একাত্তরের মৃত্যুপুরী মিরপুর-ইতিহাস by আখতার জাহান ফরিদা বানু

কাত্তরে মিরপুর ছিল ভয়াবহ এক মৃতপুরী। আগ্রাসী পাকসেনারা চরম অবিবেচনায় যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে অগণিত ছাত্র-জনতা ও নিরীহ মানুষের ওপর, তখন পাশবিক বর্বরতার চরম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে মিরপুরের একদল অবাঙালি। তারা নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাংলাভাষীদের ঘরে ঘরে পৈশাচিক তাণ্ডব চালিয়ে হত্যা করেছে বহু মানুষ। রোকনপুরে আমাদের বাড়ির পাশেই থাকত তারা। লম্বা, একহারা গড়নের, ফর্সা, সপ্রতিভ মেয়েটার নাম ছিল মেহেরুননেসা_ ডাক নাম রানু।


স্বপ্ন দেখত, কবিতা লিখত। তার কবিতায় ফুটে উঠত মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপড়েন ও যন্ত্রণা; মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার একান্ত বিশ্বাস ও আশা আকাঙ্খা। পশ্চিমবঙ্গের নারকেলডাঙ্গা থেকে তারা এ দেশে এসেছিল অনেক অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। বাবা এক ফুড প্রডাক্টসের ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। এক দুর্ঘটনায় তার অঙ্গহানি ঘটায় তিনি পক্ষাঘাতদুষ্ট হন। কিশোরী মেয়েটি তখন ওই অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরে। নিদ্বর্িধায় সে বলত, 'আমি শ্রমিকের কাজ করি।' পরে বাবা মারা যাওয়ায় রানু ছোট ছোট দুটি ভাই ও বিধবা মাকে নিয়ে মিরপুরের ৪নং সেক্টরে বাস করত। একাত্তরে মার্চের কালরাতে অবাঙালি দুর্বৃত্তরা তার ছোট দুটি ভাই ও মাকে নৃশংসভাবে জবাই করে। তারপর তাকেও নির্মমভাবে জবাই করে তার খণ্ডিত শির তারই দীর্ঘ চুলের সাহায্যে ঘরের ফ্যানে ঝুলিয়ে রাখে। কী মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড! এখনও চিন্তা করলে শরীর শিউরে ওঠে।
আবার মনে পড়ে হাসি-খুশি, গোলগাল চেহারা, সহজ-সরল মোহনের কথা। ভালো নাম মিজানুর রহমান। এক বিধবা মায়ের আদরের ছোট ছেলে। নতুন বিয়ে করে মিরপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকত। ২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে অন্য আত্মীয়স্বজন বৌ নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেলে ও ভেবেছিল কারফিউ ওঠা অবস্থায় হয়তো কোনো অঘটন ঘটবে না। বিশেষত তাদের মিরপুরের বাসায় কোনো হামলা হয়নি বলে সে পারিপাশর্ি্বক অবস্থা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। তাই একটা ভ্যান ভাড়া করে সে আবার মিরপুর যায় কিছু মালপত্র ও কাপড়-চোপড় আনতে। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি। প্রতিবেশী পিশাচরা তার সব মালপত্র লুটে নিয়ে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে।
প্রসঙ্গক্রমে আমার স্বামী ডা. আশেকুর রহমান খানের অন্যতম বন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের কৃতী ছাত্র ডা. মোমিনুল হক এফআরসিএস। যার আবিষ্কৃত ঝঁৎমরপধষ ওহংঃৎঁসবহঃ- ঐঁয়্থং উরষবসসধ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। দুটি পালিত ছেলেমেয়ে ও ব্রিটিশ স্ত্রী ব্রেন্দাকে নিয়ে মিরপুরে থাকতেন। ২৬ মার্চ সকালে নরপশুরা তাকে বাসা থেকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে জবাই করতে উদ্যত হয়। এমন সময় এক বৃদ্ধ অবাঙালি 'রোকো, রোকো' অর্থাৎ 'থামো, থামো' বলে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসে এবং বলে ইনি বড় ডাক্তার, আমার ছেলেকে চিকিৎসা করে বাঁচিয়েছেন। একে ছেড়ে দাও। কিন্তু অন্যরা সে কথা মানতে নারাজ। তখন বৃদ্ধ বলে ওঠে_ 'তব পেহলে মুঝে মার ডালো' অর্থাৎ 'তবে প্রথমে আমাকেই মেরে ফেল।' এরই মধ্যে একটি রেডক্রসের গাড়ি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তাতে ডা. মোমিনুল হককে উঠিয়ে দেওয়া হলো। তিনি তখন তার স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। ভাগ্যক্রমে এভাবে এক অবাঙালিরই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় তিনি সেদিনকার সেই নিদারুণ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেন।
