মূল রচনা-‘জয় বাংলা’র স্মৃতি by লিয়ার লেভিন
১৯৭০ সালে প্রকৃতি যখন তাণ্ডবলীলা চালাল, পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। একাত্তরে ক্যামেরা কাঁধে তিনি ছুটে এসেছেন নিজে। বানিয়েছেন তাঁর স্বপ্নের ছবি জয় বাংলা। এই লেখা মুক্তির গান ছবির মূল ফুটেজ ধারণকারী মার্কিন চিত্রগ্রাহক ও নির্মাতা লিয়ার লেভিনের স্মৃতিচারণা। ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আর বন্যা অগণন মৃত্যু ডেকে এনেছিল পূর্ব পাকিস্তানে। আরও অনেক আমেরিকানের মতো আমিও ব্যাকুল হয়েছিলাম আক্রান্তদের সাহায্য করার
জন্য। একজন চিত্রনির্মাতা, বিশেষ করে টিভি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণে অভিজ্ঞ একজন ক্যামেরাম্যান হিসেবে আমার মনে হয়েছিল, বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরিই হবে তাদের সাহায্য করার জন্য সেরা উপায়। ৩০ সেকেন্ডের একটা বিজ্ঞাপন আমি বানিয়েছিলাম, যেটি দি আমেরিকান টেলিভিশন অ্যাডভার্টাইজিং কাউন্সিলের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সব টিভি স্টেশনে খানিক পরপর সেই বিজ্ঞাপন দেখানো হয়েছে। দি অ্যাডভার্টাইজিং কাউন্সিল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানি মিশন আশ্বস্ত করেছিল, আমার সেই প্রচেষ্টা বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অতিজরুরি ত্রাণ সংগ্রহে ভূমিকা রেখেছে।
এক বছর পর পশ্চিম পাকিস্তান সশস্ত্র আক্রমণ করে বসল পূর্ব পাকিস্তানে। বাঙালিদের ঘরহীন হয়ে পড়া, বাঙালিদের যন্ত্রণা ছিল ধারণার বাইরে। যখন খবরগুলো পড়তাম, শুনতাম বা দেখতাম, শুধু মনে হতো, আমি কি কোনোভাবে এই মানুষগুলোর পাশে আবার দাঁড়াতে পারি, যে মানুষগুলো আমাকে আমার হূদয় এভাবে স্পর্শ করেছে!
আমার চলচ্চিত্রপ্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী ছিল, মার্শা অ্যাপেট। বাঙালির সংস্কৃতি সম্পর্কে যে সব সময় খুবই উৎসাহী ছিল। এটা আসলে শুরু হয়েছিল ফরাসি চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোঁর বানানো দ্য রিভার দেখার পর থেকে। আমার নায়কদেরও একজন ছিলেন সত্যজিৎ রায়। বাংলার সৌন্দর্য, এর মানুষ এবং এর সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে তিনি আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের ছায়াছবির পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা হূদয়বিদারক সব খবর নিয়ে আলোচনা আমাদের ছোট্ট অফিসের রোজকার ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ তহবিল গড়তে সরকারি বিজ্ঞাপন তৈরির উপায়ও ছিল না। কারণ, আমাদের সরকার ছিল হামলাকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
একটা ছবি বানানোর কথা এমনিতেই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু সেটি মাথার মধ্যেই আটকে রেখে দিয়েছিলাম, এর অনেক কারণও ছিল। আমি এমন একটা নতুন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, যাদের সামর্থ্য অনেক সীমিত। তা ছাড়া আমার কাজের যে ধরন, তাতে করে পরিবারের কাছ থেকে প্রায়ই আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে লম্বা সময় ধরে বিচ্ছিন্ন থাকতে হতো। আমার মেয়ে অ্যামেলিয়া তখন ছোট্ট শিশু। আমার স্ত্রী র্যাকুয়েল দ্বিতীয়বারের মতো সন্তানসম্ভবা।
র্যাকুয়েল সমব্যথীই ছিল। রাজিও হলো। কিন্তু ওর দুটি পরামর্শ ছিল—প্রথমত, ছবিটির দৈর্ঘ্য হতে হবে খুবই সংক্ষিপ্ত, যেন আমরা এই ঘটনা টাটকা থাকতে থাকতেই সেটা দ্রুত বানিয়ে ফেলতে পারি; দ্বিতীয়ত, কাজটা করতে হবে বাস্তবসম্মত বাজেটের মধ্যেই।
