রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ক্রমবর্ধমান ধারা by এ এম এম শওকত আলী
বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নসহ কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক এবং কাম্য। তবে মতপার্থক্যের ক্রমবর্ধমান ধারায় যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ অন্যান্য দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, তাহলেই সেটা আশঙ্কার কারণ হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বর্তমানে এরই স্বাক্ষর বহন করে। বর্তমানে মতপার্থক্যের মূল বিষয় হলো সংবিধান সংশোধন। এ ব্যাপারে উচ্চতর আদালতের রায় রয়েছে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট রায়ের আলোকেই সংবিধান সংশোধন করা হবে। কিন্তু পরে দেখা গেল, ক্ষমতাসীন দলের কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানকেই ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত ব্যক্ত করছেন। রায়-পরবর্তী সময়েও কিছুসংখ্যক ব্যক্তি বলেছিলেন, এই রায়ের পর মূল সংবিধানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা নেই। উচ্চ আদালতের রায়ে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা ছিল না। থাকার কথাও নয়। কারণ এ বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য মামলা করা হয়নি। এরপর যে বিতর্ক শুরু হলো, তা দুই ভাগে ভাগ করা যায়_এক. ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে; দুই. ক্ষমতাসীন দল বনাম প্রধান বিরোধী দল।
প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় এবং সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটির মধ্যে মতভিন্নতা দৃশ্যমান ছিল। আইন মন্ত্রণালয় সংবিধান পুনর্মুদ্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। অন্যদিকে বিশেষ সংসদীয় কমিটির এক শীর্ষ সদস্য বা কো-চেয়ারম্যানের প্রকাশিত বক্তব্য ছিল_রায়বহির্ভূত কিছু বিষয়েও প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। কারণ সংবিধান সংশোধন করার এখতিয়ার সংসদের; অন্য কারো নয়। অকাট্য যুক্তি হলেও বাস্তবে সংশোধন সংক্রান্ত প্রক্রিয়া অধিকতর বিতর্ক সৃষ্টি করে। এ বিতর্ক এখনো থামেনি। বরং আরো বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। এর ফলে রাজনৈতিক অঙ্গন বর্তমানে উত্তপ্ত। ভবিষ্যতে উত্তাপ যে আরো বৃদ্ধি পাবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পেশার মানুষের অভিমত গ্রহণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ সংসদীয় কমিটি প্রথমে কিছুসংখ্যক সংবিধান বিশেষজ্ঞ, পরে রাজনৈতিক দল এবং প্রথিতযশা আইনবিদসহ উচ্চতর আদালতের কিছু সাবেক বিচারকের সঙ্গেও মতবিনিময় করেছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্য দৃশ্যমান ছিল। মহাজোটভুক্ত দুটি দল সামরিক শাসনামলের সময় রাষ্ট্রধর্ম ইসলামসহ এ সংক্রান্ত অন্যান্য সংশোধনী রহিত করার দাবি জানিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রধানসহ অন্যান্য নেতা এগুলো অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে কিছু সংবিধান বিশেষজ্ঞ ধর্ম সংক্রান্ত অতীতের সব সংশোধনী রহিত করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। বিশেষ কমিটির সভায় আরো অনেকে বলেছেন, সংবিধানে কোনো 'ইজম' না রাখাই ভালো। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় ছিল না। যা ছিল, তা হলো_সব ধর্মের নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা। এতে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি অত সহজ নয়। এ থেকে আরো প্রমাণিত হয়, ইচ্ছা করলেই সব কিছু করা যায় না। বিশেষ সংসদীয় কমিটির সভায় সংবিধান বিশেষজ্ঞদের যে যুক্তি ছিল, তা হলো_ধর্মের জন্য রাষ্ট্র নয়, মানুষের জন্য রাষ্ট্র। অতএব, এ দুটি বিষয় একীভূত করা সংগত নয়।
সংবিধান সংশোধন বিতর্কে রায়বহির্ভূত একটি বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। বিশেষ সংসদীয় কমিটি উচ্চতর আদালতের বিচারকদের অভিশংসন (ওসঢ়বধপয) করার পক্ষপাতী। এ ধরনের বিধান মূল সংবিধানে ছিল। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে সংসদের এ সংক্রান্ত ক্ষমতা রহিত করা হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই এর বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে এ ক্ষমতা পুনর্বহাল করা হবে বলে ধারণা করা যায়। যতি তা-ই হয়, তাহলে আংশিকভাবে হলেও বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া হবে।
