বাংলাদেশে অবস্থানকালে লিয়ার লেভিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন তারেক মাসুদ-‘জয় বাংলা, মুক্তির গান থেকে বেশ ভিন্ন’
তারেক মাসুদ: তোমার সঙ্গে আমার প্রথম যেদিন দেখা হলো, সেদিনের কথা মনে আছে? লিয়ার লেভিন: হ্যাঁ, মনে আছে। নিউইয়র্কের ফিল্ম ভিডিও আর্কসের সম্পাদনা কক্ষে। তারেক মাসুদ: হ্যাঁ, তোমার ফুটেজের রাশ প্রিন্ট দেখার জন্য আমরা সম্পাদনার মেশিন ভাড়া করেছিলাম। আমার মনে পড়ে, ফুটেজ দেখতে দেখতে আমি শিহরিত হয়ে উঠছিলাম। দুই চোখের সামনে সবাক রঙিন একাত্তরের দৃশ্য! আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না।
যা হোক, ফুটেজ দেখা শেষ হলে আমি তোমাকে বললাম, এ ফুটেজ ব্যবহার করে আমরা যদি একটি ছবি বানাতে চাই, তবে তোমাকে কী দিতে হবে? তুমি বললে কিছুই দিতে হবে না।
লিয়ার লেভিন: না, শেষ দিকে একটা শর্ত দিয়েছিলাম, ছবিটা পেশাদারিভাবে শেষ করতে হবে।
তারেক মাসুদ: তা ঠিক। আমি তখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, পেশাদারিভাবে সম্পন্ন করতে কত টাকা লাগতে পারে বলে মনে করো?
লিয়ার লেভিন: হ্যাঁ, বলেছিলাম। ১৯৭২ সালে আমি হিসাব করে দেখেছি, ছবিটি শেষ করতে দরকার দেড় লাখ ডলার। তাহলে ভাবতে পারো, আজকের বাজারে এ ছবি শেষ করতে কমপক্ষে তোমার আড়াই লাখ ডলার লাগত।
তারেক মাসুদ: মনে আছে, তোমার কথা শুনে আমি কিছুটা খেপেই বললাম—আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি ৫০ হাজার ডলারে কোনো কম্প্রোমাইজ ছাড়াই ছবিটি শেষ করতে পারব। তুমি তখন বললে, সে ক্ষেত্রে আমি চাই না তুমি এ ফুটেজ নিয়ে কিছু করো। আমি তখন তোমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললাম, ঠিক আছে, গুড বাই।
লিয়ার লেভিন: পরে অবশ্য আমি তোমার স্ত্রী ক্যাথরিনকে তোমার প্রতি আমার এই নেতিবাচক মনোভাবের আসল কারণ সম্পর্কে জানিয়েছিলাম। পরে ক্যাথরিনকে বলেছিলাম, তারেকের কঠিন আত্মবিশ্বাসী মনোভাব আমার তরুণ বয়সের সরলতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এই ফুটেজ শুট করেছিলাম, অথচ শেষ করতে পারিনি। আমার ভয় হচ্ছিল, তারেকও প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করে আমার মতো ভুল করবে এবং পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে শেষ করতে পারবে না। পরে অবশ্য ক্যাথরিনের কথায় কনভিন্স হই ও তোমাদের ফুটেজ দিয়ে দিই।
তারেক মাসুদ: আচ্ছা লিয়ার, নিজের পকেট থেকে ৫০ হাজার ডলার খরচ করে এ পাগলামি করতে তুমি কেন গিয়েছিলে বলো তো?
লিয়ার লেভিন: তখন বয়সটাই শুধু পাগলামির ছিল না, যুগটাও ছিল পাগলামির। তখন ছিল হিপি জেনারেশনের সময়। আমার শুটিং দলের প্রায় সবাই ছিল হিপি। আমরা তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, যেকোনো কিছুতেই কজ (আদর্শ) খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। ১৯৭১ সালে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ ছিল টপ কজ। ভেবেছিলাম, শরণার্থীদের নিয়ে একটা ছবি তৈরি করে তার মুনাফা শরণার্থীদের ত্রাণকাজে দান করব।
তারেক মাসুদ: তুমি তো অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে কাজ করেছ। ২৪ ঘণ্টার জন্য তুমি তো একবার হাজতেও গিয়েছিলে?