আমি বিশ্বাস করতাম, ছবির প্রথম ফ্রেমটা রোল করার আগেই আমাদের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে, আমরা আসলে কী করতে চাইছি। এমন অনেক ছবির প্রকল্প আমি ভেস্তে যেতে দেখেছি, যেগুলোর বিষয়বস্তু এগিয়েছে কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণার ওপর আলোকপাত না করেই। আমাদের চার সদস্যের ক্রুদের মধ্যে কেবল আমারই প্রামাণ্যচিত্র বানানোর অভিজ্ঞতা ছিল। এবং যেহেতু পুরো ছবি বানানোর টাকাই যাবে আমার পকেট থেকে; সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কেবল তখনই কাজ শুরু করব, যখন বুঝতে পারব আমরা আসলে কী করতে চাই।
যুদ্ধাঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার জন্য আমরা কলকাতায় অপেক্ষা করছিলাম। সে সময়টায় যুদ্ধের খবরাখবর শুনতাম, যদি একটু ধারণা পাই এ আশায়। বেশির ভাগ প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা একটা গল্প তুলে আনেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে।
লোকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ঘটনা বর্ণনা করছে—এটা আমি এড়াতে চাইছিলাম। এ পদ্ধতি টেলিভিশনের সংবাদ পরিবেশনায় দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু আমি এ পদ্ধতিতে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলাম না। আসলে এমন একটা গল্প চাইছিলাম, যে গল্পটি প্রকাশিত হবে এর চরিত্রদের দিয়েই। আমার লেন্স আর মাইক্রোফোনে যখন ধরা পড়বে, চরিত্রগুলো স্বাভাবিকভাবে নিজেদের কাজ করবে, একে অন্যের সঙ্গে কথা বলবে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় নিয়ে, কথা বলবে মামুলি সব বিষয় নিয়েও। জানতাম, এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ-প্রক্রিয়া খুবই কঠিন, বিশেষ করে একটা যুদ্ধের মাঝখানে।
মাহমুদুর রহমানবেনুর সঙ্গে যখন পরিচয় হলো, বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা সেই ব্যক্তির দেখা পেয়েছি, যিনি আমাদের গল্পের উপাদান সংগ্রহের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকতে পারবেন। নিজের দেশের তাণ্ডবলীলা থেকে পালিয়ে এসে বেনু কলকাতায় শরণার্থীদের মধ্যে থাকা শিল্পীদের একটি দলে সংগঠিত করেছেন। এই প্রতিভাবান দলটি নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে গিয়ে আশা আর বিজয়ের গান শুনিয়েছেন ঘরছাড়া মানুষকে। তাদের বিনোদিত করেছেন, আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছেন।
ঘরছাড়া শরণার্থীর সংখ্যা ৯০ লাখের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছিল। বেনু আমাদের বলেছিলেন, যেকোনো উপায়ে এই মানুষদের মানসিকভাবে উজ্জীবিত করাই তাঁর মিশন। তিনি ছিলেন বিনম্র, ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক।
দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিলাম, বেনুর দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তাদের পরিবেশনা আমরা ক্যামেরাবন্দী করব। পথে পথে ঘোরা দেশপ্রেমী এই সংগীতশিল্পীদের জীবনই তুলে আনব আমরা, এভাবেই এগোবে গল্প।
অবশেষে আমরা যখন কলকাতার আশপাশের জায়গাগুলোতে যাওয়ার অনুমতি পেলাম, তত দিনে আমাদের সময় আর বাজেটের চার ভাগের এক ভাগ শেষ! মরিয়া হয়ে আমরা তাই একটা সাধারণ আইডিয়া দাঁড় করালাম, যেন আমি অন্তত একটা নির্দিষ্ট ভাবনা মাথায় নিয়ে আমার ক্যামেরা চালু করতে পারি। সেটা হলো, দেশপ্রেমী এই সংগীতশিল্পীদের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে গিয়ে গান পরিবেশনার সঙ্গে বৈপরীত্য এনে দেখানো হবে যুদ্ধ-পূর্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তানের নিস্তরঙ্গ জীবন। আমরা সবাই সম্মত হলাম, এটাই হবে আমাদের ছবির কাঠামো।