সংশোধন প্রক্রিয়ার অন্য একটি বিষয় হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা রাখা হবে কি হবে না। এ বিষয়টি উচ্চতর আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন। এ আদালতে অ্যামিকাস কিউরি অর্থাৎ আদালতের বন্ধু হিসেবে কয়েকজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। তাঁদের সিংহভাগই এ প্রথা চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলও এ প্রথা কিছু সংশোধনীসহ অব্যাহত রাখার পক্ষে। এই দলের মতে_(এক) নির্বাচন অনূর্ধ্ব ৯০ দিনের মধ্যে অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে। (দুই) যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে দল ক্ষমতায় ছিল, তারাই ওই সময়ের সব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। প্রধান বিরোধী দল বর্তমান প্রথা চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে দলীয় কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে নিয়োগের বিরোধিতার বিষয়টিও জানিয়েছে। বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি কোনো সাবেক বিচারপতিকেই নিয়োগ না দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। যুক্তি হলো, এর ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, প্রধান বিরোধী দল বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনি। তবে সংসদের বাইরে থেকে ক্রমাগত সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উত্থাপন করছে_এক. আমন্ত্রণ করার বিষয়টি লোক দেখানোরই নামান্তর মাত্র। দুই. ক্ষমতাসীন দল সংবিধান সংশোধন করে বাকশাল প্রথায় ফিরে যেতে চায়। তিন. প্রধান বিরোধী দল পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এলে সব সংশোধন রহিত করবে। চার. সংবিধান সংশোধন করতে হলে রেফারেন্ডাম বা গণভোট করতে হবে। পাঁচ. সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে বিধায় অচিরেই মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে হবে। সব বিষয়েই নেতিবাচক অবস্থান নেওয়াটা এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির ফলেই ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ভিত্তি ছিল ওই সময়কার অতি উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাজনৈতিক অঙ্গনবহির্ভূত যে কয়জন আইনবিশারদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন, তা থেকে প্রমাণিত হয়, এ প্রথা না থাকলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এর বিকল্প হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো প্রয়োজনই নেই। এ প্রথা বাহাত্তরের সংবিধানে ছিল না। ক্ষমতাসীন দল যখন কিছু সংশোধনসহ এ প্রথা অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে মত দিয়েছে, তখন বলা যায়, তা হবে মূল সংবিধানবহির্ভূত বিষয়কে সমর্থন দেওয়া। অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া অতটা সহজ নয়, যা মনে করা হয়েছিল।
সংবিধান কোনো অপরিবর্তনীয় রাষ্ট্রীয় দলিল নয়। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, এ পর্যন্ত যত সংশোধন সাধিত হয়েছে, তার সিংহভাগই রাজনৈতিক বা সরাসরি। বলতে গেলে, কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য। ১৯৭৫ সালে বাকশালের মাধ্যমে একদলীয় শাসন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আঘাত করে। ১৯৭৫-এর আগস্ট-পরবর্তীকালে একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পরপর দুইবার প্রধান সামরিক প্রশাসকের নিজস্ব দল সৃষ্টি করে ক্ষমতায় টিকে থাকাটা কিছু সময়ের জন্য হলেও সাফল্য অর্জন করেছিল। এ প্রক্রিয়ায় প্রথম দলটিই হয় বর্তমান প্রধান বিরোধী দল। দ্বিতীয় দলটি মহাজোটভুক্ত দল। তবে ১৯৭৫-পরবর্তীকালে প্রথম দলটি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করে। এর ফলে এ ধরনের কয়েকটি দল রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার অধিকার ছিল না।
এসব দলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী বা মানবতা লঙ্ঘনকারী আসামি হিসেবে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে অভিযুক্ত। ইসলামী আইন কায়েম করার পক্ষপাতী অন্য একটি দল বর্তমানে সরকার ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতায় লিপ্ত। এর জন্য তারা বিক্ষোভ সমাবেশও করেছে। তবে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, সরকার নীতি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে সমর্থনযোগ্য।
