ধূমপান-তামাক ও নির্বাচন by ফরিদা আখতার
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপানের ফলে যে ধূমপান করে সে নিজে এবং তার আশপাশের সবাই নানা রোগের শিকার হয়। এই তথ্য নিয়ে কেউ বিতর্ক করে না, কারণ এসবই প্রমাণিত এবং প্রচুর তথ্য আছে। যাঁরা যক্ষ্মা রোগ নিয়ে কাজ করেন, হূদেরাগ এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগ নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা সবাই রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়া এবং অকালমৃত্যুর সংখ্যা দেখে উৎকণ্ঠিত। ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া চোখের সামনেই
ঘটছে। রোগের চিকিৎসা শুধু নয়, রোগ প্রতিরোধের জন্য তামাকবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান একত্র হয়েছে। বেশির ভাগ রোগের মূলেই দেখা যাচ্ছে সিগারেট-বিড়ি খাওয়া। ধনীরা যত দামি সিগারেট খান না কেন, Light, mild যত নামেই আশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করেন না কেন, ধূমপানের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই যদি হতো, উন্নত দেশে ধূমপান প্রতিরোধের আইন কঠোর হতো না। গরিব মানুষ সস্তা সিগারেট এবং বিড়ি খেয়ে নিজেদের নিঃশেষ করছে, আক্রান্ত হচ্ছে তাদের পরিবারের সদস্যরাও।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০৫ থাকা সত্ত্বেও তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্দা, গুল, সাদাপাতার কথা আইনে নেই; তাই এর ব্যবহারের ওপর এখনো কোনো আইনি বাধা আরোপ করা হয়নি। তবে দেখা যাচ্ছে নারীরাই বেশি এসব সেবন করছে এবং নীরবে নানা ধরনের রোগের শিকার হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আমি বুঝতে পারি না, বিভিন্ন বিষয়ে এত সচেতনতা সৃষ্টির যুগে আমরা এমন সাধারণ এবং দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত ঘাতকদের সম্পর্কে সতর্ক করতে পারি না কেন?
এই সবকিছুর পেছনে আরও ভয়াবহ যে দিকটি রয়েছে তা হচ্ছে, তামাক পাতার চাষ। তামাক কোনো ফসল নয়, কৃষক তাঁর নিজের পছন্দে কোন ধরনের তামাক পাতা চাষ করবেন, তাও নির্ধারণ করতে পারেন না। তাঁকে করতে হবে নির্দিষ্ট কোম্পানি তাঁকে যে জাতের পাতা দেয় যেমন ভার্জিনিয়া, বার্লি বা মতিহারি পাতারই চাষ করতে হবে। সে অনুযায়ী কোম্পানি তাঁকে বীজ, সার, কীটনাশক, পলিথিন, অর্থাৎ বীজতলা করা থেকে শুরু করে পাতা কাটা পর্যন্ত যা লাগে সবই দেবে। সবই লিখে রাখা হবে, পরে দাম ধরে কেটে নেওয়া হবে। তারপর পাতা পোড়ানের জন্য তন্দুর করে দেবে এবং সেখানে এলাকার যত ফলদ-বনজ গাছ আছে নির্বিচারে কেটে তন্দুরে খড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সে গাছ আম-জাম-কাঁঠালের মতো ফলের গাছ হতে পারে, গর্জনের মতো কাঠ হতে পারে কিংবা হতে পারে ভেরা, আমলকীর মতো নানা অমূল্য ওষুধের গাছ। তামাকের তন্দুরের জন্য এসবের কোনো মূল্য নেই—পাতা ঠিকমতো পোড়াতে হবে নইলে কোম্পানির নির্ধারিত সঠিক গ্রেডে মূল্য পাওয়া যাবে না। না হলে এত পরিশ্রমের পর তামাক চাষ করে যে মুনাফার আশা করা হয়েছিল, সেই গুড়ে বালি পড়ে যাবে।