আমাদের ছবিতে দেখানো হবে, শান্তিপূর্ণ একটি পরিবেশ, যেখানে নাগরিকেদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সহাবস্থান করে নিচ্ছে সংগীত ও শিল্পের নান্দনিকতা। আমি আশা করেছিলাম, এটা হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনও। সংবাদ ভাষ্য হিসেবে নয়; এর বদলে এটি হবে অতীত, বর্তমান এবং আশাবাদী ভবিষ্যতের সমন্বয়। এই ছবির নাম হবে জয় বাংলা। এমনভাবে বানানো হবে, ছবিটা একটি জাতিকে নাড়া দেবে; সম্ভব হলে পুরো বিশ্বকেই।
শুটিং শুরু করার পর আমার ক্যামেরা চলেছে বিরামহীনভাবে। আমাদের আইডিয়ার সঙ্গে মেলে—এমন সবকিছুই আমরা রেকর্ড করেছি। জীবন বাঁচাতে পলায়নপর শরণার্থীর লম্বা সারি, বিনয়ী পরিবার কিংবা একা একজন—সবাই চেষ্টা করছে সীমান্ত-শিবিরগুলোতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। আহত ব্যক্তিদের দিয়ে উপচে পড়ছে হাসপাতালগুলো, সারা দিন, সারা রাত চলছে টিকা দেওয়া; একটাই চেষ্টা, যেন মহামারি ছড়িয়ে না পড়ে।
আমি যখন এই যুদ্ধাক্রান্তদের কালো চোখের দিকে তাকাতাম, জীবনধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরও তাদের চোখে কিন্তু প্রতিফলিত হতো বিনম্রতা, আর সেই বাচনিক সৌন্দর্য, যার কথা সত্যজিৎ রায় আমাকে আগেই বলেছিলেন।
যেসব উপাদান আমরা সংগ্রহ করেছি—রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের এগিয়ে যাওয়ার দেশপ্রেমে উজ্জীবিত সব দৃশ্য, আশা আর স্বাধীনতার গান গাওয়া; সংগীতশিল্পীদের শক্তিশালী, প্রেরণাদায়ী বৈশিষ্ট্য, বাঙালি জনগোষ্ঠীর দৃঢ়চেতা মনোভাব—সবকিছু সুন্দরভাবে মেশানোর চেষ্টা করছিলাম আমি ও আমার ক্রুরা। আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠীর বাস্তুহারা হয়ে যাওয়ার প্রামাণ্য দলিলও তৈরি করার চেষ্টা করেছি আমরা।
এক দিন যুদ্ধক্ষেত্রের পাশের একটা হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় দুজন মানুষ আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। একজনের মুখ ছিল তোয়ালে দিয়ে ঢাকা, অন্যজনের হাতে মেশিনগান। তোয়ালের আড়ালে থাকা মানুষটি দ্বিতীয়জনকে আমার কাছে নিয়ে এল। পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করছিল যে, সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি আমেরিকান? উত্তর দেওয়ার আগেই সে দ্বিতীয় ব্যক্তিটির মুখ থেকে তোয়ালে সরিয়ে দিল, মুখের পুরোটাই প্রায় উড়ে গেছে! ‘এটা আমেরিকান এম-ফোরটিন রাইফেল’—বন্দুকধারী তার কাঁধ থেকে অস্ত্রটি হাতে নামাতে নামাতে বলল, ‘তুমি কি আমেরিকান?’
আমি পাথরমূর্তি হয়ে গেলাম। এ কারণে নয় যে একটা মানুষের ধ্বংসস্তূপের মুখোমুখি হতে হলো আমাকে। এরই মধ্যে বাঙালিদের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের শত শত দৃশ্য আমার দেখা হয়েই গেছে। আমি নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিলাম আসলে আমাদের দেওয়া একটা পরামর্শের কথা ভেবে। বলা হয়েছিল, এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিলে বলা যে আমি আসলে কানাডিয়ান। কানাডা তো আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করছে না।
‘তুমি কি আমেরিকান?’ সে যেন তাড়া দিল।
‘হ্যাঁ, আমি একজন আমেরিকান।’ আমি বললাম।
‘খোদা তোমার মঙ্গল করুক’, এই বলে সে লোকটার মুখ আবার ঢেকে দিয়ে তাকে নিয়ে চলে গেল। রক্তাক্ত সেই মানুষটি দুই দিন পর মারা গিয়েছিল।
এ ঘটনাটি আমার গল্পের কেন্দ্রে থাকা উচিত ছিল। আমি সেই গল্প এখনো লিখে পরিচালনা করতে পারি। ২৫ বছর ধরে আমি শুধু এটাই ভেবেছি, কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দৃশ্যত উদার একটি জাতি মানব ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য এই অপরাধযজ্ঞে সহায়তা করেছিল!
