আচারের উৎসব by রুহিনা তাসকিন

গান, নাচ, তারকাদের অংশগ্রহণ—সবই ছিল। জমকালো মঞ্চ সাজানো ছিল বিজয়ীকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
সবকিছু ছাপিয়ে এই অনুষ্ঠানে বড় হয়ে উঠল আজকের নারীর অগ্রযাত্রার কথাই। নিজের হাতে যত্ন নিয়ে বানানো আচার দিয়েই তাঁরা জয় করলেন বিচারকদের মন, জিতে নিলেন নানা পুরস্কার। তবে বাজিমাত কথাটার প্রয়োগ যে কেমন হতে পারে, ঢাকার আফরোজা সালাম সেটা দেখিয়ে দিলেন সারা দেশকে। প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে জিতে
নিলেন দুই লাখ টাকা। প্রাণ-প্রথম আলো জাতীয় আচার প্রতিযোগিতার বর্ষসেরা হয়ে তাঁর এই অর্জন। প্রতিযোগিতার যুগপূর্তিটা স্মরণীয় করে রাখলেন নিজের মতো করে।
৯ ডিসেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে হয়ে গেল প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। সারা দেশ থেকে আসা নারীদের অংশগ্রহণে দুপুর থেকেই জমজমাট ছিল মিলনায়তন। তাঁদের অর্জন উদ্যাপন করার জন্য এটাই তো সেরা দিন, বেগম রোকেয়া দিবস।
শুরুটা হলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নারী বাউলদের গান দিয়ে। ‘মিলন হবে কত দিনে’র সুরে ভরে উঠল মিলনায়তন। এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন ফরিদা পারভীন। শুরুটা যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিল। বাউল সুরের রেশ কাটতে না-কাটতেই নিভে গেল মঞ্চের আলো। বিজয়ের মাসে বিজয়ের আনন্দের আগের অন্ধকার সময়কে স্মরণ করতেই বোধ হয়। মঞ্চে এলেন শখ ও সোহেল। ‘আজি বাংলাদেশের হূদয় হতে’ এবং ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ গানের তালে নাচ পরিবেশন করলেন তাঁরা।
শুরু হয়ে গেল আনুষ্ঠানিকতা। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীনের আহ্বানে মঞ্চে এলেন অভিনয়শিল্পী ফজলুর রহমান বাবু। এলেন তাঁর স্ত্রী রুকসানা রহমানও। জানা গেল, তিনিও ভালো আচার বানাতে পারেন। সে গ্যারান্টি দিলেন বাবু স্বয়ং। কথোপকথন হলো, তবে গান না হলে কি চলে! ‘নিধুয়া পাথারে’ বন্ধুকে ডাক দিতেই হলো বাবুকে।
সঞ্চালক জানালেন, এবার আসবে ‘ক্ষুদে গানরাজ’ পড়শী। স্কার্ট পরা পড়শীকে যতই খুদে দেখাক, গানে সে টক্কর দিতে পারে যে কাউকেই। অসুস্থতা নিয়ে এসেও দর্শকদের মাতায় ‘তোমারই পরশ’ গানের সুরে।
এবার আরেক প্রজন্মের শিল্পীর পালা। এলেন ফাতেমা-তুজ-জোহরা। আচার আর গানের পার্থক্য কী? উত্তরও জানালেন, দুটোই সুস্বাদু, কোনো পার্থক্য নেই। ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ গানটির পর শোনালেন ‘আমি পুরব দেশের পুরনারী’। জানালেন, সারা দেশের মেয়েদের উৎসাহ বাড়াতেই এই গান।
এবার দেখা দেওয়ার পালা ঝলমলে বিচারকদের। ‘লিনু এখনো আছেন ২০ বছর আগের মতোই।’ উপস্থাপকের কথা যে একদম ঠিক, সেই মিষ্টি হাসি, ফ্যাশনেবল চুল, স্নিগ্ধ সাজে খুঁজে পাওয়া গেল আগের সেই টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন জোবেরা রহমান লিনুকেই। ফারহানা এ রহমান পেলেন বিশেষ হাততালি। তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করে সাফল্য পাওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর মা হিসেবে সংগ্রাম করার কথাটাও। অটিস্টিক শিশুর মা হয়েও ভেঙে পড়েননি তিনি। শক্ত হাতে সামলেছেন পরিবার আর ব্যবসা—দুটোই।
এক রান্নার অনুষ্ঠান করেই মানুষের এত ভালোবাসা পাওয়া যায়, তা বোঝা গেল শারমিন লাকীর জন্য দর্শকদের হাততালি দেখে। এক এক করে মঞ্চে আসেন রান্নাবিদ মিলা মঞ্জুষা, সংগীতশিল্পী ফাতেমা-তুজ-জোহরা, কনা, অনিমা রায়, অভিনয়শিল্পী সোহানা সাবা, মডেল নাবিলা। তাঁরা জানালেন আচার বিচারের অনুভূতি। মঞ্চ থেকে নামার শুরুটা করলেন নাবিলাই। দর্শকদের দেখিয়ে দিলেন তাঁর ক্যাটওয়াকের একঝলক। কনাকে থাকতে হলো মঞ্চেই।
গান শোনানোর পালা তাঁর। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ আর ‘প্রজাপতি’ গান দুটি হলো। ‘কেউ ওয়ান মোর বললেই আর একটা গান গেয়ে ফেলব,’ কনার এমন কথার পর আর চুপ করে থাকা যায়! এবার কনা শোনালেন তাঁর সিম্পলি কনা অ্যালবামের ‘ধিনতানা’ গানটি। সারা বাংলাদেশের নারীরা এখানে এসেছেন, তাঁদের জন্যই এ বিশেষ উপহার, জানালেন কনা।
বিচারক ছিলেন, তবে অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি চলচ্চিত্র তারকা মৌসুমী, রান্নাবিদ কল্পনা রহমান আর সংবাদপাঠক মিশু রহমান। শুটিংয়ের ফাঁকে এসে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলেন অভিনয়শিল্পী সুমাইয়া শিমু।
অনুষ্ঠানে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী নিজের বক্তব্যে শোনালেন আশার কথা, ‘একদিন এই আচার সারা বিশ্বে বাংলাদেশের খাদ্য-ঐতিহ্য তুলে ধরবে।’ সবাই মিলে আলোকিত, নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানালেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান খান চৌধুরী মঞ্চে এসে বললেন, ‘আচার বানানোর এই চর্চা যেন অব্যাহত থাকে। আমাদের অনুষ্ঠানে আপনারা আসবেন, আমাদের আচার বানানো শেখাবেন।’
শুভেচ্ছা জানালেন গ্রুপের পরিচালক উজমা চৌধুরীও।
প্রধান অতিথি ফরিদা পারভীন, অথচ গান হবে না, তা কি হয়! বিজয়ের মাস, তাই গাইলেন দেশের গান ‘এই পদ্মা এই মেঘনা...’।
এবার শুরু হলো সবচেয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত পর্ব। কে জিতেছেন দুই লাখ টাকার বর্ষসেরা আচার পুরস্কার—জানিয়ে দিয়েছি আগেই। ঝাল, টক, মিষ্টি ও অন্যান্য বিভাগে মোট চারটি করে ১২টি পুরস্কার জিতে নিলেন দেশের নানা প্রান্তের প্রতিযোগীরা। তাঁরা পেলেন ঢাকা-মালয়েশিয়া-ঢাকা বিমান টিকিট, ল্যাপটপ ও আইপিএস। তাঁদের হাতে ক্রেস্ট ও পুরস্কার তুলে দিলেন ফরিদা পারভীন, মতিউর রহমান ও আমজাদ খান চৌধুরী। আরও ৩৫ জন পেলেন সনদ ও শুভেচ্ছা পুরস্কার।
দিনের শেষে মিলনমেলা ভাঙল, তবে মমতা দিয়ে যাঁরা ঐতিহ্যকে ধরে রাখছেন, সেই আচারশিল্পীরা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন বিচারক আর অতিথিদের সঙ্গে ছবি তোলায়। একজন বিজয়ী এসে বললেন, মঞ্চে অনুভূতি জানাতে পারেননি, কান্না পাচ্ছিল। সম্প্রতি বাবাকে হারিয়ে আজ পুরস্কার হাতে তাঁর কথাই মনে হচ্ছে বারবার...।

