টিপাইমুখ রাজনৈতিক নয় আমাদের অস্তিত্বের ইস্যু by গাজীউল হাসান খান
ভারতের প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন এখন আর শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নেই। সে আন্দোলন এখন লন্ডন ও নিউ ইয়র্কসহ প্রবাসে বসবাসকারী লাখ লাখ বাংলাদেশির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই তাকে উপলক্ষ করে প্রবাসীরা শিগগিরই লন্ডনের ওয়েস্ট মিনস্টার পার্লামেন্ট, ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনেই ব্যাপক বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
যত দিন ভারত এ বাঁধ নির্মাণ থেকে সরে না দাঁড়াবে, তত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশিদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করা হয়েছে। এ বাঁধের বিরুদ্ধে সমর্থন আদায় করার জন্য বিস্তারিত কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না থাকায় আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভারত এ বাঁধ নির্মাণ করার সাহস পেয়েছে। তা ছাড়া এমনও বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশ সরকারের ভারতের পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং মৌন সম্মতির কারণেই হঠাৎ ভারত সরকার আবার এ বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু করেছে। প্রবাসী বিভিন্ন সংগঠন ও পরিবেশবাদীদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে উভয় দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীতে বাংলাদেশের সঙ্গে তেমন কোনো চূড়ান্ত পরামর্শ বা যৌথ সিদ্ধান্ত ছাড়াই ভারত উজানে যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তার মধ্যে টিপাইমুখ একটি। তা ছাড়া আরো কয়েকটি এখন বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। যার লক্ষ্য আগামী ৫০ বছরের মধ্যে প্রায় ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। টিপাইমুখ বাঁধসহ ভারতের প্রস্তাবিত সেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পানি সংকট ছাড়াও এ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প ও সুনামি আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আমাদের ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এক অসামান্য বিরূপ প্রভাব ফেলবে ভারতের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প এলাকা ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁদের মতে, ওই প্রকল্পের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি মানুষের ওপর। আমার বন্ধু এবং জাতিসংঘের সাবেক পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. এস আই খান ছয় বছর ধরে এ কথাগুলো বলে আমাদের আগাম হুঁশিয়ার করেছেন। তখন থেকেই আমরা এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও কলাম লেখা শুরু করি। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের আসাম ও মণিপুরসহ 'সপ্ত কন্যা' (সাতটি রাজ্য) এবং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গত এক শ বছরের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ড. খান বহু আগেই বলেছিলেন, এই এলাকায় অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। তিনি বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধে ৫০০ ফুট গভীর জলাধার নির্মাণ করা হলে সেখানে প্রতি বর্গমিটারে ১৬০ টন চাপ সৃষ্টি হবে, যা ওই অঞ্চলে ভূমিকম্পের আরো বেশি আশঙ্কা সৃষ্টি করবে। মণিপুরে বরাক নদের ওপর বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে অতি দ্রুত এগোচ্ছে ভারত। তার মতে এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন ও সনদ অনুযায়ী ভাটির দেশে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে এমন কিছু উজানের দেশ অভিন্ন নদ-নদীতে করতে পারে না। সম্প্রতি তিনি আরো বলেছেন, 'ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন অন ড্যামস' অনুযায়ী অভিন্ন নদ-নদীর ওপর যদি কোনো দেশ ১৫ মিটার উঁচু ও কমপক্ষে ৩০ লাখ ঘনমিটার পানি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জলাধার নির্মাণ করতে চায়, তবে ওই প্রকল্প অবশ্যই ভাটির দেশগুলোর সরকারের কাছেই নয়, অববাহিকার ওপর নির্ভরশীল জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখের উচ্চতা হবে ১৬৩ মিটার এবং জলাধারের ধারণক্ষমতা দেড় কোটি ঘনমিটার। এর পরও ভাটির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ওই প্রকল্প নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে ভারত আগ্রহ দেখায়নি (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১২ ডিসেম্বর, ২০১১)।