জয় বাংলা সম্পাদনা করতে নয়টি মাস লেগেছিল। ১০ মিনিটের আয়তন থেকে বেড়ে সেটা পূর্ণদৈর্ঘ্যর (৭২ মিনিটেরও বেশি) রূপ নিয়ে অবশেষে যখন পরিবেশকদের দেখানোর জন্য প্রস্তুত হলো, ততক্ষণে এর সংবাদমূল্য শেষ হয়ে গেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষ, নতুন একটা দেশের জন্ম হয়েছে, বাংলাদেশের নেতৃত্বও পাল্টেছে এরই মধ্যে। ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে বানানো এ ধরনের ছবির বাজার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাগৃহগুলোর জন্য আর ছিল না; ছিল না টেলিভিশন কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমের জন্যও। সম্পাদনার চূড়ান্ত পর্যায়ে যে-ই দেখেছে, সে-ই ছবিটির শক্তি, মানবিকতা আর ছবির চমকে দেওয়া মানের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেছে (সে সময় সুপার সিক্সটিন মিলিমিটার বলে তুলনামূলক নতুন একটা পদ্ধতি ব্যবহার করে এটার শুটিং হয়েছিল)।
ছবিটি দেখানো বা কেনার ব্যাপারে আমি একজন প্রযোজকের কাছ থেকেই একটু সাড়া পেয়েছিলাম, যিনি বাংলাদেশের ত্রাণ সাহায্যার্থে আয়োজিত কনসার্টের ফিল্মগুলোও একসঙ্গে করছিলেন। তিনি শুধু নৃশংস দৃশ্যের ফুটেজগুলো চাইছিলেন। আমি সাড়া দিইনি। আমি আসলে এ ধরনের কোনো দৃশ্য ধারণই করিনি। আর সুযোগ পেলেও আমি তা করতে দিতাম না। আমাকে সুযোগ দেওয়ার পরও যুদ্ধের কোনো দৃশ্য আমি ধারণ করিনি। ছবিতে যেসব মানুষ বা বিষয় ব্যবহার করা হয়েছে, তার ভেতর দিয়ে গুরুতর কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শও ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করিনি। তা ছাড়া আমার ফিল্ম আর টাকাও ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকায় ফিরে এসেছিলাম। আমার পরিবারের কাছে, তাদের দেখাতে ও বলতে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য বাঙালিদের সংগ্রামের গল্প।
এখন আমার ছবিটা থেকে দুই প্রতিভাবান নির্মাতা তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ একটা প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন। জয় বাংলা থেকে অনেক দৃশ্য নেওয়া হয়েছে। ২৫ বছর আগে আমরা যে হাজার হাজার ফুট ফুটেজ শুট করেছিলাম, সেটা থেকে নতুন করে নিয়ে, এর সঙ্গে বাড়তি ছবি যোগ করে, তাঁদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মেলে এমন তাৎপর্যপূর্ণ নিউজ রিল ফুটেজ কিনে, সব মিলিয়ে তাঁরা তৈরি করেছেন মুক্তির গান। তাঁদের এই চমৎকার ছবি টিকে থাকবে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই সময়টার স্মারক দলিল হয়ে থাকবে, যখন ধর্ম, সামাজিক অবস্থান সব ভুলে পুরো জাতি এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল একটা অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে।
যুক্তরাষ্ট্রও গত সিকি শতাব্দীতে অনেকটা পাল্টেছে। আশা করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্রে যে ঘাটতির পরিচয় দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে সেই ভুল আর করবে না।