এই মিরপুরে পরিত্যক্ত এক পাম্প হাউস ছিল পাক আর্মি, আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের কুকীর্তির আস্তানা। ইঁঃপযবৎ্থং ফবহ তথা জল্লাদখানা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বাঙালির সেরা সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে পাক আর্মি, পিশাচ রাজাকার ও অবাঙালি দুর্বৃত্তরা সমাজকে পঙ্গু করতে চেয়েছিল। তাই অধ্যাপক, ডাক্তার, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের রাতের অন্ধকারে ধরে এনে চোখ-হাত বেঁধে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে যত্রতত্র ফেলে রাখে। মিরপুরের জল্লাদখানা, শিয়ালবাড়ি, মুসলিম বাজার ও রায়েরবাজারের বধ্যভূমি এর জ্বলন্ত স্বাক্ষর। এখানে পড়ে থাকতে দেখা গেছে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডা. ফজলে রাবি্ব, ডা. আবদুল আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক ও সাহিত্যিক আনোয়ার পাশা প্রমুখ বাংলার কৃতী সন্তানদের।
এ ছাড়া মিরপুরের কূপের ভেতর অজস্র নরঅস্থি ও মুণ্ডু পাওয়া গেছে। শোনা যায়, কূপের পাড়ে মাথা রেখে প্রচণ্ড কোপ দেওয়ায় ছিন্ন মস্তক কূপে গিয়ে পড়ত। তারপর খণ্ড-বিখণ্ডিত করে লাশ কূপে ফেলা হতো। এমনি বহু নর-কঙ্কাল ও বধ্যভূমির প্রমাণ রয়েছে মিরপুরে।
এই মিরপুর থেকেই অন্তর্হিত হন স্বনামখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও মেধাবী চলচিত্রকার জহির রায়হান। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পেঁৗছান। কলকাতায় রিজার্ভ ব্যাংকে চাকরি করতেন আমার চাচাতো ভাই সৈয়দ মমতাজ হায়দার (মুনীর)। তার বাসায় জহির রায়হান মাঝে মধ্যে এসে থাকতেন। সারাদিন তিনি লেখালেখি করতেন আর মুনীর ভাই ব্যাংক থেকে বাসায় ফিরলে রাতে তাকে তার লেখা ও ক্ষোভের কথাবার্তা শোনাতেন। সেই জহির রায়হান যখন শুনলেন সাংবাদিক ও কথাশিল্পী শহীদুল্লা কায়সারকে ধরে নিয়ে গেছে বর্বর রাজাকাররা, তখন অগ্রজের শোকে মুহ্যমান হয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে এলেন নিদারুণ বেদনায়। এই বিষণ্ন অবস্থায় কে বা কারা তাকে ফোনে জানাল যে, মিরপুরে শহীদুল্লা কায়সার বন্দি রয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি স্বাধীনতা পেলেও মিরপুর তখনও অবাঙালি দুর্বৃত্ত রাজাকার ও পাক আর্মির দখলে ছিল। জহির রায়হান বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিয়ে শ'খানেক পুলিশসহ উপস্থিত হন মিরপুরে। আর্মি ও রাজাকারদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হলো। এতে বহু পুলিশ আহত ও নিহত হলো। জহির রায়হান অন্তর্ধান হন ৩০-৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। বহুদিন ধরে মিরপুর যতবার গেছি, ততবারই মনে হয়েছে কোথায় আছেন জহির রায়হান? কোথায়? কোথায়?
যাই হোক, জীবন থেমে থাকে না। মৃত্যুর দ্বার ভেঙে জীবন এগিয়ে চলে। শোক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তাই বধ্যভূমির সন্তানরা গড়ে তুলেছে স্মৃতি সংস্থা। মনের মণিকোঠায় সৌধ নির্মাণ করে বছর বছর হারানো স্বজনদের স্মরণ করে ওরা প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে ওঠে।
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম নবতরভাবে সজ্জিত হয়ে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈৎরপশবঃ ঈড়ঁহপরষ-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল স্টেডিয়ামেও ক্রিকেট খেলা হয়েছে। কিন্তু মিরপুর স্টেডিয়ামের অনবদ্য অনুষ্ঠান চির স্মরণীয় ও দীপ্যমান থাকবে মানুষের মনে ও ইতিহাসের পাতায়।
এভাবে কলুষতা আর রক্তের বীভৎসতায় সিক্ত ভয়াবহ মিরপুর শক্তি, সাহস এবং বিনোদনের প্রতীকে রূপান্তরিত!

আখতার জাহান ফরিদা বানু :সাবেক অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.