তামাক চাষের ক্ষতির হিসাব দিয়ে কুলানো যাবে না। প্রথমত. যে মৌসুমে তামাক চাষ করা হয় সেটা প্রধানত শীতকালীন শাকসবজি, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন এবং বোরো ধানের চাষের সময়। তামাক চাষ করার পরিকল্পনা থাকলে অনেকে আমন ধানও করতে পারেন না; কারণ আমন ধান কাটার সময় তামাক লাগানোর সময় একেবারে কাছাকাছি। যাঁরা আউশ করতে চান তাঁরাও করতে পারেন না; কারণ আউশ লাগার সময় তামাক পাতা মাঠ থেকে ওঠে না। ফলে অক্টোবর থেকে শুরু করে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত যত ফসল লাগানোর বা কাটার জন্য থাকে, সে সব ফসলই মূলত আটকে যায়। তামাক যাঁরা চাষ করেন, তাঁরা কোম্পানি কার্ডের মাধ্যমে ঋণের ফাঁদে আটকে পড়ে বছরের পর বছর তামাক চাষ করতে বাধ্য থাকেন। তামাক চাষ অন্য কৃষি ফসলের তুলনায় শুধু একটি দিকেই ইতিবাচক সেটা হচ্ছে, কৃষক চাষের উপকরণ এবং বিক্রির এক ধরনের নিশ্চয়তা বোধ করেন, যা অন্য ফসলের ক্ষেত্রে ঘটে না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য এবং কৃষি বিভাগের ব্যর্থতা। খাদ্য ফসল উৎপাদনকারী কৃষককে নিজ উদ্যোগে বীজ ও অন্যান্য উপকরণের জোগাড় করতে হয় এবং বাজারজাত করতে গিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হয়। তামাক কোম্পানি কৃষককে ধারণা দেয়, তারা কৃষকের সব পাতা কিনে নেবে। যদিও এই পাতা বিক্রি করতে গিয়ে কোম্পানি নিজের মতো করে গ্রেড অনুযায়ী যে দাম নির্ধারণ করে, তাতে কৃষকের কিছুই করার থাকে না। এমনকি না কিনলেও কিছু করার নেই।
তামাক কোম্পানি লাভের আশা বা ক্যাশ টাকা উপার্জনের লোভ সৃষ্টি করতে পারে এবং কৃষকেরা এতে আকৃষ্ট হন অনায়াসে। এই লোভ আধুনিক কৃষিতে উফশী বীজ দেওয়ার সময়ও ছিল এবং হাইব্রিডের মিথ্যা অতি ফলনের দাবির ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ফলে অতিরিক্ত সার-কীটনাশকের ব্যবহার করে উচ্চ ফলনের ফসল আবাদ করে কৃষক গরিব ও ঋণগ্রস্ত হয়ে থেকেছেন দীর্ঘদিন—ঢাকায় এসেছেন রিকশাওয়ালা হয়ে। গৃহস্থ ঘরের বউয়েরা ভিজিডি কার্ডধারী হয়েছেন কিংবা কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। তা ছাড়া এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণ তো গরিবদের জন্য আছেই।
তামাক চাষের কারণে পরিবেশ নষ্ট, মাটি নষ্ট, পানি নষ্ট—সবই ঘটছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে ব্যাপকভাবে তামাক চাষ করা হচ্ছে, এই এলাকাকে ভালোবেসে নয়, পাহাড়ের ঘন অরণ্যের গাছের লোভে। সহজে মাতামুহুরী নদীর পাড়ের উর্বর খাসজমি, সেচের পানি এবং গাছ কাটার সুবিধার জন্যই তারা এসেছে। এখন ন্যাড়া পাহাড় দেখে যদি কারও দুঃখ লাগে এবং পর্যটনের জন্য বান্দরবানে এসে শুধু ইউক্যালিপটাস-একাশিয়া দেখে যদি কেউ ভাবেন পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে এসেছেন, তাহলে তাঁদের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা প্রকাশ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