লিয়ার লেভিন: হ্যাঁ, সে এক কাহিনি! আমি দমদম এয়ারপোর্টের পেছনে কিছু শকুনের ছবি তুলছিলাম, যেটা তোমরা তোমাদের ছবিতে ব্যবহার করেছ। আমি শট নিচ্ছি। হঠাৎ দেখি, আমার দিকে একজন রাইফেল তাক করে আছে। আমাকে গ্রেপ্তার করে সোজা চালান করে দেওয়া হয় পার্শ্ববর্তী থানাহাজতে। আমার সঙ্গে সে সময় তারিক আলীও ছিল। তাঁকেও শেষ পর্যন্ত হাজতবাস করতে হয়। দিনে পিঁপড়া আর রাতে মশার কামড়ের কথা এখনো মনে আছে।
তারেক মাসুদ: কিন্তু তুমি শিল্পীদলের কাছ থেকে তো অনেক সহযোগিতা পেয়েছ।
লিয়ার লেভিন: অবশ্যই, ওরাই তো আমাকে বাঁচিয়েছে। দে ওয়ার মাই সেভিয়ারস।
তারেক মাসুদ: আচ্ছা, ওদের সঙ্গে তোমার কীভাবে দেখা হলো?
লিয়ার লেভিন: সে এক লম্বা কাহিনি। রিচার্ড লেভিন (আমার কোনো আত্মীয় নয়) নামের আমার এক পরিচিত সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী বন্ধু ছিল, নিউইয়র্ক টাইমস-এ লিখত। লেখালেখির বিষয়ে আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। রিচার্ডকে আমি হায়ার করলাম গবেষণার কাজটি শুরু করতে এবং সে অনুযায়ী একটি স্ক্রিপ্ট কাঠামো দাঁড় করাতে। এ কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে আমি অ্যাডভান্স কলকাতা পাঠালাম। মজার এবং দুঃখের ব্যাপার হলো, কলকাতায় কয়েক সপ্তাহ ঘোরাঘুরি করে সে কোনো প্লট আমাকে দিতে পারল না। একদম শেষ মুহূর্তে আমি যখন প্রায় কলকাতার উদ্দেশে রওনা হতে যাচ্ছি, তখন সে জানাল, শরণার্থী শিবিরে সে একটি গানের দল পেয়েছে, যেটা খুবই ইন্টারেস্টিং। কলকাতায় এসেই আমি কিছুদিন শরণার্থী শিবিরের ছবি তুলে এই গানের দলটিকে আবিষ্কার করি। আমি ওদের অনুরোধ করলাম, তোমরা যদি অনুমতি দাও, আমি তোমাদের কার্যক্রম অনুসরণ করব।
তারেক মাসুদ: তোমার তোলা ছবিতেই মুক্তিযুদ্ধের সম্ভবত সবচেয়ে চমৎকার লাইভ সাউন্ড পেয়েছি। তবে এটা সত্য, অনেকগুলো গানেরই দু-এক লাইন ছাড়া রেকর্ড করতে পারোনি। যে কারণে ১৯৯৩ সালে ঢাকায় এসে প্রায় ১১টি গান নতুন করে রেকর্ড করেছিলাম।
লিয়ার লেভিন: গানগুলো অবশ্য আমি ইচ্ছা করেই পুরোপুরি রেকর্ড করিনি। কারণ, আমার টার্গেট অডিয়েন্স ছিল আমেরিকান দর্শক।
তারেক মাসুদ: হ্যাঁ, তোমার রাফ কাট, অর্থাৎ তোমার সম্পাদিত অসম্পূর্ণ সংস্করণ জয় বাংলাতে শিল্পীদের গান ব্যবহার না করে নেপথ্য সংগীত হিসেবে অনেক ভারতীয় এবং ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক ব্যবহার করেছ—এটি আমার খুব ভালো লেগেছে।
লিয়ার লেভিন: আমার জয় বাংলা অবশ্য তোমাদের মুক্তির গান থেকে বেশ ভিন্ন। দুটি ছবির শুধু দর্শক নয়, এর উদ্দেশ্যও আলাদা। আমার ছবির উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ নৈসর্গিক জীবনের উল্টো দিকে বিপন্ন মানুষের প্রতি আমেরিকান মানুষদের সহানুভূতি সৃষ্টি। আর তোমাদের ছবির উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মূল্যবোধ নতুন করে জাগিয়ে তোলার আবেগময় প্রচেষ্টা।
* ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত (সংক্ষেপিত)
লিয়ার লেভিন: না, শেষ দিকে একটা শর্ত দিয়েছিলাম, ছবিটা পেশাদারিভাবে শেষ করতে হবে।
তারেক মাসুদ: তা ঠিক। আমি তখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, পেশাদারিভাবে সম্পন্ন করতে কত টাকা লাগতে পারে বলে মনে করো?
