আত্মহত্যা-সুমির মৃত্যুর দায় কারও নয়?

মার্জিয়া জান্নাত সুমি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। এখন সে কেবলই অতীত। কারণ, ৬ আগস্ট সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। যে ক্যাম্পাসকে ভালোবেসে সর্বক্ষণ সে প্রাণোচ্ছল থেকেছে, যে শিক্ষায়তনে নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখেছে, সেখানেই সে শেষ করে দিল তার জীবন। মা-বাবার স্নেহ-মমতা, বন্ধুদের


ভালোবাসা—কোনো কিছুই তাকে আত্মহননের পথ থেকে ফেরাতে পারল না। এ কি তার শুধুই অভিমান করে চলে যাওয়া, নাকি নিজের জীবন তুচ্ছ করে জানিয়ে যাওয়া নির্মম প্রতিবাদ? যে সমাজে একজন নারী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাল্যবিবাহের করুণ পরিণতির শিকার হয়, পরিস্থিতির শিকার হয়ে একবার ‘কবুল’ বললেই হয়ে যায় অশুচি এবং শিক্ষার সর্বোচ্চ অঙ্গনেও সেই অশুচি দূর হয় না, সে সমাজের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধেই বোধ করি সুমির এই প্রতিবাদ।
২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সুমি। সম্প্রতি সে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছে। অনার্সে প্রথম স্থান অধিকারী সুমি ছিল একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের অসংখ্য নারীর মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই অপরিণত বয়সে মা-বাবার ইচ্ছায় খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় তার এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিচ্ছেদও ঘটে। তখন থেকে শুরু হয় সুমির নতুন জীবন গড়ে তোলার সংগ্রাম। সমাজের সব বাধাকে চ্যালেঞ্জ করে সুমি এগিয়ে যেতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া ছিল তার স্বপ্ন। প্রথম থেকেই তাই গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। ফলে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে। দীর্ঘ পাঁচ বছর নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সুমির যখন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার ও তার বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণের সময়, তখনই কেন তার এই আত্মহনন? যে দৃঢ় মনোবলের সুমি সব বাধা অতিক্রম করে নিজেকে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল, কেন সে এই সমাজে বেঁচে থাকার প্রেরণা হারিয়ে ফেলল? আমরা কেন হারালাম একজন মেধাবী সুমিকে? কারা তাকে এই আত্মহননে প্ররোচিত করল? এই মেধাবী জীবনটির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের, সমাজের এবং আমাদের কি কোনো দায়িত্ব ছিল না?
সুমির বিভাগের শিক্ষার্থী ঘটনাটি বর্ণনা করেন এভাবে: ‘বিভাগ থেকে পৌঁছাতেই শুনতে পাই জাহানারা ইমাম হলে ইতিহাস বিভাগের সুমি নামের একজন মারা গেছে। দৌড়ে সুমির রুমের দিকে যাই। গিয়ে দেখি সবাই চিৎকার করে কাঁদছে। কারণ, দরজা খোলার পরও প্রায় ১৫ মিনিট সুমি ঝুলন্ত অবস্থাতেই ছিল। এ ক্ষেত্রে হল সুপারদ্বয় ভয়ে স্থান ত্যাগ করেছেন এবং হলের কর্মচারীরা শতভাগ আনুগত্যের পরিচয় দিয়ে বলেছে, প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া তারা সুমিকে নামাতে পারবে না। অথচ সুমির দেহে তখনো প্রাণ ছিল। নিরুপায় হয়ে ওর বন্ধুরাই গলার ওড়না কেটে সুমিকে নিচে নামায়। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স কোথায়, তা নিয়ে পুনরায় চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। অবশেষে অ্যাম্বুলেন্স আসে, তবে তাতে কোনো অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছিল না, হুইসেলও বাজছিল না। এমন এক বাহনে চড়ে আমরা সুমিকে বাঁচাতে এনাম মেডিকেলের উদ্দেশে রওনা করি। দীর্ঘ প্রায় ২০ মিনিট পর এই শ্বাসরুদ্ধকর অ্যাম্বুলেন্স এনামে পৌঁছায়। সেখানে কর্মরত চিকিৎসক তার মৃত্যু ঘোষণা করেন।’
ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সুমি বিভাগেই ছিল। হয়তো বা ওর কথাগুলো কারও সঙ্গে সে বলতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। অতঃপর আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এত মেধাবী, অসাধারণ দৃঢ় একটি মেয়ে কেন আত্মহননের পথ বেছে নিল, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসিন্দা হিসেবে আমাদের অবশ্যই একটা বোধগম্য ব্যাখ্যা পেতে হবে। একজন মানুষের একান্ত হতাশা-বেদনার খোঁজ আমাদের পক্ষে নেওয়া অবশ্যই সম্ভব নয়, কিন্তু যদি কাঠামোগতভাবে কোনো মানুষ কোণঠাসা হয়ে পড়ে, একাকী বোধ করে, তার হিসাব নিশ্চয়ই আলাদা। আমরা প্রায়ই এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে নারাজ থাকি, তাতে সম্মানহানি ঘটে বলে আমাদের অনেকে মনে করেন। ঠিক যেমন রুমানার পরিবার তাঁর সম্মানহানি করতে চায়নি, আর এ জন্য রুমানাকে হারাতে হয়েছে তাঁর দুটি অমূল্য চোখ।
মেয়েটির এই বিস্ময়কর আত্মহত্যার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবশ্যই তদন্ত করতে হবে বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি, ‘ভাবমূর্তি’ বলে যদি কিছু থাকে, তবে তা এসব উদ্যোগেই সমুন্নত হয়, অপরাধী কিংবা পারিপার্শ্বিক কারণকে আড়াল করতে চাইলে নয়। দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে কেন অক্সিজেন থাকে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল এমন জরাজীর্ণ কেন? বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুললে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, নাকি ২০ মিনিট পথ পাড়ি দিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে যেতে যেতে কেউ মারা গেলে? হলসুপার ও কর্মচারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আমাদের লজ্জিত করে, নাকি শিক্ষার্থীদের চিৎকার? দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে কেন শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা নেই? এ প্রশ্নগুলো সবারই পর্যালোচনা করা দরকার। আমরা মনে করি, প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতি সুমির মৃত্যুকে সহজ ও অবশ্যম্ভাবী করেছে।
সুমির সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সম্পর্কের কথা অনেকেই জানত। জানা গেছে, সুমির সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা চূড়ান্ত হয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগেই। কিন্তু সম্প্রতি তিনি বিয়েতে অপারগতা প্রকাশ করলে সুমি নিজেকে অসহায় বা বিপর্যস্ত বোধ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ কি নিছক কোনো ভাবালু অভিমান থেকে আত্মহত্যা? নাকি বারবার সম্পর্ক ভাঙা মেয়ের জীবনে স্টিগমা নিয়ে বেঁচে থাকার দুরূহতা তাকে পরাস্ত করল? নাকি একটা সুন্দর-স্বাভাবিক জীবনের তিরোহিত সম্ভাবনার বিচ্ছেদি ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করল? সংবেদনশীল মানুষের এসব না ভেবে উপায় নেই। জীবনের প্রতি আমরা কেমন করে এতটা দায়দায়িত্বহীন হতে পারি? মেয়েরা যখন ক্রমাগতভাবে পীড়িত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, তখন তাকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত বিষয় বলে দেখা যায় না। আর এতে নীরবতাও কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া এসব দুর্ঘটনা রোধ করার দায়িত্ব আমরা কেউ এড়াতে পারি না।
ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আত্মহত্যার প্ররোচনা সুস্পষ্ট একটি অপরাধ। আমরা আশা করব, যদি কেউ সুমিকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে থাকে, তদন্ত কমিটির সুষ্ঠু তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। আর প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে সুশীল সমাজকে সচেতন থাকার আহ্বান জানাই।
লেখকেরা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.