চারদিক-খুদে মাঝিদের জীবনগাথা byকল্যাণ প্রসূন
ভরা কণ্ঠিনালা নদী। ঘাটে সারি করে রাখা ২৫-৩০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। কিছু সময় পর পর একটি করে নৌকা যাত্রী বোঝাই করে গন্তব্যে রওনা দিচ্ছে। ১২-১৩ বছরের এক শিশু হাঁকছিল, ‘রাবার ড্যাম যাইতা নি, রাবার ড্যাম’, ‘উইঠ্যা পড়েন, উইঠ্যা পড়েন’। সংবাদ সংগ্রহে হাকালুকি হাওরে যাব। ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।
তাই দেরি না করেই রাবার ড্যামগামী মাঝারি আকারের একটি নৌকায় চেপে বসলাম।
মৌলভীবাজারের জুড়ী-কুলাউড়া সড়কে কণ্ঠিনালা সেতু। ওই সেতুর নিচেই নৌকাঘাটটি। বছরের বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত হাকালুকি হাওরপারের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন পানিবন্দী থাকে। তখন চলাচলের একমাত্র ভরসা নৌকা। কণ্ঠিনালা সেতুর ঘাট হয়ে হাওরপারের লোকজন জুড়ী উপজেলা সদরে প্রয়োজনীয় কাজে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে।
এরই মধ্যে নৌকার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেছে। জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে। নৌকার সামনের দিকে তাকাতেই দেখি, যে শিশুটি ‘রাবার ড্যাম যাইবেন’ বলে হাঁকছিল, সে-ই আমাদের এই যাত্রাপথের মাঝি। তাকে সহযোগিতা করছে আরেক শিশু। নৌপথের দিকে তাদের সতর্ক দৃষ্টি বোঝা গেল। চলাচলকারী অন্য নৌকার সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য নিরাপদ দূরত্বে থাকতে মাঝেমধ্যে তারা দাঁড়িয়ে অন্য মাঝিদের হাত দিয়ে ইশারা করছিল। ১৫-২০ জন যাত্রীবোঝাই নৌকা নিয়ে দুই খুদে মাঝি ছুটে চলেছে। তাদের দুজনের সম্পর্কে হঠাৎ জানার আগ্রহ জাগল। কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম। নৌকার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় বসে আছি। দুই খুদে মাঝি নৌকার দুই প্রান্তে। একপর্যায়ে তাদের একজন ভাড়া নিতে আসে। চটপট ভাড়া নিয়ে সে চলে গেল, কথা বলার ফুরসত ছিল না।
ঘণ্টা খানেক পর ‘রাবার ড্যাম’ পৌঁছে নৌকা থামল। ইঞ্জিনও বন্ধ হলো। যাত্রীদের অধিকাংশই আগেই নিজেদের বাড়ির ঘাটে নেমে পড়েছে। আমিসহ আরও চারজন ছিলাম রাবার ড্যামের যাত্রী। অন্যরা নামার পর কথা বলার সুযোগটা পেয়ে গেলাম।
প্রধান মাঝি আবদুর রহমান। তার বাড়ি পাশের বেলাগাঁও গ্রামে। তাদের আদি নিবাস কুমিল্লায়। তারা দুই ভাই। রহমান বড়। ছোট ভাইটি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। রহমান উপজেলা সদরে অবস্থিত জুড়ী মডেল উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। মা আর দুই ভাই মিলে নানির বাড়িতে একটি কাঁচা ঘরে থাকে। তাদের নিজেদের কোনো বাড়িঘর নেই।
রহমান বলে, ‘বাবারে ভালোমতো মনে নাই। মায়ের কাছ থিকা শুইনছি, তাইনে আমরারে ছাড়ি অনেক আগে ঢাকায় গিয়া আরেকটা সংসার করছে। এর পর থাইকা দুই ভাই আর মা নানির আশ্রয়ে থাকি। নানি বুড়া। মায়ে লোকজনের বাড়িতে কাম-কাজ করি সংসার চালায়।’
ভরা নদীতে নৌকা চালাতে ভয় লাগে না—এই প্রশ্নে আবদুর রহমান হেসে বলে, ‘আমাগো বয়সী সবাই তো পারে।’ পাশে বসে থাকা রহমানের সহকারী হেলাল (১২) ঘাড় নেড়ে এ কথায় সায় দেয়।
রহমান জানায়, বিদ্যালয়ে এখন রোজা-ঈদের ছুটি। তাই এই সুযোগে দৈনিক ১৫০ টাকা মজুরিতে সে এই কাজে নেমে পড়েছে। নৌকার মালিক স্থানীয় চেরাগ মিয়া। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দু-তিনবার ‘রাবার ড্যাম’ পর্যন্ত আসা-যাওয়া করা যায়। বোরো ধানের মৌসুমে মাড়াইয়ের কাজও করে সে। তবে বিদ্যালয় ফাঁকি দিয়ে নয়।