যখন বেদনাদায়কভাবে বুঝতে পারলাম, আমার ছবিটি কখনোই জীবন পাবে না, আমি জয় বাংলার ২৪ ঘণ্টার শব্দ আর ছবি আমার বেসমেন্টের গুদামঘরে ফেলে রেখেছিলাম। স্ত্রীর পরামর্শ দুটি না শোনার জন্য তাঁর কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। এরপর সেই অভিযানে আমার খরচটা পুষিয়ে নিতে কাজে ফিরে গেছি। আমি যে কাঠামোতে পরিকল্পনা করেছিলাম, ঠিক সেভাবে এ ছবিটি বৃহত্তর দর্শকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবে না, সে জন্য আমার অনুতাপ হয়। কিন্তু এই ভেবে আমার খুশিও হয়, এর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে একটা নতুন ছবি। মুক্তির গান এমন একটা ছবি, যেটার আয়ু হবে অনেক লম্বা। এর কৃতিত্ব তারেক আর ক্যাথরিনের বুদ্ধিমত্তা, কঠোর পরিশ্রম আর সাহসের। আর যদি আমার কথা বলেন, আমি অন্তত জানতে পারব, খুবই নগণ্যভাবে হলেও আমিও একটা অবদান রেখেছি, যে অবদান রাখার ইচ্ছে আমার সব সময়ই ছিল। (সংক্ষেপিত)
* ১৯৯৬ সালে ঢাকায় আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধ চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকার জন্য লিয়ার লেভিন এই লেখাটি লিখেছিলেন।
ভাষান্তর: রাজীব হাসান
এক বছর পর পশ্চিম পাকিস্তান সশস্ত্র আক্রমণ করে বসল পূর্ব পাকিস্তানে। বাঙালিদের ঘরহীন হয়ে পড়া, বাঙালিদের যন্ত্রণা ছিল ধারণার বাইরে। যখন খবরগুলো পড়তাম, শুনতাম বা দেখতাম, শুধু মনে হতো, আমি কি কোনোভাবে এই মানুষগুলোর পাশে আবার দাঁড়াতে পারি, যে মানুষগুলো আমাকে আমার হূদয় এভাবে স্পর্শ করেছে!
আমার চলচ্চিত্রপ্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী ছিল, মার্শা অ্যাপেট। বাঙালির সংস্কৃতি সম্পর্কে যে সব সময় খুবই উৎসাহী ছিল। এটা আসলে শুরু হয়েছিল ফরাসি চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোঁর বানানো দ্য রিভার দেখার পর থেকে। আমার নায়কদেরও একজন ছিলেন সত্যজিৎ রায়। বাংলার সৌন্দর্য, এর মানুষ এবং এর সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে তিনি আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের ছায়াছবির পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা হূদয়বিদারক সব খবর নিয়ে আলোচনা আমাদের ছোট্ট অফিসের রোজকার ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ তহবিল গড়তে সরকারি বিজ্ঞাপন তৈরির উপায়ও ছিল না। কারণ, আমাদের সরকার ছিল হামলাকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
একটা ছবি বানানোর কথা এমনিতেই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু সেটি মাথার মধ্যেই আটকে রেখে দিয়েছিলাম, এর অনেক কারণও ছিল। আমি এমন একটা নতুন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, যাদের সামর্থ্য অনেক সীমিত। তা ছাড়া আমার কাজের যে ধরন, তাতে করে পরিবারের কাছ থেকে প্রায়ই আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে লম্বা সময় ধরে বিচ্ছিন্ন থাকতে হতো। আমার মেয়ে অ্যামেলিয়া তখন ছোট্ট শিশু। আমার স্ত্রী র্যাকুয়েল দ্বিতীয়বারের মতো সন্তানসম্ভবা।
র্যাকুয়েল সমব্যথীই ছিল। রাজিও হলো। কিন্তু ওর দুটি পরামর্শ ছিল—প্রথমত, ছবিটির দৈর্ঘ্য হতে হবে খুবই সংক্ষিপ্ত, যেন আমরা এই ঘটনা টাটকা থাকতে থাকতেই সেটা দ্রুত বানিয়ে ফেলতে পারি; দ্বিতীয়ত, কাজটা করতে হবে বাস্তবসম্মত বাজেটের মধ্যেই।
আমি বিশ্বাস করতাম, ছবির প্রথম ফ্রেমটা রোল করার আগেই আমাদের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে, আমরা আসলে কী করতে চাইছি। এমন অনেক ছবির প্রকল্প আমি ভেস্তে যেতে দেখেছি, যেগুলোর বিষয়বস্তু এগিয়েছে কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণার ওপর আলোকপাত না করেই। আমাদের চার সদস্যের ক্রুদের মধ্যে কেবল আমারই প্রামাণ্যচিত্র বানানোর অভিজ্ঞতা ছিল। এবং যেহেতু পুরো ছবি বানানোর টাকাই যাবে আমার পকেট থেকে; সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কেবল তখনই কাজ শুরু করব, যখন বুঝতে পারব আমরা আসলে কী করতে চাই।
