বাংলাদেশ-ভারত-সীমান্তে শরবিদ্ধ শান্তির পায়রা
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে বৈঠক শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বিএসএফের গুলিতে যেভাবে চার বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হলো, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। দুই দেশের দীর্ঘ সীমান্তে এ ধরনের অঘটন নতুন নয়। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে আলোচনার স্বল্পতম সময়ে যদি রক্তপাত ঘটে, এসব আনুষ্ঠানিকতা অযৌক্তিকই মনে হয়। শিলংয়ে সদ্য সমাপ্ত বৈঠকে বিজিবি সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশির ওপর গুলিবর্ষণ বন্ধের দাবি জানিয়েছিল।
দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও মেহেরপুরের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বিএসএফ কি তা নাকচ করে দিল? বাংলাদেশিরা বিএসএফের ওপর চড়াও হয় বলে ওই বৈঠকে তোলা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর অভিযোগ যে বিশ্বাসযোগ্য নয়, চার নাগরিক হত্যার ঘটনায় তা আরেকবার প্রমাণ হয়েছে। নিহতদের সবাই ছিল নিরস্ত্র কৃষক ও গরুর রাখাল। কুড়িগ্রামের দুই অঘটনের পর অনুষ্ঠিত পতাকা বৈঠকে বিএসএফের দুঃখ প্রকাশ কোনোভাবেই প্রাণহানির পরিপূরক হতে পারে না। ভবিষ্যতে আর গুলি করে মানুষ হত্যা না করার প্রতিশ্রুতির ওপরও আস্থা রাখা কঠিন। আমাদের মনে আছে, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফ শীর্ষ সম্মেলনে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক সীমান্ত হত্যার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনার জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছিলেন। এ বছরের মাঝামাঝি ঢাকা সফরে এসে বিএসএফ জওয়ানদের হাতে অ-প্রাণঘাতী অস্ত্র দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। বাস্তবে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে, ২০০৯ সাল থেকে সীমান্তে হতাহতের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। কিন্তু বৃহৎ প্রতিবেশীটির উচিত হবে বারবার প্রতিশ্রুতি না দিয়ে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ চাইলে সীমান্তে সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বন্ধ কঠিন কাজ নয়। বাংলাদেশের পক্ষেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। সর্বশেষ চার হত্যাকাণ্ডের পর সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে ভারতের কাছে কৈফিয়ত তলব করা। ভুলে যাওয়ার অবকাশ নেই, যে কোনো মূল্যে নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় সরকারেরই। সন্দেহ নেই, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আমরা সবসময় অগ্রাধিকার দেই। কিন্তু এপাশ থেকে ওড়ানো শান্তির পায়রা বারবারই সীমান্তে গিয়ে শরবিদ্ধ হচ্ছে। সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ঘটানো এসব হত্যাকাণ্ড আর যাই হোক বন্ধুত্বের নিদর্শন হতে পারে না। গত দুই দশকে বিএসএফের গুলিতে যত বেসামরিক বাংলাদেশি নিহত হয়েছে, যুদ্ধরত কোনো সীমান্তেও তা বিরল। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতেই হবে। দুই দেশের মধ্যকার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির আর কোনো জবাব থাকতে পারে না। সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক নিহতের ঘটনা বন্ধ হলেই পারস্পরিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচার, অবৈধ পারাপারের মতো কিছু বিষয়ে বরাবরই বিএসএফের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়ে থাকে। যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা চালু হলে তা নিঃসন্দেহে কমে আসবে। তবে তারও আগে প্রয়োজন রক্তপাত বন্ধ করা। শান্ত ও নিরাপদ সীমান্তই কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সৌহার্দ্য ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সংযত আচরণ এবং বাংলাদেশের পক্ষে যথার্থ প্রতিবাদই তার সূচনা করতে পারে।
No comments