কুয়াকাটার আমন্ত্রণ by কাজী আলিম-উজ-জামান

কার্তিকের মাঝামাঝি, ভর হেমন্ত। সিদ্ধান্ত নিলাম, লঞ্চে যাব না, কুয়াকাটা যাব সড়কপথে। সড়কের দুপাশের সবকিছু—গাছ, মাঠ, ধান, জলাভূমি—দেখা তো যাবে। সকাল নয়টায় সায়েদাবাদ থেকে ছাড়ল বাস। বাস যাবে কলাপাড়ায়। পথ বড় বেহাল, বিশেষ করে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত, প্রকৃতি দেখার আর ফুরসত কই? কলাপাড়ায় যখন পৌঁছালাম, তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।


জানতাম না যে এখান থেকে কুয়াকাটা পৌঁছাতে আরও তিনটি ফেরি পার হতে হবে। আর এই পথটুকু যেতে হবে লোকাল বাসে।
তাতে কী! ঘন অন্ধকার, সঙ্গী তখন রাতের তারা। প্রথম নদীটার নাম আন্ধারমানিক। কী ভয় মেশানো নাম!
বাস চলছে। থামছে। লোক উঠছে, আবার নামছে। কী বিরক্তিকর!
অবশেষে পৌঁছালাম কুয়াকাটায়, তখন রাত নয়টা। থাকার জায়গা সড়ক ও জনপথের অতিথিশালা। দোতলার একটি ঘরে ঠাঁই হলো। বেশ বড়সড়, খোলা বারান্দা।
রাতেই হালকা পোশাকে বের হলাম সৈকতে। সাগরের কাছে গেলাম। শান্ত সাগর। ঘণ্টা খানেক বসে থেকে এরপর পথে ডাবের পানি খেয়ে ফিরলাম।
খুব ভোরে উঠে সূর্যোদয় দেখতে হবে, তাই আগে আগে ঘুম। সেই মতো ভোরে ওঠা এবং ক্যামেরা হাতে নিয়ে সৈকতে ছুটে চলা। আকাশটা যেন কেমন, একটু কুয়াশার ভাব, মেঘলামতো। কে যেন বলল, পূর্ব প্রান্তে সূর্যোদয় ভালো দেখা যায়। ছুটলাম সেদিকে। কিন্তু ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সৈকতে কতটা পূবদিকে যেতে হবে, তা বুঝতে পারলাম না। ছুটছি ঊর্ধ্বশ্বাসে, অজানার উদ্দেশ্যে!
আচমকাই দেখা গেল গোল থালার মতো লাল সূর্য উঠে গেছে। ইশ্, সূর্যোদয়ের দৃশ্যটা দেখা হলো না পুরোপুরি। কী আর করা! যাক, এর পরে কোনো দিন নিশ্চয় দেখা হবে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। যা আছে তাই নিয়ে থাকাই তো ভালো।
সূর্য উঠছে। রবির কিরণ ছড়িয়ে পড়ছে। আহা, এবার আমি নির্ভার, নেই কোনো উদ্বেগ। দেখি এবার দুচোখ ভরে এই জলরাশি, এই প্রভাতের আকাশ, এই কুয়াকাটা।
সৈকতে প্রচুর নারকেলগাছ। আগে নাকি ছিল আরও বেশি। কিছু কিছু জায়গায় নারকেলগাছের গোড়ার অবশিষ্টাংশ জানান দিল সে কথা। প্রচুর কাঁকড়া সৈকতে। চোখে পড়ল ইলিশ মাছ ধরার জন্য জেলেদের সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি। একটা ছোট্ট ছেলে কিছু চিংড়ির পোনা এক হাঁড়ি থেকে আরেক হাঁড়িতে রাখছে, গুনে গুনে।
নাশতাপর্ব শেষে এবার কুয়াকাটার অন্য সব দেখার পালা। গেলাম রাখাইন বসতি কেরানিপাড়ায়। এখানে একটি বড় মন্দির আছে। মন্দিরে আছে ৩৭ মণ ওজনের অষ্টধাতুর ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি। জানা গেল, কিছুদিন আগেই সংস্কার হয়েছে এর।
