ব্যবস্থাপনার কালান্তর-মেধাবী কর্মীর স্বীকৃতি দিতে হবে by ইফতেখারুল ইসলাম

র্ব-২ : নবীন ব্যবস্থাপনা প্রজন্মের প্রস্তুতিপর্ব এ কথা ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে যে বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে বাংলাদেশেও। এই অগ্রগতির পেছনে নবীন কর্মীদের অদম্য আগ্রহ সবচেয়ে বড় শক্তি। এ ছাড়া শিল্প ও বাণিজ্যের দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের লাভজনক ব্যবসা বিস্তারের স্পৃহা ও নিরলস উদ্যোগ যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি সক্রিয় রয়েছে মোটামুটি মানসম্মত ব্যবস্থাপনা-শিক্ষার ব্যাপক


প্রসার। শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে আগেও আমাদের দেশে বৈষম্য ছিল, এখন তা আরো বৃদ্ধিপেয়েছে।মূলতমহানগরকেন্দ্রিক অসংখ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার ফলে শিক্ষার ব্যয় বেড়েছে এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ভিন্ন ধাঁচের একটি উচ্চশিক্ষিত শ্রেণী তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি ও শিক্ষা পদ্ধতি প্রায় অভিন্ন হলেও ইতিমধ্যেই অন্যান্য দেশের মতো তৈরি হয়েছে কয়েকটি আলাদা মান-স্তর। এ রকম অর্ধশতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার কারণে অন্তত প্রথম সারির কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার উৎকর্ষতা অর্জনের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা স্নাতকদের মধ্যেও কর্মসংস্থান ও উপার্জনের পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক স্তরে এই শ্রেণী-বিভাজন অদূরভবিষ্যতে আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। তবে অধিকাংশ মধ্য-মেধার নবীন কর্মীদের ভেতর থেকে কেউ কেউ নিজস্ব সৃজনশীলতা ও দক্ষতার সাহায্যে সহজেই নিজের স্বাতন্ত্র্য ও উজ্জ্বলতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য-ব্যবস্থাপনা অথবা প্রযুক্তিগত ডিগ্রি, পাঠ্যসূচির ভিন্নতা সত্ত্বেও আমাদের পূর্বতন যুগের সাধারণ স্নাতকদের প্রায় সমমানের শিক্ষা এবং প্রয়োগ-ক্ষমতা তৈরি করে। সে কারণেই কর্মক্ষেত্রে বেতন-ভাতা ও দায়িত্ব নির্ধারণে তাঁদের মূল্যায়ন হয় অনুরূপ পর্যায়ে।
সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যে বিপুলসংখ্যক স্নাতক প্রতিবছর কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন শাখায় প্রবেশ করেন, বয়োজ্যেষ্ঠ বা অধিকতর সফল ব্যবস্থাপকদের কাছে তাঁদের দুটি সাধারণ জিজ্ঞাস্য থাকে। প্রথমত কিভাবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দ্রুত সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। আর দ্বিতীয়ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কী কী পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে এবং কিভাবে সেগুলোকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করা যাবে। এ দুটি প্রশ্ন আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও এর উত্তর প্রকৃতপক্ষে বেশ জটিল এবং অন্য অনেক পরিবর্তনশীল উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। তবু আমরা এ দুটি প্রশ্নকে একত্রে বিবেচনা করে এর সাধারণ উত্তর অন্বেষণ করব। যদি আমরা অন্তত ধরে নিই যে প্রতিটি কার্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে একই রকম প্রশাসনিক ন্যায়নীতি ও সম-সুযোগ কার্যকর রয়েছে, তাহলেই এ প্রশ্নগুলোর সাধারণ উত্তর খোঁজা এবং তা থেকে শিক্ষণীয় কিছু গ্রহণ করা অর্থপূর্ণ হবে। কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ সাফল্য অর্জনের জন্য অন্ততপক্ষে তিনটি মৌলিক বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সেগুলো হলো :
১. নিজের পঠিত বিষয়ে নিবিড় জ্ঞান
২. নিজস্ব সৃজনশীলতা ও আত্মবিকাশের আগ্রহ
৩. নিজের ও অপরাপর শাখার সহকর্মীদের সঙ্গে দলগতভাবে কাজ করার সামর্থ্য
মনে রাখতে হবে এগুলো একেবারেই প্রাথমিক প্রস্তুতি; এর মাধ্যমে নিজের সাফল্য হয়তো অর্জন করা সম্ভব কিন্তু তাতে ব্যবস্থাপনার বর্তমান তাত্তি্বক সংকট নিরসন এবং অনাগতকালের উপযোগী করে ব্যবস্থাপনার পুনরাবিষ্কার অথবা এর আঙ্গিকের নবনির্মাণ সম্ভব নয়। সে কাজে যাঁরা ব্রতী হবেন তাঁদের প্রস্তুতিপর্বে এই মৌলিক বিষয়গুলোর গুরুত্ব রয়েছে।