এখন আসি নির্বাচনের কথায়। পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণ অধৈর্য হয়ে উঠেছেন যে তামাকের এত কথার সঙ্গে নির্বাচনের কী সম্পর্ক? এই সম্পর্কটা আমার নিজের কাছেও পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে তামাক চাষের এলাকায় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করার সময় বিষয়টির সম্পৃক্ততা বুঝতে পেরেছি। সাধারণত নির্বাচনী প্রচারের সময় প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকেরা চায়ের দোকানে বসে পান-সিগারেট-বিড়ি খাইয়ে খোশগল্প করে ভোটারদের মনোরঞ্জন করেন। এ তো ভোট আদায় করার একটি কৌশল। কাজেই নির্বাচনী খরচের মধ্যে পান (সঙ্গে জর্দা), সিগারেট এবং বিড়ির খরচ ধরা থাকে। তাই নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান এমন ব্যক্তিরা মনে করেন, ধূমপান ও তামাকবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে আসন্ন কোনো নির্বাচনে ভোটারের সমর্থন পাওয়া যাবে না। ওরে বাবা, ধূমপানের বিরুদ্ধে বললে আমি ভোট পাব কেমন করে? আশ্চর্য যে নির্বাচিত হয়ে জনগণের পক্ষে কাজ করার নিশ্চয়তা নেই, অথচ ঠিকই ভোটারের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে ভোট নেওয়া হচ্ছে! এমন প্রার্থীকে কি আসলেই ভোট দেওয়া উচিত?
আরও দেখা গেছে, নির্বাচিত হয়ে গেছেন, এখন এলাকার মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করবেন, তাও তাঁর ভয় ভবিষ্যৎ ভোটের জন্য। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বান্দরবানে ব্যাপক তামাক চাষ হচ্ছে। এই সময় এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধি জনস্বার্থে তামাক চাষের বিপক্ষে বলতে গেলে তামাকচাষিরা এসে তাঁর কাছে ধরনা দেন, আমাদের কী হবে? তাঁরাও তো ভোটার ভেবে নির্বাচিত প্রতিনিধি কিছুটা নমনীয় হয়ে যান। কিন্তু তিনি যা করছিলেন, তা ছিল এলাকার সব মানুষের উপকারের জন্য। জনপ্রতিনিধি হিসেবে এটাই তাঁর কাজ। এ ক্ষেত্রে আমি এটাও দেখেছি, জনপ্রতিনিধি তিনি একজন সংসদ সদস্য (নাম বলছি না, তাঁর অনুমতি নিইনি বলে), তিনি তামাকচাষিকে ভোটার হিসেবে স্বীকার করে তাঁর ক্ষতি যেন না হয় এবং একই সঙ্গে এলাকার ক্ষতি যেন না হয় উভয় দিকে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, নির্বাচন করতে তামাক চাষ এবং তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারের পক্ষে থাকতে হবে এমন কথা নেই, বরং জনস্বার্থে কাজ করাই তাঁর দায়িত্ব।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০৫ থাকা সত্ত্বেও তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্দা, গুল, সাদাপাতার কথা আইনে নেই; তাই এর ব্যবহারের ওপর এখনো কোনো আইনি বাধা আরোপ করা হয়নি। তবে দেখা যাচ্ছে নারীরাই বেশি এসব সেবন করছে এবং নীরবে নানা ধরনের রোগের শিকার হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আমি বুঝতে পারি না, বিভিন্ন বিষয়ে এত সচেতনতা সৃষ্টির যুগে আমরা এমন সাধারণ এবং দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত ঘাতকদের সম্পর্কে সতর্ক করতে পারি না কেন?