নিকটবর্তী এক অঞ্চল থেকে অপর অঞ্চলে যেতে ভূমিকম্প কিংবা সুনামির কোনো পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। এগুলো মূলত প্রাকৃতিক কিংবা ভৌগোলিক ব্যাপার। দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে অঞ্চলে আমাদের অবস্থান, তার অতীত ইতিহাসে উলি্লখিত ভূখণ্ডের ভূমিকম্প কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণতার সাক্ষ্য বহন করে। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের যে স্থানটিতে টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের দূরত্ব এক শ মাইলের বেশি বলে উল্লেখ করা হলেও ভূমিকম্প কিংবা সুনামির জন্য সেটি কোনো প্রতিবন্ধকতাই নয়। ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও শ্রীলঙ্কার বিগত সুনামির ঘটনা সে কথাই প্রমাণ করে। ঝুঁকিপূর্ণ এ অঞ্চলের অতিসংবেদনশীল ভূ-প্রকৃতিতে তাই সু-উচ্চ বাঁধ দিয়ে কিংবা গভীর জলাধার নির্মাণ করে মহাবিপদের আশঙ্কা আরো বাড়ানো আমাদের জন্য অনুচিত হবে। তার বদলে সে রাজ্যে কিংবা অঞ্চলে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য খনিজ কয়লা অথবা অন্যান্য বিকল্প সূত্রের সন্ধান করাই নিরাপদ ও সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। নতুবা ভূ-প্রকৃতির প্রতি অভাবিত ও নির্দয় আচরণ অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ভূ-প্রকৃতির প্রতিশোধ অত্যন্ত নিষ্ঠুর হতে দেখা গেছে। তাই বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মূল স্লোগান হচ্ছে, 'প্রাপ্যতা অনুযায়ী নদীর পানি বিভিন্ন কাজে যথাসম্ভব ব্যবহার করো; কিন্তু তার স্রোতধারাকে বাধাগ্রস্ত করো না। নদ-নদীকে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জলাধারকে স্বাধীনভাবে প্রবাহিত হতে দাও, তাদের ওপর বাঁধ নির্মাণ করে বাধাগ্রস্ত করা চলবে না। তাতে চরম খরা কিংবা বন্যায় অন্যরা নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।' আন্তর্জাতিকভাবে অতীতে নীল নদের বাধাহীন প্রবাহ নিয়ে মিসর, সুদান ও ইথিওপিয়ার মধ্যে বিরোধ বেধেছে, দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং এমনকি মেক্সিকোর মধ্যে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর মুক্ত প্রবাহ নিয়ে বিরোধ জটিল আকার ধারণ করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুবিবেচনার ফলে বাঁধ নির্মাণ পর্যন্ত এগোয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেকং নদীর পানির হিস্যা নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ জাতিসংঘ পর্যন্ত গড়িয়েছিল নিষ্পত্তির জন্য।
আন্তর্জাতিক বা অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি কিংবা সেসব নদীতে একতরফাভাবে কোনো পক্ষের বাঁধ নির্মাণগত সমস্যা কোনো না কোনোভাবে শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়ে যায়। শুধু অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো আলোচনাই এ পর্যন্ত সফল হতে দেখা যায়নি। সব কিছুই যেন বছরের পর বছর শুধু ঝুলতে থাকে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যগুলো একতরফাভাবে এমন অনেক সিদ্ধান্তই নিয়ে নেয়, যা বাংলাদেশে পানিপ্রবাহ এবং তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুরুতর সংকট হয়ে দাঁড়ায়। তারা শুধু মুখে বলে, ভারত এমন কিছুই করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখন পর্যন্ত তারা এমন কিছুই করেনি, যাতে বাংলাদেশের লাভ হয়েছে। অভিন্ন গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিই কি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ নয়? ফারাক্কা ও প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হতে পারে; কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ভারত অভিন্ন নদীর ওপর কোনো আলোচনা ছাড়াই একটার পর একটা বাঁধ নির্মাণ করে যাবে আর বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা ভারত সফর করে এসে বলবেন, 'আসলে বিষয়টি নিয়ে আমাদের আবেগপ্রবণ হলে চলবে না। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে হবে কিভাবে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মাণ করলে আমাদের ক্ষতি হবে না।' তবুও এ কথাটি তারা কেউ বলে না যে অভিন্ন নদীর ওপর কোনো বাঁধই নির্মাণ করা যাবে না। একমাত্র তাহলেই বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। হেলসিঙ্কি সনদে বলা আছে, উজানের দেশ এমন কিছুই করতে পারে না, যার নেতিবাচক প্রভাব ভাটির দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ে। কিন্তু ভারতের প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের জন্য পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। বিশ্বের আবহাওয়া ও জলবায়ু শুধু একমাত্র কার্বন নিঃসরণের কারণেই হুমকির মুখে পড়েনি, নদ-নদীর প্রবাহ ও তার ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে না হলে পরিবেশ, ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে বিশ্ব ধ্বংসের মুখে পড়ে যাবে। বন্যা, ঘূর্ণি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মরুকরণ প্রক্রিয়া, খরাসহ এমন কোনো দুর্যোগ নেই ভূ-প্রকৃতি যার শিকার হবে না। বাংলাদেশে ফারাক্কার কারণে পদ্মার আশপাশে বিভিন্ন ছোট নদীনালা ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। রাজশাহী অঞ্চলে যখন শুরু হয়েছে মেরুকরণ প্রক্রিয়া, খুলনার সুন্দরবন অঞ্চলে তখন বৃদ্ধি পেয়েছে লবণাক্ততা। পানির অভাবে তিস্তা প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। আর টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বৃহত্তর সিলেটসহ সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকার তিন কোটি মানুষ সম্মুখীন হবে আরেক নতুন বিপর্যয়ের। তাই সর্বত্র দাবি উঠেছে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে জাতিসংঘের অধীনে একটি পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিকবিষয়ক যৌথ সমীক্ষা চালানোর। তার আগে টিপাইমুখসহ অভিন্ন নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ, জাতীয় সব প্রকল্প বন্ধ রাখতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের সব রাজনৈতিক দল, পরিবেশ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প এলাকা ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁদের মতে, ওই প্রকল্পের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি মানুষের ওপর। আমার বন্ধু এবং জাতিসংঘের সাবেক পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. এস আই খান ছয় বছর ধরে এ কথাগুলো বলে আমাদের আগাম হুঁশিয়ার করেছেন। তখন থেকেই আমরা এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও কলাম লেখা শুরু করি। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের আসাম ও মণিপুরসহ 'সপ্ত কন্যা' (সাতটি রাজ্য) এবং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গত এক শ বছরের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ড. খান বহু আগেই বলেছিলেন, এই এলাকায় অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। তিনি বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধে ৫০০ ফুট গভীর জলাধার নির্মাণ করা হলে সেখানে প্রতি বর্গমিটারে ১৬০ টন চাপ সৃষ্টি হবে, যা ওই অঞ্চলে ভূমিকম্পের আরো বেশি আশঙ্কা সৃষ্টি করবে। মণিপুরে বরাক নদের ওপর বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে অতি দ্রুত এগোচ্ছে ভারত। তার মতে এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন ও সনদ অনুযায়ী ভাটির দেশে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে এমন কিছু উজানের দেশ অভিন্ন নদ-নদীতে করতে পারে না। সম্প্রতি তিনি আরো বলেছেন, 'ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন অন ড্যামস' অনুযায়ী অভিন্ন নদ-নদীর ওপর যদি কোনো দেশ ১৫ মিটার উঁচু ও কমপক্ষে ৩০ লাখ ঘনমিটার পানি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জলাধার নির্মাণ করতে চায়, তবে ওই প্রকল্প অবশ্যই ভাটির দেশগুলোর সরকারের কাছেই নয়, অববাহিকার ওপর নির্ভরশীল জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখের উচ্চতা হবে ১৬৩ মিটার এবং জলাধারের ধারণক্ষমতা দেড় কোটি ঘনমিটার। এর পরও ভাটির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ওই প্রকল্প নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে ভারত আগ্রহ দেখায়নি (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১২ ডিসেম্বর, ২০১১)।
নিকটবর্তী এক অঞ্চল থেকে অপর অঞ্চলে যেতে ভূমিকম্প কিংবা সুনামির কোনো পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। এগুলো মূলত প্রাকৃতিক কিংবা ভৌগোলিক ব্যাপার। দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে অঞ্চলে আমাদের অবস্থান, তার অতীত ইতিহাসে উলি্লখিত ভূখণ্ডের ভূমিকম্প কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণতার সাক্ষ্য বহন করে। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের যে স্থানটিতে টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের দূরত্ব এক শ মাইলের বেশি বলে উল্লেখ করা হলেও ভূমিকম্প কিংবা সুনামির জন্য সেটি কোনো প্রতিবন্ধকতাই নয়। ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও শ্রীলঙ্কার বিগত সুনামির ঘটনা সে কথাই প্রমাণ করে। ঝুঁকিপূর্ণ এ অঞ্চলের অতিসংবেদনশীল ভূ-প্রকৃতিতে তাই সু-উচ্চ বাঁধ দিয়ে কিংবা গভীর জলাধার নির্মাণ করে মহাবিপদের আশঙ্কা আরো বাড়ানো আমাদের জন্য অনুচিত হবে। তার বদলে সে রাজ্যে কিংবা অঞ্চলে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য খনিজ কয়লা অথবা অন্যান্য বিকল্প সূত্রের সন্ধান করাই নিরাপদ ও সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে। নতুবা ভূ-প্রকৃতির প্রতি অভাবিত ও নির্দয় আচরণ অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ভূ-প্রকৃতির প্রতিশোধ অত্যন্ত নিষ্ঠুর হতে দেখা গেছে। তাই বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মূল স্লোগান হচ্ছে, 'প্রাপ্যতা অনুযায়ী নদীর পানি বিভিন্ন কাজে যথাসম্ভব ব্যবহার করো; কিন্তু তার স্রোতধারাকে বাধাগ্রস্ত করো না। নদ-নদীকে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জলাধারকে স্বাধীনভাবে প্রবাহিত হতে দাও, তাদের ওপর বাঁধ নির্মাণ করে বাধাগ্রস্ত করা চলবে না। তাতে চরম খরা কিংবা বন্যায় অন্যরা নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।' আন্তর্জাতিকভাবে অতীতে নীল নদের বাধাহীন প্রবাহ নিয়ে মিসর, সুদান ও ইথিওপিয়ার মধ্যে বিরোধ বেধেছে, দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং এমনকি মেক্সিকোর মধ্যে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর মুক্ত প্রবাহ নিয়ে বিরোধ জটিল আকার ধারণ করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুবিবেচনার ফলে বাঁধ নির্মাণ পর্যন্ত এগোয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেকং নদীর পানির হিস্যা নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ জাতিসংঘ পর্যন্ত গড়িয়েছিল নিষ্পত্তির জন্য।
আন্তর্জাতিক বা অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি কিংবা সেসব নদীতে একতরফাভাবে কোনো পক্ষের বাঁধ নির্মাণগত সমস্যা কোনো না কোনোভাবে শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়ে যায়। শুধু অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো আলোচনাই এ পর্যন্ত সফল হতে দেখা যায়নি। সব কিছুই যেন বছরের পর বছর শুধু ঝুলতে থাকে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যগুলো একতরফাভাবে এমন অনেক সিদ্ধান্তই নিয়ে নেয়, যা বাংলাদেশে পানিপ্রবাহ এবং তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুরুতর সংকট হয়ে দাঁড়ায়। তারা শুধু মুখে বলে, ভারত এমন কিছুই করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখন পর্যন্ত তারা এমন কিছুই করেনি, যাতে বাংলাদেশের লাভ হয়েছে। অভিন্ন গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিই কি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ নয়? ফারাক্কা ও প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হতে পারে; কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ভারত অভিন্ন নদীর ওপর কোনো আলোচনা ছাড়াই একটার পর একটা বাঁধ নির্মাণ করে যাবে আর বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা ভারত সফর করে এসে বলবেন, 'আসলে বিষয়টি নিয়ে আমাদের আবেগপ্রবণ হলে চলবে না। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে হবে কিভাবে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মাণ করলে আমাদের ক্ষতি হবে না।' তবুও এ কথাটি তারা কেউ বলে না যে অভিন্ন নদীর ওপর কোনো বাঁধই নির্মাণ করা যাবে না। একমাত্র তাহলেই বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। হেলসিঙ্কি সনদে বলা আছে, উজানের দেশ এমন কিছুই করতে পারে না, যার নেতিবাচক প্রভাব ভাটির দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ে। কিন্তু ভারতের প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের জন্য পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। বিশ্বের আবহাওয়া ও জলবায়ু শুধু একমাত্র কার্বন নিঃসরণের কারণেই হুমকির মুখে পড়েনি, নদ-নদীর প্রবাহ ও তার ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে না হলে পরিবেশ, ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে বিশ্ব ধ্বংসের মুখে পড়ে যাবে। বন্যা, ঘূর্ণি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মরুকরণ প্রক্রিয়া, খরাসহ এমন কোনো দুর্যোগ নেই ভূ-প্রকৃতি যার শিকার হবে না। বাংলাদেশে ফারাক্কার কারণে পদ্মার আশপাশে বিভিন্ন ছোট নদীনালা ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। রাজশাহী অঞ্চলে যখন শুরু হয়েছে মেরুকরণ প্রক্রিয়া, খুলনার সুন্দরবন অঞ্চলে তখন বৃদ্ধি পেয়েছে লবণাক্ততা। পানির অভাবে তিস্তা প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। আর টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বৃহত্তর সিলেটসহ সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকার তিন কোটি মানুষ সম্মুখীন হবে আরেক নতুন বিপর্যয়ের। তাই সর্বত্র দাবি উঠেছে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে জাতিসংঘের অধীনে একটি পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিকবিষয়ক যৌথ সমীক্ষা চালানোর। তার আগে টিপাইমুখসহ অভিন্ন নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ, জাতীয় সব প্রকল্প বন্ধ রাখতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের সব রাজনৈতিক দল, পরিবেশ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com
No comments