ক্লাসঘরের কথা-দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

(পূর্বপ্রকাশের পর) ৫ আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠল সে। আচমকা কোনো অশুভ দানবকে সামনে দেখলে মানুষ যেমন করে ওঠে তেমনি মরিয়া আর হিংস্র হয়ে ঘুরে দাঁড়াল সান্তিয়াগো। যেভাবেই হোক একে শেষ করতে হবে। অনেক কষ্টের দামে কেনা, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদকে সে কিছুতেই ওই জলজ দানবের আক্রমণের কাছে বেহাত হতে দেবে না।


শরীরের পুরো শক্তি একখানে করে হাঙরটার দিকে হারপুন ছুড়ে মারল সান্তিয়াগো। বেপরোয়া আঘাতে খারাপভাবে জখম হলো হাঙরটা। কিছুক্ষণ মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করে হারপুনসহ তলিয়ে গেল পানির নিচে। হাঁফ ছাড়ল সে। জীবনের শ্রেষ্ঠ পতাকাটিকে বাঁচাতে পেরেছে তাহলে! কিন্তু বেশিক্ষণ গেল না। সে দেখল নৌকার পেছনে এবার নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে একটি নয়, দু-দুটি হাঙর। ত্রাসে আতঙ্কে ঘেমে উঠল সান্তিয়াগো। এবার কী অস্ত্র দিয়ে মাছটাকে বাঁচাবে? একসময় দাঁড়ের সঙ্গে ছুরি বেঁধে আঘাত করতে লাগল তাদের। তার মরিয়া আক্রমণে জখম হওয়া হাঙর দুটো একে একে তলিয়ে গেল পানির নিচে। কিন্তু ততক্ষণে তাদের খাবলায় মাছটার শরীর থেকে বিরাট ওজনের মাংসপিণ্ড উধাও হয়েছে। হাঙর মারতে গিয়ে আগে হারপুন হারিয়েছিল, এবার ছুরিটাও খুইয়ে ফেলল সে। শ্রমে-ক্লান্তিতে তবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাছটার খুব সামান্যই নিতে পেরেছে ওরা। বাকিটুকু নিয়ে বন্দরে পৌঁছাতে পারলেও তার অনেক। এমনি সময় তার সামনে দেখা দিল সবচেয়ে রক্ত-হিম করা দৃশ্য। এবার দুটো নয়, এক দল হাঙর ঘিরে ফেলেছে মাছটাকে। পাগলের মতো তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। এখন তার হাতে ছোট একটা লাঠি ছাড়া কিছু নেই। কী করে হটাবে তাদের? আর্তনাদ করে উঠল সান্তিয়াগো। তখনই তার মনে হলো সেই কথাটা : এই নিঃসীম সমুদ্রে এভাবে একা এসে সে ভালো করেনি। তার নিঃশেষিত প্রতিরোধকে উপহাস করে, তার অসহায় চোখের সামনে দিয়ে, হাঙররা তার শিকার করা মাছটিকে ক্ষুধার্ত দাঁতে ছিঁড়ে নিয়ে গেল। শুধু রেখে গেল তার এক দীর্ঘ রিক্ত পরিকীর্ণ কঙ্কাল। একজন বৃদ্ধ জেলের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনের নিঃস্ব করুণ স্মৃতি।


গল্পটা পড়তে পড়তে রামায়ণে রাম এবং রাবণের যুদ্ধের কথা মনে পড়ে। সেখানে দুজন দুজনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করছেন। রামের পক্ষে এই নিষ্ঠুর যুদ্ধ অনিবার্য। কেননা রাবণ তাঁর স্ত্রীকে চুরি করে তাঁর জীবনের সুখ, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ ছারখার করে দিয়েছে। তাই রাবণকে হত্যা ছাড়া তাঁর উপায় নেই। আর রাবণও ক্ষত্রিয়। সে বিশ্বাস করে, যার শক্তি আছে সে-ই কাম্যকে পাবে। সে-ও একজন বিশ্বাসী। কাজেই এখানে যুদ্ধ হচ্ছে বিশ্বাসীর সঙ্গে বিশ্বাসীর। নায়কের সঙ্গে নায়কের। নায়কের সঙ্গে ভিলেনের নয়। এই বইয়ে এই যে জেরে, সে-ও যেমন নায়ক, মাছটাও তেমনি তাই।
এ জন্য সে মাছটাকে ভাই বলে সম্বোধন করেছে। তার শক্তি, বিশালতা আর সৌন্দর্যকে অভিনন্দন জানিয়েছে। সে মনে মনে বলেছে, তুমি আমি একই, কিন্তু আমরা এই নির্মম যুদ্ধের জন্যে নিয়তিবদ্ধ। আমাদের একজনের বিনাশ ছাড়া অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের পথ নেই। দুজনই শক্তিমান, ক্ষিপ্রতায় আর বুদ্ধিতে সমকক্ষ। রামের গল্পটা শেষ করি। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে রাম রাবণের সঙ্গে সামনা-সামনি হলেন এবং সে যুদ্ধে রাবণ পরাজিত এবং নিহত হলো। নিহত রাবণের মৃতদেহ তখন পড়ে আছে সামনে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বিভীষণ, রাবণের ভাই। সে রাবণকে বলেছিল, তুমি যুদ্ধ করো না। সীতাকে ফিরিয়ে দাও। এ অন্যায়। তার মূল্যবোধ হলো মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ, দুর্বল-ভীরু মানুষের মূল্যবোধ, রাবণের মূল্যবোধ রাজার মূল্যবোধ। সে মনে করে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। অন্যায়কারীকে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবেই। রাবণ তার কথা শোনেনি, তাই সে রামের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিয়েছে। রাবণের মৃতদেহের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাম বিভীষণকে বললেন, 'বিভীষণ, তোমার ভাই একজন সত্যিকার বীর ছিলেন। প্রয়োজনে আমরা যুদ্ধ করেছি। সেই প্রয়োজন এখন শেষ। সে এখন যেমন তোমার ভাই সে তেমনি আমারও ভাই।' এসব হচ্ছে বীরদের উক্তি- মহৎ মানুষদের কথা। সান্তিয়াগোর মধ্যে আমরা সেই মহত্ত্ব দেখতে পাই। সে মাছটির সঙ্গে যুদ্ধও করেছে আবার তাকে সম্মানও করেছে। এ শুধু মানবিকতার জন্য নয়, এ তার শক্তির মূল্যায়ন। প্রিয়তা-অপ্রিয়তার ওপরে উঠে শ্রেয়কে শ্রদ্ধা করার মহত্ত্ব।