লিয়ার লেভিন: হ্যাঁ, বলেছিলাম। ১৯৭২ সালে আমি হিসাব করে দেখেছি, ছবিটি শেষ করতে দরকার দেড় লাখ ডলার। তাহলে ভাবতে পারো, আজকের বাজারে এ ছবি শেষ করতে কমপক্ষে তোমার আড়াই লাখ ডলার লাগত।
তারেক মাসুদ: মনে আছে, তোমার কথা শুনে আমি কিছুটা খেপেই বললাম—আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি ৫০ হাজার ডলারে কোনো কম্প্রোমাইজ ছাড়াই ছবিটি শেষ করতে পারব। তুমি তখন বললে, সে ক্ষেত্রে আমি চাই না তুমি এ ফুটেজ নিয়ে কিছু করো। আমি তখন তোমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললাম, ঠিক আছে, গুড বাই।
লিয়ার লেভিন: পরে অবশ্য আমি তোমার স্ত্রী ক্যাথরিনকে তোমার প্রতি আমার এই নেতিবাচক মনোভাবের আসল কারণ সম্পর্কে জানিয়েছিলাম। পরে ক্যাথরিনকে বলেছিলাম, তারেকের কঠিন আত্মবিশ্বাসী মনোভাব আমার তরুণ বয়সের সরলতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এই ফুটেজ শুট করেছিলাম, অথচ শেষ করতে পারিনি। আমার ভয় হচ্ছিল, তারেকও প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করে আমার মতো ভুল করবে এবং পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে শেষ করতে পারবে না। পরে অবশ্য ক্যাথরিনের কথায় কনভিন্স হই ও তোমাদের ফুটেজ দিয়ে দিই।
তারেক মাসুদ: আচ্ছা লিয়ার, নিজের পকেট থেকে ৫০ হাজার ডলার খরচ করে এ পাগলামি করতে তুমি কেন গিয়েছিলে বলো তো?
লিয়ার লেভিন: তখন বয়সটাই শুধু পাগলামির ছিল না, যুগটাও ছিল পাগলামির। তখন ছিল হিপি জেনারেশনের সময়। আমার শুটিং দলের প্রায় সবাই ছিল হিপি। আমরা তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, যেকোনো কিছুতেই কজ (আদর্শ) খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। ১৯৭১ সালে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ ছিল টপ কজ। ভেবেছিলাম, শরণার্থীদের নিয়ে একটা ছবি তৈরি করে তার মুনাফা শরণার্থীদের ত্রাণকাজে দান করব।
তারেক মাসুদ: তুমি তো অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে কাজ করেছ। ২৪ ঘণ্টার জন্য তুমি তো একবার হাজতেও গিয়েছিলে?