যুদ্ধাঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার জন্য আমরা কলকাতায় অপেক্ষা করছিলাম। সে সময়টায় যুদ্ধের খবরাখবর শুনতাম, যদি একটু ধারণা পাই এ আশায়। বেশির ভাগ প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা একটা গল্প তুলে আনেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে।
লোকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ঘটনা বর্ণনা করছে—এটা আমি এড়াতে চাইছিলাম। এ পদ্ধতি টেলিভিশনের সংবাদ পরিবেশনায় দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু আমি এ পদ্ধতিতে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলাম না। আসলে এমন একটা গল্প চাইছিলাম, যে গল্পটি প্রকাশিত হবে এর চরিত্রদের দিয়েই। আমার লেন্স আর মাইক্রোফোনে যখন ধরা পড়বে, চরিত্রগুলো স্বাভাবিকভাবে নিজেদের কাজ করবে, একে অন্যের সঙ্গে কথা বলবে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় নিয়ে, কথা বলবে মামুলি সব বিষয় নিয়েও। জানতাম, এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ-প্রক্রিয়া খুবই কঠিন, বিশেষ করে একটা যুদ্ধের মাঝখানে।
মাহমুদুর রহমানবেনুর সঙ্গে যখন পরিচয় হলো, বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা সেই ব্যক্তির দেখা পেয়েছি, যিনি আমাদের গল্পের উপাদান সংগ্রহের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকতে পারবেন। নিজের দেশের তাণ্ডবলীলা থেকে পালিয়ে এসে বেনু কলকাতায় শরণার্থীদের মধ্যে থাকা শিল্পীদের একটি দলে সংগঠিত করেছেন। এই প্রতিভাবান দলটি নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে গিয়ে আশা আর বিজয়ের গান শুনিয়েছেন ঘরছাড়া মানুষকে। তাদের বিনোদিত করেছেন, আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছেন।
ঘরছাড়া শরণার্থীর সংখ্যা ৯০ লাখের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছিল। বেনু আমাদের বলেছিলেন, যেকোনো উপায়ে এই মানুষদের মানসিকভাবে উজ্জীবিত করাই তাঁর মিশন। তিনি ছিলেন বিনম্র, ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক।
দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিলাম, বেনুর দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তাদের পরিবেশনা আমরা ক্যামেরাবন্দী করব। পথে পথে ঘোরা দেশপ্রেমী এই সংগীতশিল্পীদের জীবনই তুলে আনব আমরা, এভাবেই এগোবে গল্প।
অবশেষে আমরা যখন কলকাতার আশপাশের জায়গাগুলোতে যাওয়ার অনুমতি পেলাম, তত দিনে আমাদের সময় আর বাজেটের চার ভাগের এক ভাগ শেষ! মরিয়া হয়ে আমরা তাই একটা সাধারণ আইডিয়া দাঁড় করালাম, যেন আমি অন্তত একটা নির্দিষ্ট ভাবনা মাথায় নিয়ে আমার ক্যামেরা চালু করতে পারি। সেটা হলো, দেশপ্রেমী এই সংগীতশিল্পীদের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে গিয়ে গান পরিবেশনার সঙ্গে বৈপরীত্য এনে দেখানো হবে যুদ্ধ-পূর্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তানের নিস্তরঙ্গ জীবন। আমরা সবাই সম্মত হলাম, এটাই হবে আমাদের ছবির কাঠামো।