রহমানের ভাষ্যমতে, কণ্ঠিনালা সেতুঘাট-রাবার ড্যাম পথে তার মতো আরও ১০-১২ জন প্রতিদিন নৌকা চালায়। তারা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদের অধিকাংশ লেখাপড়াও করে। আলাপচারিতার ফাঁকে চোখ মুছতে মুছতে রহমান বলে, ‘বিকালে মালিক টাকা দিলে চাউল-ডাইল আর মাছ কিইন্যা বাড়িত যাই। মায়ে খুশি অয়। মায়ের মুখে হাসি দেখলে খুব ভালো লাগে।’
রহমান বলে, ‘লেহাপড়া চালাইয়া যাইতে চাই। জানি না কতটুকু পারমু।’
রহমানের সহকারী হেলাল মিয়া (১২)। তার বাড়ি কাটানালার পার। সে মজুরি পায় ৮০ টাকা। তার বাবা নৌকা চালান। লেখাপড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে হেলাল মাথা নিচু করে বলে, ‘বাবায় কইছে এই কাম করতে, এর লাইগ্যা ইশকুলে ভর্তি করে নাই।’
বেলাগাঁও গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম (৪৫) জানান, হাওরপারের বেশির ভাগ লোক বছরের ছয় মাস ভাসান পানিতে মাছ ধরে জীবিকা চালায়। আর পানি কমে গেলে জেগে ওঠে হাওরপারের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। সেখানে তখন বোরো ধানের আবাদ শুরু হয়। চারা রোপণ থেকে ফসল কাটা-মাড়াই পর্যন্ত হাওরপারের লোকজন দিনমজুরের কাজ করে। এই কাজে এলাকার শিশুরাও থাকে।
নজরুল বলেন, ‘এই এলাকার কিছু ছেলেমেয়ে ইশকুল-কলেজে লেহাপড়া করে। আর বেশির ভাগই এই লাইনে নাই। সব ছেলেমেয়েই সংসারের লাগি কমবেশি আয়-রোজগার করে।’
কথা বলতে বলতে বেশ সময় গড়াল। ভাপসা গরম। ‘রাবার ড্যাম’ থেকে মধ্যবয়সী মাঝি জয়নালের একটি ছোট নৌকা ভাড়া করে সংবাদ সংগ্রহে চাতলা বিলের উদ্দেশে রওনা দিই। বিশাল হাকালুকি। আয়তন প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর। ছোট-বড় ২৩৮টি বিল (জলমহাল) আছে এই হাওরে। দেশের বৃহত্তম হাওর এটি। একটু দূরে দূরে জাল টেনে মাছ ধরছে লোকজন। ভাবতে থাকি আবদুর রহমান আর হেলালদের জীবনসংগ্রামের কথা।
কল্যাণ প্রসূন
মৌলভীবাজারের জুড়ী-কুলাউড়া সড়কে কণ্ঠিনালা সেতু। ওই সেতুর নিচেই নৌকাঘাটটি। বছরের বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত হাকালুকি হাওরপারের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন পানিবন্দী থাকে। তখন চলাচলের একমাত্র ভরসা নৌকা। কণ্ঠিনালা সেতুর ঘাট হয়ে হাওরপারের লোকজন জুড়ী উপজেলা সদরে প্রয়োজনীয় কাজে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে।
এরই মধ্যে নৌকার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেছে। জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে। নৌকার সামনের দিকে তাকাতেই দেখি, যে শিশুটি ‘রাবার ড্যাম যাইবেন’ বলে হাঁকছিল, সে-ই আমাদের এই যাত্রাপথের মাঝি। তাকে সহযোগিতা করছে আরেক শিশু। নৌপথের দিকে তাদের সতর্ক দৃষ্টি বোঝা গেল। চলাচলকারী অন্য নৌকার সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য নিরাপদ দূরত্বে থাকতে মাঝেমধ্যে তারা দাঁড়িয়ে অন্য মাঝিদের হাত দিয়ে ইশারা করছিল। ১৫-২০ জন যাত্রীবোঝাই নৌকা নিয়ে দুই খুদে মাঝি ছুটে চলেছে। তাদের দুজনের সম্পর্কে হঠাৎ জানার আগ্রহ জাগল। কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম। নৌকার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় বসে আছি। দুই খুদে মাঝি নৌকার দুই প্রান্তে। একপর্যায়ে তাদের একজন ভাড়া নিতে আসে। চটপট ভাড়া নিয়ে সে চলে গেল, কথা বলার ফুরসত ছিল না।