এই সবকিছুর পেছনে আরও ভয়াবহ যে দিকটি রয়েছে তা হচ্ছে, তামাক পাতার চাষ। তামাক কোনো ফসল নয়, কৃষক তাঁর নিজের পছন্দে কোন ধরনের তামাক পাতা চাষ করবেন, তাও নির্ধারণ করতে পারেন না। তাঁকে করতে হবে নির্দিষ্ট কোম্পানি তাঁকে যে জাতের পাতা দেয় যেমন ভার্জিনিয়া, বার্লি বা মতিহারি পাতারই চাষ করতে হবে। সে অনুযায়ী কোম্পানি তাঁকে বীজ, সার, কীটনাশক, পলিথিন, অর্থাৎ বীজতলা করা থেকে শুরু করে পাতা কাটা পর্যন্ত যা লাগে সবই দেবে। সবই লিখে রাখা হবে, পরে দাম ধরে কেটে নেওয়া হবে। তারপর পাতা পোড়ানের জন্য তন্দুর করে দেবে এবং সেখানে এলাকার যত ফলদ-বনজ গাছ আছে নির্বিচারে কেটে তন্দুরে খড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সে গাছ আম-জাম-কাঁঠালের মতো ফলের গাছ হতে পারে, গর্জনের মতো কাঠ হতে পারে কিংবা হতে পারে ভেরা, আমলকীর মতো নানা অমূল্য ওষুধের গাছ। তামাকের তন্দুরের জন্য এসবের কোনো মূল্য নেই—পাতা ঠিকমতো পোড়াতে হবে নইলে কোম্পানির নির্ধারিত সঠিক গ্রেডে মূল্য পাওয়া যাবে না। না হলে এত পরিশ্রমের পর তামাক চাষ করে যে মুনাফার আশা করা হয়েছিল, সেই গুড়ে বালি পড়ে যাবে।
তামাক চাষের ক্ষতির হিসাব দিয়ে কুলানো যাবে না। প্রথমত. যে মৌসুমে তামাক চাষ করা হয় সেটা প্রধানত শীতকালীন শাকসবজি, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন এবং বোরো ধানের চাষের সময়। তামাক চাষ করার পরিকল্পনা থাকলে অনেকে আমন ধানও করতে পারেন না; কারণ আমন ধান কাটার সময় তামাক লাগানোর সময় একেবারে কাছাকাছি। যাঁরা আউশ করতে চান তাঁরাও করতে পারেন না; কারণ আউশ লাগার সময় তামাক পাতা মাঠ থেকে ওঠে না। ফলে অক্টোবর থেকে শুরু করে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত যত ফসল লাগানোর বা কাটার জন্য থাকে, সে সব ফসলই মূলত আটকে যায়। তামাক যাঁরা চাষ করেন, তাঁরা কোম্পানি কার্ডের মাধ্যমে ঋণের ফাঁদে আটকে পড়ে বছরের পর বছর তামাক চাষ করতে বাধ্য থাকেন। তামাক চাষ অন্য কৃষি ফসলের তুলনায় শুধু একটি দিকেই ইতিবাচক সেটা হচ্ছে, কৃষক চাষের উপকরণ এবং বিক্রির এক ধরনের নিশ্চয়তা বোধ করেন, যা অন্য ফসলের ক্ষেত্রে ঘটে না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য এবং কৃষি বিভাগের ব্যর্থতা। খাদ্য ফসল উৎপাদনকারী কৃষককে নিজ উদ্যোগে বীজ ও অন্যান্য উপকরণের জোগাড় করতে হয় এবং বাজারজাত করতে গিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হয়। তামাক কোম্পানি কৃষককে ধারণা দেয়, তারা কৃষকের সব পাতা কিনে নেবে। যদিও এই পাতা বিক্রি করতে গিয়ে কোম্পানি নিজের মতো করে গ্রেড অনুযায়ী যে দাম নির্ধারণ করে, তাতে কৃষকের কিছুই করার থাকে না। এমনকি না কিনলেও কিছু করার নেই।
তামাক কোম্পানি লাভের আশা বা ক্যাশ টাকা উপার্জনের লোভ সৃষ্টি করতে পারে এবং কৃষকেরা এতে আকৃষ্ট হন অনায়াসে। এই লোভ আধুনিক কৃষিতে উফশী বীজ দেওয়ার সময়ও ছিল এবং হাইব্রিডের মিথ্যা অতি ফলনের দাবির ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ফলে অতিরিক্ত সার-কীটনাশকের ব্যবহার করে উচ্চ ফলনের ফসল আবাদ করে কৃষক গরিব ও ঋণগ্রস্ত হয়ে থেকেছেন দীর্ঘদিন—ঢাকায় এসেছেন রিকশাওয়ালা হয়ে। গৃহস্থ ঘরের বউয়েরা ভিজিডি কার্ডধারী হয়েছেন কিংবা কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। তা ছাড়া এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণ তো গরিবদের জন্য আছেই।