আমাদের ছবিতে দেখানো হবে, শান্তিপূর্ণ একটি পরিবেশ, যেখানে নাগরিকেদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সহাবস্থান করে নিচ্ছে সংগীত ও শিল্পের নান্দনিকতা। আমি আশা করেছিলাম, এটা হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনও। সংবাদ ভাষ্য হিসেবে নয়; এর বদলে এটি হবে অতীত, বর্তমান এবং আশাবাদী ভবিষ্যতের সমন্বয়। এই ছবির নাম হবে জয় বাংলা। এমনভাবে বানানো হবে, ছবিটা একটি জাতিকে নাড়া দেবে; সম্ভব হলে পুরো বিশ্বকেই।
শুটিং শুরু করার পর আমার ক্যামেরা চলেছে বিরামহীনভাবে। আমাদের আইডিয়ার সঙ্গে মেলে—এমন সবকিছুই আমরা রেকর্ড করেছি। জীবন বাঁচাতে পলায়নপর শরণার্থীর লম্বা সারি, বিনয়ী পরিবার কিংবা একা একজন—সবাই চেষ্টা করছে সীমান্ত-শিবিরগুলোতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। আহত ব্যক্তিদের দিয়ে উপচে পড়ছে হাসপাতালগুলো, সারা দিন, সারা রাত চলছে টিকা দেওয়া; একটাই চেষ্টা, যেন মহামারি ছড়িয়ে না পড়ে।
আমি যখন এই যুদ্ধাক্রান্তদের কালো চোখের দিকে তাকাতাম, জীবনধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরও তাদের চোখে কিন্তু প্রতিফলিত হতো বিনম্রতা, আর সেই বাচনিক সৌন্দর্য, যার কথা সত্যজিৎ রায় আমাকে আগেই বলেছিলেন।
যেসব উপাদান আমরা সংগ্রহ করেছি—রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের এগিয়ে যাওয়ার দেশপ্রেমে উজ্জীবিত সব দৃশ্য, আশা আর স্বাধীনতার গান গাওয়া; সংগীতশিল্পীদের শক্তিশালী, প্রেরণাদায়ী বৈশিষ্ট্য, বাঙালি জনগোষ্ঠীর দৃঢ়চেতা মনোভাব—সবকিছু সুন্দরভাবে মেশানোর চেষ্টা করছিলাম আমি ও আমার ক্রুরা। আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠীর বাস্তুহারা হয়ে যাওয়ার প্রামাণ্য দলিলও তৈরি করার চেষ্টা করেছি আমরা।
এক দিন যুদ্ধক্ষেত্রের পাশের একটা হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় দুজন মানুষ আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। একজনের মুখ ছিল তোয়ালে দিয়ে ঢাকা, অন্যজনের হাতে মেশিনগান। তোয়ালের আড়ালে থাকা মানুষটি দ্বিতীয়জনকে আমার কাছে নিয়ে এল। পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করছিল যে, সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি আমেরিকান? উত্তর দেওয়ার আগেই সে দ্বিতীয় ব্যক্তিটির মুখ থেকে তোয়ালে সরিয়ে দিল, মুখের পুরোটাই প্রায় উড়ে গেছে! ‘এটা আমেরিকান এম-ফোরটিন রাইফেল’—বন্দুকধারী তার কাঁধ থেকে অস্ত্রটি হাতে নামাতে নামাতে বলল, ‘তুমি কি আমেরিকান?’
আমি পাথরমূর্তি হয়ে গেলাম। এ কারণে নয় যে একটা মানুষের ধ্বংসস্তূপের মুখোমুখি হতে হলো আমাকে। এরই মধ্যে বাঙালিদের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের শত শত দৃশ্য আমার দেখা হয়েই গেছে। আমি নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিলাম আসলে আমাদের দেওয়া একটা পরামর্শের কথা ভেবে। বলা হয়েছিল, এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিলে বলা যে আমি আসলে কানাডিয়ান। কানাডা তো আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করছে না।
‘তুমি কি আমেরিকান?’ সে যেন তাড়া দিল।
‘হ্যাঁ, আমি একজন আমেরিকান।’ আমি বললাম।
‘খোদা তোমার মঙ্গল করুক’, এই বলে সে লোকটার মুখ আবার ঢেকে দিয়ে তাকে নিয়ে চলে গেল। রক্তাক্ত সেই মানুষটি দুই দিন পর মারা গিয়েছিল।
এ ঘটনাটি আমার গল্পের কেন্দ্রে থাকা উচিত ছিল। আমি সেই গল্প এখনো লিখে পরিচালনা করতে পারি। ২৫ বছর ধরে আমি শুধু এটাই ভেবেছি, কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দৃশ্যত উদার একটি জাতি মানব ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য এই অপরাধযজ্ঞে সহায়তা করেছিল!