ঘণ্টা খানেক পর ‘রাবার ড্যাম’ পৌঁছে নৌকা থামল। ইঞ্জিনও বন্ধ হলো। যাত্রীদের অধিকাংশই আগেই নিজেদের বাড়ির ঘাটে নেমে পড়েছে। আমিসহ আরও চারজন ছিলাম রাবার ড্যামের যাত্রী। অন্যরা নামার পর কথা বলার সুযোগটা পেয়ে গেলাম।
প্রধান মাঝি আবদুর রহমান। তার বাড়ি পাশের বেলাগাঁও গ্রামে। তাদের আদি নিবাস কুমিল্লায়। তারা দুই ভাই। রহমান বড়। ছোট ভাইটি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। রহমান উপজেলা সদরে অবস্থিত জুড়ী মডেল উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। মা আর দুই ভাই মিলে নানির বাড়িতে একটি কাঁচা ঘরে থাকে। তাদের নিজেদের কোনো বাড়িঘর নেই।
রহমান বলে, ‘বাবারে ভালোমতো মনে নাই। মায়ের কাছ থিকা শুইনছি, তাইনে আমরারে ছাড়ি অনেক আগে ঢাকায় গিয়া আরেকটা সংসার করছে। এর পর থাইকা দুই ভাই আর মা নানির আশ্রয়ে থাকি। নানি বুড়া। মায়ে লোকজনের বাড়িতে কাম-কাজ করি সংসার চালায়।’
ভরা নদীতে নৌকা চালাতে ভয় লাগে না—এই প্রশ্নে আবদুর রহমান হেসে বলে, ‘আমাগো বয়সী সবাই তো পারে।’ পাশে বসে থাকা রহমানের সহকারী হেলাল (১২) ঘাড় নেড়ে এ কথায় সায় দেয়।
রহমান জানায়, বিদ্যালয়ে এখন রোজা-ঈদের ছুটি। তাই এই সুযোগে দৈনিক ১৫০ টাকা মজুরিতে সে এই কাজে নেমে পড়েছে। নৌকার মালিক স্থানীয় চেরাগ মিয়া। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দু-তিনবার ‘রাবার ড্যাম’ পর্যন্ত আসা-যাওয়া করা যায়। বোরো ধানের মৌসুমে মাড়াইয়ের কাজও করে সে। তবে বিদ্যালয় ফাঁকি দিয়ে নয়।
রহমানের ভাষ্যমতে, কণ্ঠিনালা সেতুঘাট-রাবার ড্যাম পথে তার মতো আরও ১০-১২ জন প্রতিদিন নৌকা চালায়। তারা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদের অধিকাংশ লেখাপড়াও করে। আলাপচারিতার ফাঁকে চোখ মুছতে মুছতে রহমান বলে, ‘বিকালে মালিক টাকা দিলে চাউল-ডাইল আর মাছ কিইন্যা বাড়িত যাই। মায়ে খুশি অয়। মায়ের মুখে হাসি দেখলে খুব ভালো লাগে।’
রহমান বলে, ‘লেহাপড়া চালাইয়া যাইতে চাই। জানি না কতটুকু পারমু।’
রহমানের সহকারী হেলাল মিয়া (১২)। তার বাড়ি কাটানালার পার। সে মজুরি পায় ৮০ টাকা। তার বাবা নৌকা চালান। লেখাপড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে হেলাল মাথা নিচু করে বলে, ‘বাবায় কইছে এই কাম করতে, এর লাইগ্যা ইশকুলে ভর্তি করে নাই।’
বেলাগাঁও গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম (৪৫) জানান, হাওরপারের বেশির ভাগ লোক বছরের ছয় মাস ভাসান পানিতে মাছ ধরে জীবিকা চালায়। আর পানি কমে গেলে জেগে ওঠে হাওরপারের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। সেখানে তখন বোরো ধানের আবাদ শুরু হয়। চারা রোপণ থেকে ফসল কাটা-মাড়াই পর্যন্ত হাওরপারের লোকজন দিনমজুরের কাজ করে। এই কাজে এলাকার শিশুরাও থাকে।
নজরুল বলেন, ‘এই এলাকার কিছু ছেলেমেয়ে ইশকুল-কলেজে লেহাপড়া করে। আর বেশির ভাগই এই লাইনে নাই। সব ছেলেমেয়েই সংসারের লাগি কমবেশি আয়-রোজগার করে।’
কথা বলতে বলতে বেশ সময় গড়াল। ভাপসা গরম। ‘রাবার ড্যাম’ থেকে মধ্যবয়সী মাঝি জয়নালের একটি ছোট নৌকা ভাড়া করে সংবাদ সংগ্রহে চাতলা বিলের উদ্দেশে রওনা দিই। বিশাল হাকালুকি। আয়তন প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর। ছোট-বড় ২৩৮টি বিল (জলমহাল) আছে এই হাওরে। দেশের বৃহত্তম হাওর এটি। একটু দূরে দূরে জাল টেনে মাছ ধরছে লোকজন। ভাবতে থাকি আবদুর রহমান আর হেলালদের জীবনসংগ্রামের কথা।
কল্যাণ প্রসূন
No comments