শ্রদ্ধাঞ্জলি-মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ জেলা প্রশাসক

যেসব শহীদ বুদ্ধিজীবীর রক্তে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল তাঁদের মধ্যে এ কে এম শামসুল হক খান সিএসপি অন্যতম। একাত্তরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি কুমিল্লার জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে চট্টগ্রামে ডেপুটি ইলেকশন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তখনই আভাস পেয়েছিলেন, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালীন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।


ভাষা ও সংস্কৃতির সংগ্রাম এবং পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বকালীন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তি মিলবে না। পরে তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এ বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছিল। শুধু বাঙালি হওয়ার অপরাধে পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্যের কারণে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তাঁকে মেডিকেলে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। কর্মজীবনের শুরুতে কিছুদিন ভূগোল শাস্ত্রে অধ্যাপনা করার পর সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মেডিকেল পরীক্ষার বিরুদ্ধে আপিল করে তিনি জয়ী হন। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের বিখ্যাত ভাষণের পর ডিসি শামসুল হক তাঁর করণীয় নির্ধারণ করে ফেলেন। সরকারি কর্মকর্তাদের এক সভায় দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের দেশমাতৃকার সংগ্রাম করার সময় এসেছে। যদিও আমরা এই চরম ত্যাগের ফল ভোগ করতে পারব না। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য স্বর্ণদ্বার খুলে দেবে।’ শামসুল হক খান প্রশাসনে চাকরির প্রলোভন, সরকারি নীতি ও আদেশকে তুচ্ছ করে দেশপ্রেম এবং কর্তব্যবোধের শাণিত চেতনায় বলীয়ান হয়ে বাঙালির মহত্তম সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তখন প্রশাসকের ভূমিকা ছেড়ে রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। কুমিল্লার পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন, ড. আব্দুস সাত্তার, অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমসিএ, আলী আহমেদ এমসিএ প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে কুমিল্লায় গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলন। শামসুল হক খানের নির্দেশে ক্যান্টনমেন্টে রেশন ও তাদের গাড়িগুলোকে পেট্রলপাম্প থেকে পেট্রল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার ইকবাল শফির নেতৃত্বে সেনাসদস্যরা পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করতে গেলে এসপি মুন্সি কবির উদ্দিন ডিসির অর্ডার ছাড়া স্টোরের চাবি দিতে অপারগতা জানান। পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য স্থানীয় সামরিক আইন প্রশাসক ডাকলে বেসামরিক প্রশাসনের জেলা প্রধান শামসুল হক খান তাতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর এ আচরণে পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লা সার্কিট হাউস থেকে মেজর আগা ও ক্যাপ্টেন বোখারীর নেতৃত্বে ডিসি ও এসপিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের অবস্থান ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি হওয়ায় অনেকেই অনুরোধ করেছিলেন কুমিল্লা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ডিসি সাহেবের খালাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষাবিদ ড. এ আর মল্লিক (তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) টেলিফোনে তাঁকে বলেছিলেন, ‘আর্মিদের পেট্রল ও রেশন বন্ধ করার পর তোমার ও এসপির কোনো অবস্থাতেই ওখানে থাকা উচিত নয়। গ্রামের দিকে চলে যাও, পরে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে।’ তাঁকে অবস্থার গুরুত্বও বুঝিয়ে দেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ‘মিয়া ভাই (ড. এ আর মল্লিক), কুমিল্লাতে একটি শক্ত অবরোধ ঘাঁটি তৈরি করেই আমি আসব।’ তাঁর গাড়িচালকও তাঁকে বলেছিল, ‘স্যার, চলুন আমরা বর্ডার পার হয়ে যাই।’ তখনো তাঁর উত্তর ছিল, ‘যদি চলে যাই তবে হানাদারদের বিরুদ্ধে কারা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে?’
তিনি আর হানাদারদের বন্দীশিবির থেকে ফিরে আসেননি, ফিরবেন না কোনো দিন। সম্ভবত ডিসি ও এসপিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ’৭১-এর ১৩ জুন প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় কুমিল্লার গণহত্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার পর অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস বাংলাদেশ সফরে এলে ডিসি সাহেবের পরিবার তাঁর সঙ্গে দেখা করে শামসুল হক খান সম্পর্কে তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডিসি ওয়াজ কট অ্যান্ড ল্যাটার অন শট।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলায় থাকাকালীন ড. মল্লিক কুমিল্লার ডিসি সম্পর্কে মেজর খালেদ মোশাররফের (মিসেস মল্লিকের খালাতো ভাই) কাছে জানতে চাইলে তাঁর জবাব ছিল, ‘ডিসিকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ শহীদ শামসুল হক খান মা, মাটি, বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি সত্তাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। বিবেকের দাসত্ব বরণ না করে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। হয়তো এসবই ছিল তাঁর অপরাধ। দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এবং দেশমাতৃকার বেদিমূলে সগর্বে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।
স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘদিন পরও তাঁর মা বিশ্বাস করতেন, তাঁর আদরের সন্তান বেঁচে আছেন, তাঁর কাছে ফিরে আসবেন। বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এ জন্য যে, শহীদ শামসুল হক খানকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদক ২০১০ প্রদান করেছে। ঢাকার একটি সড়কের নাম তাঁর নামে করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় বিশ্বাসী বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। ইতিপূর্বে কুমিল্লায় তাঁর নামে একটি সড়ক হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে জেলা প্রশাসকদের মধ্যে প্রথম শহীদ শামসুল হক খান স্মরণে বিয়াম মিলনায়তনের অডিটরিয়ামটির নামকরণ হলেও দেশের গণমাধ্যমগুলোতে শুধু বিয়াম মিলনায়তন অডিটরিয়াম হিসেবে উল্লেখ হতে দেখে খুব দুঃখ হয়। নামফলকটিও এত ছোট আকারে লাগানো হয়েছে যে সহজে চোখে পড়ে না।
মাকসুদুল হক খান

No comments

Powered by Blogger.