তামাক চাষের কারণে পরিবেশ নষ্ট, মাটি নষ্ট, পানি নষ্ট—সবই ঘটছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে ব্যাপকভাবে তামাক চাষ করা হচ্ছে, এই এলাকাকে ভালোবেসে নয়, পাহাড়ের ঘন অরণ্যের গাছের লোভে। সহজে মাতামুহুরী নদীর পাড়ের উর্বর খাসজমি, সেচের পানি এবং গাছ কাটার সুবিধার জন্যই তারা এসেছে। এখন ন্যাড়া পাহাড় দেখে যদি কারও দুঃখ লাগে এবং পর্যটনের জন্য বান্দরবানে এসে শুধু ইউক্যালিপটাস-একাশিয়া দেখে যদি কেউ ভাবেন পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে এসেছেন, তাহলে তাঁদের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা প্রকাশ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
এখন আসি নির্বাচনের কথায়। পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণ অধৈর্য হয়ে উঠেছেন যে তামাকের এত কথার সঙ্গে নির্বাচনের কী সম্পর্ক? এই সম্পর্কটা আমার নিজের কাছেও পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে তামাক চাষের এলাকায় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করার সময় বিষয়টির সম্পৃক্ততা বুঝতে পেরেছি। সাধারণত নির্বাচনী প্রচারের সময় প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকেরা চায়ের দোকানে বসে পান-সিগারেট-বিড়ি খাইয়ে খোশগল্প করে ভোটারদের মনোরঞ্জন করেন। এ তো ভোট আদায় করার একটি কৌশল। কাজেই নির্বাচনী খরচের মধ্যে পান (সঙ্গে জর্দা), সিগারেট এবং বিড়ির খরচ ধরা থাকে। তাই নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান এমন ব্যক্তিরা মনে করেন, ধূমপান ও তামাকবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে আসন্ন কোনো নির্বাচনে ভোটারের সমর্থন পাওয়া যাবে না। ওরে বাবা, ধূমপানের বিরুদ্ধে বললে আমি ভোট পাব কেমন করে? আশ্চর্য যে নির্বাচিত হয়ে জনগণের পক্ষে কাজ করার নিশ্চয়তা নেই, অথচ ঠিকই ভোটারের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে ভোট নেওয়া হচ্ছে! এমন প্রার্থীকে কি আসলেই ভোট দেওয়া উচিত?
আরও দেখা গেছে, নির্বাচিত হয়ে গেছেন, এখন এলাকার মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করবেন, তাও তাঁর ভয় ভবিষ্যৎ ভোটের জন্য। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বান্দরবানে ব্যাপক তামাক চাষ হচ্ছে। এই সময় এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধি জনস্বার্থে তামাক চাষের বিপক্ষে বলতে গেলে তামাকচাষিরা এসে তাঁর কাছে ধরনা দেন, আমাদের কী হবে? তাঁরাও তো ভোটার ভেবে নির্বাচিত প্রতিনিধি কিছুটা নমনীয় হয়ে যান। কিন্তু তিনি যা করছিলেন, তা ছিল এলাকার সব মানুষের উপকারের জন্য। জনপ্রতিনিধি হিসেবে এটাই তাঁর কাজ। এ ক্ষেত্রে আমি এটাও দেখেছি, জনপ্রতিনিধি তিনি একজন সংসদ সদস্য (নাম বলছি না, তাঁর অনুমতি নিইনি বলে), তিনি তামাকচাষিকে ভোটার হিসেবে স্বীকার করে তাঁর ক্ষতি যেন না হয় এবং একই সঙ্গে এলাকার ক্ষতি যেন না হয় উভয় দিকে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, নির্বাচন করতে তামাক চাষ এবং তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারের পক্ষে থাকতে হবে এমন কথা নেই, বরং জনস্বার্থে কাজ করাই তাঁর দায়িত্ব।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
No comments