্মের উন্নত বিকাশের স্বপ্ন থেকে এটি গড়ে তুলেছেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক ফরিদা জামান।
তাঁর সহ-উদ্যোক্তারা হলেন শিক্ষক ফাতেমা আখতার, শিতুমা জামান ও ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান চৌধুরী! উত্তরার সেক্টর-৯, সড়ক-১০-এর ৩ নম্বর বাড়ির একতলা ও দোতলার দুটি ফ্লোরে তাঁরা গড়ে তুলেছেন ‘রঙিন ভুবন’। একতলায় শিশুদের প্রিস্কুল ও দিবাযত্নকেন্দ্র, দোতলায় চিত্রাঙ্কন বিভাগ।
পরিকল্পনা যত সুন্দরই হোক, তার পেছনে যদি একজন সৃজনশিল্পীর হাত থাকে, তবে সেটি হয়ে ওঠে যথার্থ সুন্দর আর দৃষ্টিনন্দন।
রঙিন ভুবনের আসবাব থেকে শুরু হয়ে শিশুদের খেলাঘরের সবটাতেই সুরুচির ছাপ। শিশুদের পছন্দের রঙে রাঙানো সবকিছু। পড়া কিংবা ছবি আঁকার গোল টেবিলগুলোর পাশে বসে কিংবা কার্পেটে আধশোয়া হয়ে শিশুরা আঁকিবুঁকি করছে, কেউ কেউ লোগো দিয়ে নানা কিছু তৈরি করছে, স্লিপারে খেলছে—
অসামান্য এ দৃশ্যটি দেখতে কার না ভালো লাগে!
আমাদের শৈশব কেটেছে মাঠে-ঘাটে-বনে-বাদাড়ের মুক্তজীবনে। পেশাগত প্রয়োজনে আজ আমরা নগরবাসী হওয়ায় আমাদের সন্তানেরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বাড়ি, বিদ্যালয়ের চারদেয়াল আর সামান্য চৌহদ্দিতেই তাদের দিন যাপন করতে হচ্ছে। এই শিশুদের নির্মল বিনোদন ও খেলাধুলার পরিবেশ ছেড়ে দিতে হবে আমাদেরই।
কর্মব্যস্ত মা-বাবার সময় নেই নিজের শিশুসন্তানকে সব সময় আগলে রাখার। নির্ভর করতে হয় বাড়ির দৈনন্দিন কাজে সহায়তার জন্য নিয়োগকৃত মানুষের ওপর।
সাময়িক প্রয়োজন হয়তো মেটে, তবে সন্তানের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। কর্মব্যস্ত মা-বাবার শিশুসন্তানের জন্য আনন্দদায়ক এক প্রতিষ্ঠান রঙিন ভুবন। এর স্কুলপূর্ব শিশুযত্নকেন্দ্র দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য।
এখানে শিশুরা থাকে নিরাপদে, তারা হেসেখেলে পড়ে, মজা করে। শিশুদের কলকাকলিমুখর পরিবেশটি আরও মধুর হয়ে ওঠে বিশিষ্টজনদের আগমনে।
যেমন গত বাংলা নববর্ষ ১৪১৮ পালন উপলক্ষে রঙিন ভুবনের শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে এসেছিলেন বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান ও সুবীর চৌধুরী। গত জানুয়ারিতে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে এসেছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা ও শিল্পী বিপাশা হায়াত। রঙিন ভুবনের ছবি আঁকার ক্লাসে একসঙ্গে পেয়ে গেলাম অনেক শিশু শিল্পীকে। চার থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোররা নানা ক্লাসে ভাগ হয়ে এখানে আঁকতে শেখে। শিশুদের মধ্যে সৃজনশীল মনোভাব তৈরি ও সৌন্দর্যবোধ জাগিয়ে তুলতে ছবি আঁকা শেখার বিকল্প নেই। ওদের শ্রেণীকক্ষে গিয়ে দেখলাম, সেটি বেশ সাজানো-গোছানো, পরিপাটি। কার্পেটের ওপর বসে মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকছে নাফিসা, রুকাইয়া, শওকাত, মায়মুনা, শর্মি, অদ্রি, অন্তরা, আদিভা, আবরার ও রায়হানরা।
শিশু আঁকিয়েদের আঁকা ছবিগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে চারপাশে। কত কী ভাবনা আর বিষয় সেসব ছবিতে—দেখে মজাই লাগে, অবাকও হই!
আরও মজা পেলাম শিল্পী ফরিদা জামানকে বিশেষ ক্লাস নিতে দেখে। চারুকলায় তিনি আমাদের গুণী শিক্ষক সেই আশির দশকে। মাঝেমধ্যেই তিনি শিশুদের প্রতি মমতার টানে ছুটে যান রঙিন ভুবনে। তিনি এখনো শিশুদের সঙ্গে একত্রে বসে কথা বলছেন, ওদের মনের ভাব বুঝে ওদের আঁকা দেখছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন—এটি একটি ঘটনা বটে!
সঙ্গে থাকা আমার শিশুকন্যাটি মজার এই পরিবেশ পেয়ে ছবি আঁকতে বসে গেল! শিশুবান্ধব এই খ্যাতিমান শিল্পী কথা প্রসঙ্গে মূল্যবান একটি কথা বললেন, ‘ওদের দিকে তাকালে আমি যেন নিজের শৈশবকে আবিষ্কার করি এবং একই সঙ্গে অনুভব করি আমাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে। ওদের ভবিষ্যৎ সুন্দর হলে বাংলাদেশটাও ভালো থাকবে। আগামী প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ ও কল্যাণচিন্তা থেকেই গড়ে উঠেছে রঙিন ভুবন। শিশুকল্যাণে এমন প্রতিষ্ঠান যত বেশি গড়ে উঠবে ততই মঙ্গল!’

 জাহিদ মুস্তাফা

No comments

Powered by Blogger.