লিয়ার লেভিন: হ্যাঁ, সে এক কাহিনি! আমি দমদম এয়ারপোর্টের পেছনে কিছু শকুনের ছবি তুলছিলাম, যেটা তোমরা তোমাদের ছবিতে ব্যবহার করেছ। আমি শট নিচ্ছি। হঠাৎ দেখি, আমার দিকে একজন রাইফেল তাক করে আছে। আমাকে গ্রেপ্তার করে সোজা চালান করে দেওয়া হয় পার্শ্ববর্তী থানাহাজতে। আমার সঙ্গে সে সময় তারিক আলীও ছিল। তাঁকেও শেষ পর্যন্ত হাজতবাস করতে হয়। দিনে পিঁপড়া আর রাতে মশার কামড়ের কথা এখনো মনে আছে।
তারেক মাসুদ: কিন্তু তুমি শিল্পীদলের কাছ থেকে তো অনেক সহযোগিতা পেয়েছ।
লিয়ার লেভিন: অবশ্যই, ওরাই তো আমাকে বাঁচিয়েছে। দে ওয়ার মাই সেভিয়ারস।
তারেক মাসুদ: আচ্ছা, ওদের সঙ্গে তোমার কীভাবে দেখা হলো?
লিয়ার লেভিন: সে এক লম্বা কাহিনি। রিচার্ড লেভিন (আমার কোনো আত্মীয় নয়) নামের আমার এক পরিচিত সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী বন্ধু ছিল, নিউইয়র্ক টাইমস-এ লিখত। লেখালেখির বিষয়ে আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। রিচার্ডকে আমি হায়ার করলাম গবেষণার কাজটি শুরু করতে এবং সে অনুযায়ী একটি স্ক্রিপ্ট কাঠামো দাঁড় করাতে। এ কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে আমি অ্যাডভান্স কলকাতা পাঠালাম। মজার এবং দুঃখের ব্যাপার হলো, কলকাতায় কয়েক সপ্তাহ ঘোরাঘুরি করে সে কোনো প্লট আমাকে দিতে পারল না। একদম শেষ মুহূর্তে আমি যখন প্রায় কলকাতার উদ্দেশে রওনা হতে যাচ্ছি, তখন সে জানাল, শরণার্থী শিবিরে সে একটি গানের দল পেয়েছে, যেটা খুবই ইন্টারেস্টিং। কলকাতায় এসেই আমি কিছুদিন শরণার্থী শিবিরের ছবি তুলে এই গানের দলটিকে আবিষ্কার করি। আমি ওদের অনুরোধ করলাম, তোমরা যদি অনুমতি দাও, আমি তোমাদের কার্যক্রম অনুসরণ করব।
তারেক মাসুদ: তোমার তোলা ছবিতেই মুক্তিযুদ্ধের সম্ভবত সবচেয়ে চমৎকার লাইভ সাউন্ড পেয়েছি। তবে এটা সত্য, অনেকগুলো গানেরই দু-এক লাইন ছাড়া রেকর্ড করতে পারোনি। যে কারণে ১৯৯৩ সালে ঢাকায় এসে প্রায় ১১টি গান নতুন করে রেকর্ড করেছিলাম।
লিয়ার লেভিন: গানগুলো অবশ্য আমি ইচ্ছা করেই পুরোপুরি রেকর্ড করিনি। কারণ, আমার টার্গেট অডিয়েন্স ছিল আমেরিকান দর্শক।
তারেক মাসুদ: হ্যাঁ, তোমার রাফ কাট, অর্থাৎ তোমার সম্পাদিত অসম্পূর্ণ সংস্করণ জয় বাংলাতে শিল্পীদের গান ব্যবহার না করে নেপথ্য সংগীত হিসেবে অনেক ভারতীয় এবং ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক ব্যবহার করেছ—এটি আমার খুব ভালো লেগেছে।
লিয়ার লেভিন: আমার জয় বাংলা অবশ্য তোমাদের মুক্তির গান থেকে বেশ ভিন্ন। দুটি ছবির শুধু দর্শক নয়, এর উদ্দেশ্যও আলাদা। আমার ছবির উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ নৈসর্গিক জীবনের উল্টো দিকে বিপন্ন মানুষের প্রতি আমেরিকান মানুষদের সহানুভূতি সৃষ্টি। আর তোমাদের ছবির উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মূল্যবোধ নতুন করে জাগিয়ে তোলার আবেগময় প্রচেষ্টা।
* ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত (সংক্ষেপিত)
No comments