এই কেরানীপাড়াতেই সেই বিখ্যাত কুয়া, যা থেকে নাম হয়েছে কুয়াকাটা। কেরানীপাড়ার রাখাইনপল্লিটা ঘুরে দেখলাম। তরুণীরা ঘরের দাওয়ায় বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। কেউ বুনছেন জাল।
মন্দির থেকে বের হয়ে মিশ্রিপাড়ায় যাওয়ার কথা ভাবলাম। কুয়াকাটা থেকে সাত কিলোমিটার দূরে এই মিশ্রিপাড়া। সেখানে নাকি রাখাইনদের তৈরি কাপড়চোপড় মেলে।
যাওয়া হলো না। গেলাম পূর্ব দিকে ইকোপার্কে। ভ্যানে-মোটরসাইকেলে—দুভাবেই যাওয়া যায়। আর হেঁটে গেলে এক ঘণ্টার মতো। নানা ধরনের দেশি ফলের গাছ এই ইকোপার্কে। আছে কত ধরনের পাখি। সরুপথ দিয়ে হাঁটছিলাম। গ্রামের বালিকারা তেঁতুল পাড়ছে।
ইকোপার্ক থেকে সৈকত খুব কাছে। তাই আবার গেলাম সৈকতে। এবার তার অন্য রূপ। ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতের অনেক দূর পর্যন্ত। পানিতে নেমে দাপাদাপি চলল বেশ কিছুক্ষণ। দূরে দেখা গেল একদল ছেলে ক্রিকেট খেলছে। ইচ্ছা হলো ওদের সঙ্গে ভিড়ি, মেরে দিই একটা ছক্কা।
এই সুযোগে বলে রাখি, কুয়াকাটা প্রকৃতপক্ষে একটা গ্রামের নাম। ইউনিয়নের নাম লতাচাপলি। উপজেলা কলাপাড়া। আর জেলা যে পটুয়াখালী, সেটা কে না জানে। সেই গ্রাম কুয়াকাটা এখন পুরোদস্তুর পৌরসভা। কলাপাড়াও পৌরসভা, তবে নামডাকে এগিয়ে কুয়াকাটা।
যাওয়া-আসার ঝক্কিটা বাদ দিলে কুয়াকাটা বেড়ানোর জন্য দারুণ একটা জায়গা। ভিড়ভাট্টা সারা বছর যে থাকে তা কিন্তু নয়। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুর দিকে শুরু হয় রাস উৎসব। তখন বেজায় ভিড়। এ ছাড়া সৈকতটি বেশ নীরব, শান্ত। কুয়াকাটা যেন কুমারী মেয়ে। যদি মনে করেন, প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের গ্যাঞ্জাম-কোলাহল ছেড়ে দুটো দিন নিজের মতো, নিজের জন্য কাটাবেন, আপনি যেতে পারেন কুয়াকাটা।
যেদিন ফিরব, সেদিন খুব মায়া হলো। বাস থেকে হাত নাড়লাম। ওই তো দূরে কুয়াকাটা। বিদায়।

কীভাবে যাবেন
কুয়াকাটা যাওয়ার অনেক পথ আছে। ঢাকা থেকে সড়কপথে যাওয়া যায়। সবচেয়ে ভালো হয় বরিশালে এক বেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর গেলে। তবে লঞ্চভ্রমণ আরামদায়ক। সন্ধ্যায় লঞ্চে উঠলে ভোরে পটুয়াখালী। সেখান থেকে কুয়াকাটা। কুয়াকাটায় এখন অনেক হোটেল। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বেশ ভালো মানের। আছে পর্যটন মোটেলও। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অতিথিশালা আছে। খাওয়াদাওয়ার সমস্যা নেই। বাইরে রেস্টুরেন্টে খাওয়া যায়। বললে হোটেল কর্তৃপক্ষও ব্যবস্থা করে।

No comments

Powered by Blogger.