ছোট্ট কাব্যময় এই বইয়ে একটা স্নিগ্ধ প্রতীকের ভেতর দিয়ে হেমিংওয়ে মানবজাতির জীবনকে- মানুষের অন্বেষণকে, এই জীবনের সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম, জয়, গৌরব আর সবশেষে নিঃস্ব হয়ে বিদায় নেওয়ার আদ্যোপান্ত গল্প অদ্ভুত গীতিময়ভাবে তুলে ধরেছেন। এমন ছোট্ট নিটোল অসাধারণ বই আমি কমই পড়েছি। আগেই বলেছি, এই বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন, এই নিঃসীম জীবন-সমুদ্রে সান্তিয়াগোর মতো আমরাও সবই নিজ নিজ আরাধ্যের অন্বেষণে এক দিন পা বাড়াই। দীর্ঘ একঘেয়ে নির্মম পথ হেঁটে এক দিন সেই সুন্দর বিশাল রহস্যময় আর অনির্বচনীয় আরাধ্যের মুখোমুখি হই। নিষ্ঠুর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পৃথিবী তোলপাড় করে সান্তিয়াগোর মতোই তাকে জয় করি, তারপর জীবনের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ক্ষুধার্ত হাঙরদের তীক্ষ্ন দাঁতের কাছে সব খুইয়ে ঘুমের ভেতর সিংহের গর্জন শুনতে শুনতে শেষ হয়ে যাই। বইটির মধ্যে মানবজীবনের বিশাল ক্যানভাসটি যেন ধরা পড়েছে মুক্তোর মতো একটি ছোট্ট উপমায়। বাংলা ভাষার একটি কবিতায়, আরো নিটোল অবয়বে, একই বিষয়কে- মানবভাগ্যের এই জয় আর খুইয়ে ফেলার কাহিনীটিকে- অপরূপ চেহারায় আমরা দেখতে পাই। কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের 'সোনার তরী'। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ জীবনকে তুলে ধরেছেন জেলে নয়, চাষির প্রতীকে। কবিতাটির শুরুতেই আছে প্রকৃতির ওপর মানবজীবনের বিজয় প্রতিষ্ঠার কাহিনী। এক চাষি অনেক শ্রমে-যত্নে তার ক্ষেতে 'রাশি রাশি ভারা ভারা' সোনার ধান ফলিয়েছে। ফসল ফলানো যখন শেষ, সোনার ধান অপার্থিব ঐশ্বর্যে যখন থৈ থৈ করছে, তখনই গগন-জোড়া মেঘের গর্জনের সঙ্গে তার ছোট্ট ক্ষেতটিকে ঘিরে ধরল মৃত্যুর মতো কুটিল বাঁকা জলের নির্মম স্রোতরেখা; ঠিক যেমন সব গৌরবের সর্বোচ্চ ঐশ্বর্য নিয়ে বন্দরের দিকে রওনা দেওয়া সান্তিয়াগোর মাছকে ঘিরে ধরেছিল হাঙরের দল। কবিতাটিতে চাষিকে কেবল বর্ষার হিংস্র কুটিল জলধারা ঘিরে ধরেনি, তার সঙ্গে এসেছে আরেকজন- সে নিষ্ঠুরতম নিয়তি- কালস্রোত। আমরা সবাই জানি, কবিতাটির পরের অংশটা :
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে।
ভরা পালে চলে যায়, কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দু ধারে-
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও, যারে খুশি তারে দাও-
শুধু তুমি নিয়ে যাও ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে

যত চাও তত লও তরণী- 'পরে।
আর আছে?- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলই দিলাম তুলে থরে বিথরে-
এখন আমারে লহো করুণা ক'রে (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.