জয় বাংলা সম্পাদনা করতে নয়টি মাস লেগেছিল। ১০ মিনিটের আয়তন থেকে বেড়ে সেটা পূর্ণদৈর্ঘ্যর (৭২ মিনিটেরও বেশি) রূপ নিয়ে অবশেষে যখন পরিবেশকদের দেখানোর জন্য প্রস্তুত হলো, ততক্ষণে এর সংবাদমূল্য শেষ হয়ে গেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষ, নতুন একটা দেশের জন্ম হয়েছে, বাংলাদেশের নেতৃত্বও পাল্টেছে এরই মধ্যে। ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে বানানো এ ধরনের ছবির বাজার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাগৃহগুলোর জন্য আর ছিল না; ছিল না টেলিভিশন কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমের জন্যও। সম্পাদনার চূড়ান্ত পর্যায়ে যে-ই দেখেছে, সে-ই ছবিটির শক্তি, মানবিকতা আর ছবির চমকে দেওয়া মানের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেছে (সে সময় সুপার সিক্সটিন মিলিমিটার বলে তুলনামূলক নতুন একটা পদ্ধতি ব্যবহার করে এটার শুটিং হয়েছিল)।
ছবিটি দেখানো বা কেনার ব্যাপারে আমি একজন প্রযোজকের কাছ থেকেই একটু সাড়া পেয়েছিলাম, যিনি বাংলাদেশের ত্রাণ সাহায্যার্থে আয়োজিত কনসার্টের ফিল্মগুলোও একসঙ্গে করছিলেন। তিনি শুধু নৃশংস দৃশ্যের ফুটেজগুলো চাইছিলেন। আমি সাড়া দিইনি। আমি আসলে এ ধরনের কোনো দৃশ্য ধারণই করিনি। আর সুযোগ পেলেও আমি তা করতে দিতাম না। আমাকে সুযোগ দেওয়ার পরও যুদ্ধের কোনো দৃশ্য আমি ধারণ করিনি। ছবিতে যেসব মানুষ বা বিষয় ব্যবহার করা হয়েছে, তার ভেতর দিয়ে গুরুতর কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শও ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করিনি। তা ছাড়া আমার ফিল্ম আর টাকাও ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকায় ফিরে এসেছিলাম। আমার পরিবারের কাছে, তাদের দেখাতে ও বলতে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য বাঙালিদের সংগ্রামের গল্প।
এখন আমার ছবিটা থেকে দুই প্রতিভাবান নির্মাতা তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ একটা প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন। জয় বাংলা থেকে অনেক দৃশ্য নেওয়া হয়েছে। ২৫ বছর আগে আমরা যে হাজার হাজার ফুট ফুটেজ শুট করেছিলাম, সেটা থেকে নতুন করে নিয়ে, এর সঙ্গে বাড়তি ছবি যোগ করে, তাঁদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মেলে এমন তাৎপর্যপূর্ণ নিউজ রিল ফুটেজ কিনে, সব মিলিয়ে তাঁরা তৈরি করেছেন মুক্তির গান। তাঁদের এই চমৎকার ছবি টিকে থাকবে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই সময়টার স্মারক দলিল হয়ে থাকবে, যখন ধর্ম, সামাজিক অবস্থান সব ভুলে পুরো জাতি এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল একটা অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে।
যুক্তরাষ্ট্রও গত সিকি শতাব্দীতে অনেকটা পাল্টেছে। আশা করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্রে যে ঘাটতির পরিচয় দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে সেই ভুল আর করবে না।
যখন বেদনাদায়কভাবে বুঝতে পারলাম, আমার ছবিটি কখনোই জীবন পাবে না, আমি জয় বাংলার ২৪ ঘণ্টার শব্দ আর ছবি আমার বেসমেন্টের গুদামঘরে ফেলে রেখেছিলাম। স্ত্রীর পরামর্শ দুটি না শোনার জন্য তাঁর কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। এরপর সেই অভিযানে আমার খরচটা পুষিয়ে নিতে কাজে ফিরে গেছি। আমি যে কাঠামোতে পরিকল্পনা করেছিলাম, ঠিক সেভাবে এ ছবিটি বৃহত্তর দর্শকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবে না, সে জন্য আমার অনুতাপ হয়। কিন্তু এই ভেবে আমার খুশিও হয়, এর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে একটা নতুন ছবি। মুক্তির গান এমন একটা ছবি, যেটার আয়ু হবে অনেক লম্বা। এর কৃতিত্ব তারেক আর ক্যাথরিনের বুদ্ধিমত্তা, কঠোর পরিশ্রম আর সাহসের। আর যদি আমার কথা বলেন, আমি অন্তত জানতে পারব, খুবই নগণ্যভাবে হলেও আমিও একটা অবদান রেখেছি, যে অবদান রাখার ইচ্ছে আমার সব সময়ই ছিল। (সংক্ষেপিত)
* ১৯৯৬ সালে ঢাকায় আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধ চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকার জন্য লিয়ার লেভিন এই লেখাটি লিখেছিলেন।
ভাষান্তর: রাজীব হাসান
No comments