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ইসলামী আইন কায়েমের জন্য আল-কায়েদা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এদের শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ দলের হাতে নিহত হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি ওবামাসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতা অবশ্য এ বিষয়ে একটি সাবধানবাণীও উচ্চারণ করেছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমাপ্তি এখনো হয়নি। কারণ আল-কায়েদার বহু অনুসারী এখনো কাজ করছে। বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছরে এ ধরনের সন্ত্রাসীকে খুঁজে বের করে আদালতে হাজির করেছে। শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান। এ দেশেও অনেকে বিশ্বাস করেন, ওসামার মৃত্যুর পর এই আশঙ্কার অবসান হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারের সুচিন্তিত পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা
প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় এবং সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটির মধ্যে মতভিন্নতা দৃশ্যমান ছিল। আইন মন্ত্রণালয় সংবিধান পুনর্মুদ্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। অন্যদিকে বিশেষ সংসদীয় কমিটির এক শীর্ষ সদস্য বা কো-চেয়ারম্যানের প্রকাশিত বক্তব্য ছিল_রায়বহির্ভূত কিছু বিষয়েও প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। কারণ সংবিধান সংশোধন করার এখতিয়ার সংসদের; অন্য কারো নয়। অকাট্য যুক্তি হলেও বাস্তবে সংশোধন সংক্রান্ত প্রক্রিয়া অধিকতর বিতর্ক সৃষ্টি করে। এ বিতর্ক এখনো থামেনি। বরং আরো বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। এর ফলে রাজনৈতিক অঙ্গন বর্তমানে উত্তপ্ত। ভবিষ্যতে উত্তাপ যে আরো বৃদ্ধি পাবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পেশার মানুষের অভিমত গ্রহণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ সংসদীয় কমিটি প্রথমে কিছুসংখ্যক সংবিধান বিশেষজ্ঞ, পরে রাজনৈতিক দল এবং প্রথিতযশা আইনবিদসহ উচ্চতর আদালতের কিছু সাবেক বিচারকের সঙ্গেও মতবিনিময় করেছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্য দৃশ্যমান ছিল। মহাজোটভুক্ত দুটি দল সামরিক শাসনামলের সময় রাষ্ট্রধর্ম ইসলামসহ এ সংক্রান্ত অন্যান্য সংশোধনী রহিত করার দাবি জানিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রধানসহ অন্যান্য নেতা এগুলো অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে কিছু সংবিধান বিশেষজ্ঞ ধর্ম সংক্রান্ত অতীতের সব সংশোধনী রহিত করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। বিশেষ কমিটির সভায় আরো অনেকে বলেছেন, সংবিধানে কোনো 'ইজম' না রাখাই ভালো। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় ছিল না। যা ছিল, তা হলো_সব ধর্মের নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা। এতে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি অত সহজ নয়। এ থেকে আরো প্রমাণিত হয়, ইচ্ছা করলেই সব কিছু করা যায় না। বিশেষ সংসদীয় কমিটির সভায় সংবিধান বিশেষজ্ঞদের যে যুক্তি ছিল, তা হলো_ধর্মের জন্য রাষ্ট্র নয়, মানুষের জন্য রাষ্ট্র। অতএব, এ দুটি বিষয় একীভূত করা সংগত নয়।
সংবিধান সংশোধন বিতর্কে রায়বহির্ভূত একটি বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। বিশেষ সংসদীয় কমিটি উচ্চতর আদালতের বিচারকদের অভিশংসন (ওসঢ়বধপয) করার পক্ষপাতী। এ ধরনের বিধান মূল সংবিধানে ছিল। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে সংসদের এ সংক্রান্ত ক্ষমতা রহিত করা হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই এর বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে এ ক্ষমতা পুনর্বহাল করা হবে বলে ধারণা করা যায়। যতি তা-ই হয়, তাহলে আংশিকভাবে হলেও বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া হবে।
সংশোধন প্রক্রিয়ার অন্য একটি বিষয় হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা রাখা হবে কি হবে না। এ বিষয়টি উচ্চতর আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন। এ আদালতে অ্যামিকাস কিউরি অর্থাৎ আদালতের বন্ধু হিসেবে কয়েকজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। তাঁদের সিংহভাগই এ প্রথা চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলও এ প্রথা কিছু সংশোধনীসহ অব্যাহত রাখার পক্ষে। এই দলের মতে_(এক) নির্বাচন অনূর্ধ্ব ৯০ দিনের মধ্যে অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে। (দুই) যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে দল ক্ষমতায় ছিল, তারাই ওই সময়ের সব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। প্রধান বিরোধী দল বর্তমান প্রথা চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে দলীয় কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে নিয়োগের বিরোধিতার বিষয়টিও জানিয়েছে। বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি কোনো সাবেক বিচারপতিকেই নিয়োগ না দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। যুক্তি হলো, এর ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, প্রধান বিরোধী দল বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনি। তবে সংসদের বাইরে থেকে ক্রমাগত সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উত্থাপন করছে_এক. আমন্ত্রণ করার বিষয়টি লোক দেখানোরই নামান্তর মাত্র। দুই. ক্ষমতাসীন দল সংবিধান সংশোধন করে বাকশাল প্রথায় ফিরে যেতে চায়। তিন. প্রধান বিরোধী দল পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এলে সব সংশোধন রহিত করবে। চার. সংবিধান সংশোধন করতে হলে রেফারেন্ডাম বা গণভোট করতে হবে। পাঁচ. সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে বিধায় অচিরেই মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে হবে। সব বিষয়েই নেতিবাচক অবস্থান নেওয়াটা এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির ফলেই ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ভিত্তি ছিল ওই সময়কার অতি উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাজনৈতিক অঙ্গনবহির্ভূত যে কয়জন আইনবিশারদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন, তা থেকে প্রমাণিত হয়, এ প্রথা না থাকলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এর বিকল্প হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো প্রয়োজনই নেই। এ প্রথা বাহাত্তরের সংবিধানে ছিল না। ক্ষমতাসীন দল যখন কিছু সংশোধনসহ এ প্রথা অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে মত দিয়েছে, তখন বলা যায়, তা হবে মূল সংবিধানবহির্ভূত বিষয়কে সমর্থন দেওয়া। অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া অতটা সহজ নয়, যা মনে করা হয়েছিল।
সংবিধান কোনো অপরিবর্তনীয় রাষ্ট্রীয় দলিল নয়। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, এ পর্যন্ত যত সংশোধন সাধিত হয়েছে, তার সিংহভাগই রাজনৈতিক বা সরাসরি। বলতে গেলে, কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য। ১৯৭৫ সালে বাকশালের মাধ্যমে একদলীয় শাসন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আঘাত করে। ১৯৭৫-এর আগস্ট-পরবর্তীকালে একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পরপর দুইবার প্রধান সামরিক প্রশাসকের নিজস্ব দল সৃষ্টি করে ক্ষমতায় টিকে থাকাটা কিছু সময়ের জন্য হলেও সাফল্য অর্জন করেছিল। এ প্রক্রিয়ায় প্রথম দলটিই হয় বর্তমান প্রধান বিরোধী দল। দ্বিতীয় দলটি মহাজোটভুক্ত দল। তবে ১৯৭৫-পরবর্তীকালে প্রথম দলটি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করে। এর ফলে এ ধরনের কয়েকটি দল রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার অধিকার ছিল না।
এসব দলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী বা মানবতা লঙ্ঘনকারী আসামি হিসেবে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে অভিযুক্ত। ইসলামী আইন কায়েম করার পক্ষপাতী অন্য একটি দল বর্তমানে সরকার ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতায় লিপ্ত। এর জন্য তারা বিক্ষোভ সমাবেশও করেছে। তবে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, সরকার নীতি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে সমর্থনযোগ্য।
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ইসলামী আইন কায়েমের জন্য আল-কায়েদা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এদের শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ দলের হাতে নিহত হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি ওবামাসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতা অবশ্য এ বিষয়ে একটি সাবধানবাণীও উচ্চারণ করেছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমাপ্তি এখনো হয়নি। কারণ আল-কায়েদার বহু অনুসারী এখনো কাজ করছে। বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছরে এ ধরনের সন্ত্রাসীকে খুঁজে বের করে আদালতে হাজির করেছে। শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান। এ দেশেও অনেকে বিশ্বাস করেন, ওসামার মৃত্যুর পর এই আশঙ্কার অবসান হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারের সুচিন্তিত পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা
No comments