বিজয়ী হলেন যাঁরা
বর্ষসেরা
আফরোজা সালাম, উত্তর বাড্ডা, গুলশান, ঢাকা।

টক বিভাগ
প্রথম: মোমেনা খাতুন, নারান্দিয়া, তিতাস, কুমিল্লা।
দ্বিতীয়: নার্গিস আমিন, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
তৃতীয়: আফরোজা আক্তার, মুন্সিপাড়া, খুলনা।

মিষ্টি বিভাগ
প্রথম: বেগম মাহমুদা রুবাইয়া, উপশহর, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট, রাজশাহী। দ্বিতীয়: রাবেয়া খাতুন, মহাখালী ওয়্যারলেস গেট, ঢাকা।
তৃতীয়: মাহতাবুন নাহার, মিরপুর, ঢাকা।

ঝাল বিভাগ
প্রথম: হোসনে আরা জাহান, ধানমন্ডি ২/এ, ঢাকা।
দ্বিতীয়: সুমাইয়া তাহসীন, মগবাজার, ঢাকা।
তৃতীয়: মর্জিনা আলম, সোবহানবাগ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

অন্যান্য বিভাগ
প্রথম: দিলরুবা বেগম, মিঠাপুকুর, রংপুর।
দ্বিতীয়: নুসরাত জাহান, মতিঝিল, ঢাকা।
তৃতীয়: রিজিয়া সুলতানা, কাদিরাবাদ হাউজিং, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.