ঘর-মন-জানালা-মা

কাল থেকে কয়েকবার ফোনে জেনেছি, মায়ের অবস্থা কেমন। কিডনি ক্রমাবনতির দিকে। আগের স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক আর বহুদিনের ডায়াবেটিস। এখন গভীর ঘুমে, ঘোরের মধ্যে—মা মনে হয় ভিন্ন কোনো জগতে।আমরা প্রায় এক ডজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসে ঠিক করছি, কী করব। কী করা উচিত।ডায়ালিসিস না করলে কী হবে আর করতে গেলে যে কষ্ট ও জটিলতার আশঙ্কা, তা কি মায়ের সহ্য হবে? মা কি তা-ই চান? এ এক সংকট


সন্ধিক্ষণ। বাবা, আপনাকে কাছে পাওয়া খুব দরকার ছিল এ সময়ে।মাকে যখন আপনি নিয়ে আসেন আমাদের বাড়িতে, তাঁর বয়স ছিল ১৬ কি ১৮। এ বয়সে আমেরিকায় আমাদের মেয়েরা আইপডে গান শোনে, ফিটনেস করতে যায়, হাইস্কুল শেষ করে। কলেজ-ফেসবুকে ব্যস্ত থাকে। আমি কল্পনা করেছি মাকে। বহুদিন। ১৮ বছরের সেই মেয়ে, স্বামীর সংসারে, তা-ও একান্নবর্তী, নিশ্চুপে হাজির হয়ে যান। তারপর এই দীর্ঘকাল আমাদের সংসারে। না, পড়াশোনা তাঁর আর হয়নি। আমার অষ্টম শ্রেণী পাস মা কেবলই তাঁর ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার পাসের খবর শুনেছেন আর খুশি হয়েছেন। বছরের পর বছর আমাদের জন্য রান্না করেছেন। আমাদের কাপড়চোপড় ঠিক করেছেন। আমি পরীক্ষা দিয়ে ফিরলে আপনি যখন অঙ্কের উত্তর ঠিক হলো কি না জানতে চেয়ে উদগ্রীব, মা তখন দ্বিতীয়বার তরকারি গরম করতে ব্যস্ত হয়েছেন। আপনি মাকে একটা হাতখরচ দিতেন। তার থেকে আমি আবার ভাগ পেতাম। পার্কের বেঞ্চিতে বসে অথবা লঞ্চঘাট বেড়িয়ে সন্ধ্যার আগেই আমার বাসায় ফিরতে ইচ্ছে হতো। মা তখন একলা বসে চুলে বিনুনি কাটতেন। রেডিওতে গান চলছে। আমার কেবলই তখন তাঁর চারপাশে ঘুরঘুর করতে ইচ্ছে হতো।
বছরে একবার তাঁর নানাবাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। যশোরে গিয়েই রিকশার হুড নামিয়ে ফেলতেন মা। বাগেরহাটের ঘোমটাও উধাও বাপের বাড়ি।
এই রকমভাবে মাকে নিয়ে যাওয়ার একরকম অনুভূতি ছিল। রবীন্দ্রনাথের সেই—‘মনে কর মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে, তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ায় চড়ে...’।
কিন্তু এখন আমি কী করব! আমার বোনেরা ক্রমেই গভীর হতাশায় আর আমি আবেগ ও বাস্তবতার দ্বন্দ্বে দুলতে দুলতে ঢাকায় যাওয়ার টিকিটের সন্ধানে ফিরছি। ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে মাকসুম ভাই, রশিদ ভাই, কর্নেল রেজা ভাই জড়ো করেছেন আরও শুভাকাঙ্ক্ষী বিশেষজ্ঞদের।
এরপর কী করতে হবে বা কী করা উচিত, তা নিয়ে ই-মেইলে মতামত বিনিময় চলছে। প্রত্যেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাচ্ছি ই-মেইলে, কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি নেই মায়ের।
কিন্তু তারই মধ্যে ক্রমাগত একটা ভাবনা আমাকে অনুক্ষণ তাড়া করে। ৩৮ হাজার ফুট ওপরে আমি ভাবতে থাকি, এই সংসারে কী ছিল মায়ের পাওনা? তন্ময় আমাকে প্লেনে পড়ার জন্য একটা বই দিয়েছে। জানালা দিয়ে আমি তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবি। এলোমেলো চিন্তায় মাথা ভারী হয়। একসময় ওর দেওয়া বইটি খুলি।
প্রথম পাতায় ওর মন্তব্য দেখে চমকে উঠি। ও লিখেছে, বাবা, বইটা পোড়ো। বইয়ের নাম দ্য হোয়াইট টাইগার। ও আমার বেড়ে ওঠার পটভূমি বুঝতে চেষ্টা করেছে। আমি যেন ওর বেড়ে ওঠাটাও বোঝার চেষ্টা করি। ৭০ লাখ লোক বাংলাদেশের বাইরে থাকে। তাদের ছেলেমেয়েরা ভিন্নভাবে ওর মতো অন্য পরিবেশে বড় হচ্ছে। বাবা-মাকে আমরা কেমন জেনেছি, কেমন পেয়েছি—ওদের কাছে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু দ্য হোয়াইট টাইগার নামের এ বইতে কী আছে বলি। দারিদ্র্য, দুর্দশা আর সমাজে দাবিয়ে রাখা নিচের মানুষদের একজনকে নিয়ে এই লেখা। যে মানুষটি অন্ধকার থেকে আলোতে আসার চেষ্টা করে। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান—এসব বৈষম্যভেদ অন্ধকারের একেক রূপ। মা, এই অন্ধকার নিয়ে আপনিও অনেক বলেছেন। ঈশপের গল্প শুনিয়েছেন। এই অন্ধকারে আমার খুব ভয়। মা এই বৈষম্যভেদ থেকে সর্বপ্রযত্নে আমাকে সততই আলোয় রাখতে চেয়েছেন। সেই স্কুল-কলেজের শিক্ষার চেয়ে তা অনেক বড়।
কিন্তু বাবা, মায়ের জন্য এখন আর আমি কোনো অর্থ ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ রাখতে চাই না। এটা তো সত্যি, ১৮ বছরের সেই কিশোরী মেয়ের মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। যিনি আছেন, এখনো বেঁচে, আমাদের মা, তিনি ছিলেন আমাদের জন্য পরম স্নেহাশ্রয়ের, আমাদের আগলে রেখেছিলেন এতকাল।
কিন্তু বাবা, আমরা কি তাঁকে তাঁর নিজের মতো একটা দিন বুঝিয়ে দিয়েছি?
আমার মা, তিনি কি তাঁর মেয়েদের জন্যও একই প্রকার আশীর্বাদ রেখে যাবেন!
অধ্যাপক চৌধুরী হাফিজুল আহসান
বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিওলজি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার, লাসভেগাস, যুক্তরাষ্ট্র।
chahsan92@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.