পড়ালেখা শেষ অথবা শুরু?
জীবন ও জগতের বাস্তব পরীক্ষাগুলো ওপেন-বুক, যার অর্থ হলো, বই খুলে দেখে উত্তর দেওয়ার সুযোগ আছে। ঢাকার আইবিএতে পাঠদান ও ছাত্র-মূল্যায়নের জন্য কোনো কোনো অধ্যাপক এ পদ্ধতি অনুসরণ করতেন, তবে সেসব পরীক্ষার প্রশ্ন হতো জটিল ধরনের, যাতে বই খুলে সরাসরি উত্তর পাওয়া যেত না। যা-ই হোক, ছাত্রজীবনের বাইরে বাস্তব জগতে বইপত্রের সাহায্য নিয়ে বা অন্যের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে বই দেখে কোনো সমাধান খুঁজতে হলে সঠিক বইগুলো সম্পর্কে জানতে হবে এবং সেখানকার সারবস্তু, কোথায় কোন জিনিসটি পাওয়া যাবে সে বিষয়ে থাকতে হবে স্পষ্ট ধারণা ও পূর্ব-পরিচিতি। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে গতানুগতিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফল ভালো-মন্দ যা-ই হোক না কেন, অধীত বিষয়গুলোর সাধারণ ধারণা এবং সে সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব, তথ্য ও গ্রন্থাবলির ব্যাপারে নিবিড় অভিজ্ঞান লাভ করা অপরিহার্য। প্রকৌশল, ফার্মেসি, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা, বিপণন, অর্থ, হিসাব-বিজ্ঞান, মানব-সম্পদ_যেকোনো বিষয়েই পড়াশোনা হোক, তার মৌলিক বিষয়গুলো কর্মক্ষেত্রে নতুন করে পড়ানো হয় না। ধরে নেওয়া হয় যে নবনিযুক্ত কর্মী তাঁর বিষয়ের সম্যক জ্ঞান অর্জন করেই এসেছেন। সুতরাং এ বিষয়ে কোনো অসম্পূর্ণতা থাকলে একজন সদ্য নিয়োজিত কর্মী নিজ উদ্যোগেই তা পূর্ণ করার দায়িত্ব নেবেন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এই সম্পূর্ণতা অর্জন করতে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করে এবং বাধ্য করে তারা তাদের ছাত্রদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অধিকতর সফল ও সুপরিচিত। কিন্তু একজন স্নাতক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসার পর এই মৌলিক অসম্পূর্ণতার জন্য আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে ফিরে যেতে পারেন না।
ছাত্রজীবন শেষে অনেকেরই একটি সাধারণ প্রত্যাশা হলো এই যে তাঁরা 'পড়াশোনা শেষ' করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন। দুঃখের বিষয়, এ ধারণাটি অসম্পূর্ণ। কারণ প্রকৃতপক্ষে তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক এবং পাঠ্য বইকেন্দ্রিক সীমিত পড়াশোনার পর্যায় ছেড়ে প্রবেশ করছেন ব্যাপকতর পাঠ ও গভীরতর জ্ঞান অন্বেষণের কঠোর ও সুদীর্ঘ পর্বে। ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিটি বিশেষায়িত শাখায় তাত্তি্বক ও ব্যবহারিক জ্ঞান দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত ও প্রসারিত হচ্ছে। সুতরাং এই বিষয়গুলোতে বৈদ্যুতিক মাধ্যমে ও মুদ্রিত অক্ষরে প্রকাশিত সব সাম্প্রতিক রচনা সম্পর্কে অবহিত থাকা এবং কিছু নির্বাচিত বিষয়ে গভীর অভিজ্ঞান অর্জন অব্যাহত রাখতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। কর্মজীবন তাই অবারিত স্বাধীনতার স্বাদ দেয় না; বরং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে ব্যবস্থাপনা-সংস্কৃতির বেদিমূলে এ এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদি আত্মনিবেদন ও কারাবাস। যাঁরা নিবেদিত ও মেধাবী কর্মী হিসেবে ব্যবস্থাপনার উচ্চতর সোপানে পা রাখতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য রয়েছে এই শোক সংবাদ যে শ্রেয়তর কর্মকুশলতার জন্য তাঁদের সশ্রম কারাবাসের মেয়াদ হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এ ধরনের আত্মনিবেদিত কর্মী প্রতিষ্ঠানের কাছে অতি মূল্যবান। কিন্তু আজও, অন্তত বাংলাদেশে এমন উচ্চপদস্থ ব্যবস্থাপক রয়ে গেছেন, যাঁরা নবীন মেধাবী কর্মকর্তাকে অধিকতর দায়িত্ব ও মর্যাদা দিতে নানা কারণে কুণ্ঠাবোধ করেন। তাঁরা মেধাবী কর্মীর কুশলতাটুকু আত্মস্বার্থে ব্যবহার করতে চান, যথাসম্ভব কম স্বীকৃতি দিয়ে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সুদূরপ্রসারী সাফল্যের জন্য মেধার স্বীকৃতি, বিকাশ এবং ধরে রাখার চেষ্টা অপরিহার্য। মেধাবিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণ শুধু মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব নয়। এর জন্য চাই সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রতিষ্ঠানের সব বিভাগের সক্রিয় সমর্থন।
[চলবে]

লেখক : ফার্মাসিস্ট এবং বাণিজ্য ব্যবস্থাপক, একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.